Advertisement
E-Paper

বহু দিন পরে ডার্বি আজ বঙ্গ ব্রিগেডের দখলে

জোড়া গলদা চিংড়ি সাড়ে তিনশো টাকায় কিনে ধুলোমলিন চেহারার যে যুবক সাতসকালে মোহনবাগান মাঠে হাজির, তাঁর সারা দিনে রোজগারই মেরেকেটে দু’শো টাকা। সালকিয়ার ছেলেটি ক্যাটারিংয়ের দোকানে কাজ করেন।

রতন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২০১৬ ০৩:৩৬
সামনে তেইশে জানুয়ারির যুদ্ধ। নেতাজির জন্মদিনে় ‘বঙ্গভঙ্গের’ মহড়া। শুক্রবার। ছবি:শঙ্কর নাগ দাস ও উৎপল সরকার।

সামনে তেইশে জানুয়ারির যুদ্ধ। নেতাজির জন্মদিনে় ‘বঙ্গভঙ্গের’ মহড়া। শুক্রবার। ছবি:শঙ্কর নাগ দাস ও উৎপল সরকার।

জোড়া গলদা চিংড়ি সাড়ে তিনশো টাকায় কিনে ধুলোমলিন চেহারার যে যুবক সাতসকালে মোহনবাগান মাঠে হাজির, তাঁর সারা দিনে রোজগারই মেরেকেটে দু’শো টাকা। সালকিয়ার ছেলেটি ক্যাটারিংয়ের দোকানে কাজ করেন।

ব্যান্ড বাজাতে বাজাতে যে ছেলে-মেয়ের দল ইস্টবেঙ্গল গ্যালারিতে হুল্লোড় তুলছিল, তাদের গলায় বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থার কার্ড ঝোলানো। অফিসে হাজিরা দিয়েই সোজা ময়দানে হাজির তারা।

মেজাজি কর্নেল গ্লেন মোহনবাগান মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন দ্রুত। তবে ধরা পড়ে গেলেন সনি নর্ডি। বেরোনোর সময় তাঁকে ঘিরে ধরলেন এত বেশি সবুজ-মেরুন সমর্থক যে, অসংখ্য কালো মাথার মধ্যে সোনালি চুলের হাইতি স্ট্রাইকারকে গ্যালারি থেকে দেখাচ্ছিল যেন পূর্ণিমার চাঁদ!

ইস্টবেঙ্গল মাঠে আবার র‌্যান্টি মার্টিন্স আর ডু ডং-কে নিয়ে গোটা দশেক ছড়া লিখে এনেছিলেন বেলেঘাটার এক লাল-হলুদ সমর্থক। জমাট ভিড়ে তিনি তা পড়ার সময় বাকি সমর্থকদের উচ্ছ্বাসের ঢেউ উঠেছিল বারবার।

আবেগের বিচ্ছুরণ। ক্লাবকে ভালবেসে বোহেমিয়ান হওয়া। জেতার তীব্র তাড়না। সব যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে শুক্রবার সকালে দুই প্রধানের চূড়ান্ত প্র্যক্টিসে। দু’মাঠেই অনুশীলনে উপচে পড়া ভিড়। সেটা তো বঙ্গজীবনের অঙ্গ হয়ে গিয়েছে বহু বছর আগেই। কিন্তু এ বার ডার্বির আগের দিন যেটা চোখ টানছে— ম্যাচের আগেই ফুটবলারদের মালা পরিয়ে উদ্বুদ্ধ করার নয়া প্রথা। নিজস্বী তোলার হুড়োহুড়ি।

ইস্ট-মোহন দু’দলের মাঠ থেকেই একটু দূরে রেড রোডে ভোরের কুয়াশায় প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের মহড়ায় বাজছে বিউগল। সেনা-ব্যান্ডে ‘চল রে নওজওয়ান’-এর সুর। মাইকে চলছে, ‘বাঁধ ভেঙে দাও-ও-ও’। কেমন একটা যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব গোটা ময়দান জুড়ে। আই লিগ ডার্বির আগের দিন দু’ক্লাবের আবহের সঙ্গে যা অনেকটাই মিলে যায়। কলকাতায় ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান মুখোমুখি হওয়া মানেই তো ‘যুদ্ধ’। নব্বই মিনিটের বঙ্গভঙ্গ।

বিকেলে পাশাপাশি বসে দুই প্রধানের ‘সেনাপ্রধান’দ্বয়ও তো চালিয়ে দিলেন গোলাগুলি। পিকে বনাম অমল দত্তের মতো সরাসরি আক্রমণে যাননি হয়তো। কিন্তু দুই বঙ্গসন্তান কোচ সৌজন্য রেখে যতটুকু বলা যায় বলে দিলেন।

‘‘গ্লেন-সনিদের থামানোর জন্য আমার ডিফেন্স তৈরি। সে ভাবেই তৈরি হয়েছি। ম্যাচটা কেউ সহজে জিততে পারবে না,’’ ইস্টবেঙ্গল কোচ বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য যখন এ রকম বলছেন, তখন তাঁর একটা চেয়ার পরেই বসে সঞ্জয় সেন।

বাগান কোচের পাল্টা তোপ, ‘‘বড় ক্লাবে খেললেই বড় কোচ হওয়া যায় মানি না। মোরিনহো বা ফার্গুসন কোন ক্লাবে ফুটবল খেলেছেন কেউ বলতে পারবেন? কাল দেখা যাবে কে কী করল।’’ কালীঘাট ব্রিজের এ পার-ও পার দুই কোচের বাড়ি। তাতেও কী যুদ্ধংদেহি মেজাজ! এটাই মনে হয় চিরকালের ডার্বির মাহাত্ম্য। যা সংক্রামিত দুই কোচের ছাত্রদের মধ্যেও।

বাগানের হার্টথ্রব সনি নর্ডির মতো শান্ত ফুটবলারের গলা থেকেই বেরিয়েছে, ‘‘ওদের যদি র‌্যান্টি-ডং থাকে আমাদেরও কর্নেল-বলবম্ত আছে।’’ আর তার একটু পরেই ইস্টবেঙ্গলের গোলমেশিন র‌্যান্টির মন্তব্য, ‘‘ওরা হয়তো এগিয়ে। আমরাও কিন্তু পিছিয়ে নেই।’’

আজ শনিবারের ম্যাচ জিতলে বা হারলে আই লিগ হাতছাড়া হবে না কারও। মোহনবাগান জিতলে বা ড্র করলে লিগ টেবলে এক নম্বরেই থাকবে। আর দু’পয়েন্টে পিছিয়ে থাকা ইস্টবেঙ্গল ডার্বি জিতলে উঠে আসবে সবার উপরে। তা সত্ত্বেও কী অনন্ত চাপ। কী প্রত্যাশা! ধারে-ভারে তাঁর দল ফেভারিট হওয়া সত্ত্বেও বাগান প্রেসিডেন্ট টুটু বসু ফুটবলারদের নিয়ে মিটিং করে বলে দিয়েছেন, ‘‘কাল আমার জন্মদিন। কেক চাই না। শুধু গোল চাই। গোল।’’

যা শুনে ইস্টবেঙ্গলের অন্যতম শীর্ষকর্তা দেবব্রত সরকারের মন্তব্য, ‘‘আমরা যা বলব সব মাঠে।’’

নেতাজির জন্মদিনে ডার্বি হাজির যেন নানা ক্যানভাসে।

আক্রমণের ঢেউ বনাম রক্ষণের বাঁধ

গ্লেন-বলবন্তের সঙ্গে সনি। রিজার্ভ বেঞ্চে জেজে। বাগানের আক্রমণভাগকে দেশের সেরা বলা হচ্ছে। সনি না থাকা সত্ত্বেও প্রথম দু’ম্যাচে সাত গোল করেছে বাগান। বলা হচ্ছে, বাগান আক্রমণের শক্তি এতটাই, যে কোনও রক্ষণকে দুমড়ে মুচড়ে দিতে পারে অনায়াসে। ইস্টবেঙ্গল গত ছয় দিন সে জন্য শুধু রক্ষণকেই আঁটোসাঁটো করেছে। বেলো-অর্ণব-রবার্ট-রাহুলের সামনে মেহতাব-খাবরা। ছয় জনের বাঁধ তৈরি করছেন লাল-হলুদ কোচ। সনি-গ্লেন সামলাতে। প্রথম পনেরো মিনিট গুরুত্বপূর্ণ। ওই সময় বাগানের ঢেউ যদি সামলাতে পারেন বেলোরা তা হলে পরের দিকে অনেকটাই স্বস্তি আসবে লাল-হলুদে।

র‌্যান্টি ‘অর্জুন’ হলে সাব্রোসা ‘মেঘনাদ’

বাগান রক্ষণ নড়বড় করেছে প্রথম দু’ম্যাচে। সাত গোল দিয়ে তিন গোল খেয়েছে। র‌্যান্টি আর ডংদের চোখ বাগান রক্ষণের সেই ফাটলে। ‘সফট্ টার্গেট’ কিংশুক দেবনাথ। কিন্তু এসে পড়েছেন অভিজ্ঞ লুসিয়ানো সাব্রোসা। লাল-হলুদ জনতা গোলের জন্য তাকিয়ে ধূর্ত র‌্যান্টির দিকে। বিপক্ষ বক্সের আশপাশে ভয়ঙ্কর তাঁর আনোগোনা। আর এই অবস্থায় বাগান আস্থা রাখছে সাব্রোসার উপর। র‌্যান্টিকে হাতের তালুর মতো চেনেন এই ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্ডার। এ দিন বাগান অনুশীলনে পরখ করে নিতে তাঁকে গ্লেন-সনির বিরুদ্ধে ‘রক্ষণের ক্যাপ্টেন’ করে খেলালেন সঞ্জয়। সাব্রোসাকে দেখে মনে হচ্ছিল বাগান রক্ষণের মেঘনাদ। ‘আড়ালে’ থেকে কঠিন আক্রমণ থামাবেন। কিংশুক বা প্রীতমরা ভুল করলে পিছন থেকে সামাল দেবেন।

বঙ্গ আমার, ডার্বি আমার

কলকাতা ডার্বিতে ফের ফিরছে বঙ্গসন্তানদের দাপট। যা হারিয়ে গিয়েছিল বহু দিন। দু’দলের কোচ বঙ্গসন্তান। তাই কী আস্থা? তা হোক। নস্টালজিক বাঙালি খুশি। বাগানে দেবজিৎ-প্রীতম-কিংশুক-প্রণয়-শৌভিক খেলবেন আজ। আর বেঙ্গলে মেহতাব-অর্ণব মণ্ডলের সঙ্গে হয়তো রফিক। প্রথম বাইশে সাত বিদেশি খেলবেন। পাশাপাশি সাত-আট জন বাঙালিও। খারাপ কী?

সংশয় আর মিথ

পিছিয়ে থাকা ইস্টবেঙ্গল ভয়ঙ্কর। এটা মিথ। ফেভারিট দল সব সময় ডার্বি জেতে না, এটাও অতীতে অনেক বার ঘটেছে। বাগান অনুশীলনের সময় গ্যালারিতে চিংড়ি, রজনীগন্ধার মালা আর হইচই দেখে শঙ্কিত হয়ে পড়লেন টেকনিক্যাল কমিটির দুই সদস্য—বিদেশ বসু আর শিবাজি বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রাক্তন দুই ফুটবলারের স্মৃতিতে ফিরল সাতাত্তররের লিগের সেই ডার্বি। শিবাজি বলছিলেন, ‘‘আরে সে বার তো আমাদের দুদার্ন্ত টিম। ম্যাচের আগের দিনই সবাই সবুজ আবির উড়িয়েছিল। কিন্তু মিহির আর সমরেশ গোল করে হারিয়ে দিয়েছিল আমাদের। কী যে হয়ে গিয়েছিল ম্যাচটায় মোহনবাগানের!’’ পাশে বসে বিদেশ মাথা নাড়েন। আর ফুটবল সচিব সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য? ‘‘ফেভারিট মানেই বরং চাপ। এই টিম নিয়ে না জেতাটাই অঘটন হবে।’’

ছেলের বিয়ে আছে, ডার্বি নেই

ছেলের বিয়ের দিনই পড়ে গিয়েছে ডার্বি। তাই সমস্যায় ইস্ট-মোহনের দুই প্রাক্তন তারকা ফুটবলার ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায় আর মানস ভট্টাচার্য। নিজেরা বহু ডার্বি জিতেছেন, হেরেছেন। ডার্বি মিস করেন না কখনও। আজ বাবা হয়ে ছেলের বিয়ে দেবেন। মন পড়ে থাকবে কিন্তু মাঠে। ভাস্করের বাজি এই ম্যাচে ইস্টবেঙ্গল, মানসের মোহনবাগান। ভাস্কর বললেন, ‘‘আন্ডারডগ ইস্টবেঙ্গল ভয়ঙ্কর।’’ আর মানসের মন্তব্য, ‘‘সনি আসায় বাগানকে আটকানো কঠিন।’’

বৌভাতের সন্ধেয় ভাস্কর না মানস— কার বাড়ির আলোর রোশনাই বেশি হবে কে জানে!

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy