Advertisement
০৩ মে ২০২৪

মায়ের ঘুম নষ্ট করব না, তাই করে যাও ইয়র্কার

দুপুরে মা ঘুমোতেন। ছেলের বল করার শব্দে ঘুম ভেঙে যেত। মা তাই শর্ত দিলেন, বল করতে পারো কিন্তু আওয়াজ যেন না হয়। অভিনব পরিকল্পনা মাথা থেকে বের করতে হল ছেলেকে।

বিধ্বংসী: ছয় উইকেট নিয়ে প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়াকে দুমড়ে দেওয়ার পরে যশপ্রীত বুমরাকে অভিনন্দন অধিনায়ক বিরাট কোহালির। শুক্রবার। এপি

বিধ্বংসী: ছয় উইকেট নিয়ে প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়াকে দুমড়ে দেওয়ার পরে যশপ্রীত বুমরাকে অভিনন্দন অধিনায়ক বিরাট কোহালির। শুক্রবার। এপি

সুমিত ঘোষ 
মেলবোর্ন, শেষ আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৩:৩৪
Share: Save:

দুপুরে মা ঘুমোতেন। ছেলের বল করার শব্দে ঘুম ভেঙে যেত। মা তাই শর্ত দিলেন, বল করতে পারো কিন্তু আওয়াজ যেন না হয়। অভিনব পরিকল্পনা মাথা থেকে বের করতে হল ছেলেকে। দেওয়াল যেখানে শুরু হচ্ছে, ঠিক ফ্লোরিংয়ের সেই অংশে বল করো। তা হলে শব্দ হবে না। মায়েরও ঘুম ভাঙবে না আর বল করে যাওয়াও কেউ আটকাতে পারবে না!

যশপ্রীত বুমরার রূপকথার পৃথিবীতে আপনাদের স্বাগত। এই পৃথিবীতে এক বার ‘গাইডেড টুর’ নিলে প্রত্যেক মুহূর্তে এমন সব অবিশ্বাস্য কাহিনির সন্ধান পাওয়া যাবে। সব চেয়ে বিখ্যাত অবশ্যই তাঁর ইয়র্কার শেখার কাহিনি। দুপুরে মায়ের ঘুম ভাঙানো যাবে না বলে ড্রপ ফেলতে পারতেন না বল। একেবারে দেওয়ালের নীচে গিয়ে পড়বে। পরবর্তী কালে বুমরা বল করতে যাওয়ার সময়ে সেই দেওয়ালটাই হয়ে গিয়েছে ব্যাটসম্যানের পা। মাকে ঘুমোতে দেওয়ার জন্য যে বল শিখেছিলেন, তা-ই এখন ঘুম কেড়ে নিয়েছে বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যানদের।

দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ইংল্যান্ড ঘুরে অস্ট্রেলিয়াতে এসেও চলছে বুম বুম বুমরার জয়ধ্বনি। বরিস বেকারের সার্ভিসের মতোই ইয়র্কার আছড়ে পড়ছে ব্যাটসম্যানদের পায়ের গোড়ায়। শুক্রবার তাঁর ছোটবেলার কাহিনি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বুমরা বলছিলেন, ‘‘মায়ের ঘুম নষ্ট করার উপায় ছিল না। তাই এ রকম একটা ফন্দি নিতেই হয়েছিল।’’ তার পরেই যোগ করলেন, ‘‘মা খুব খুশি আমার সাফল্য দেখে। অনেক কষ্ট করে উনি আমাকে বড় করে তুলেছেন।’’

আরও পড়ুন: অধিনায়ককে অপমানজনক মন্তব্য, জবাব দিতে চায় দল

সাত বছর বয়সে হেপাটাইটিস বি-তে আক্রান্ত বাবাকে হারান ভারতীয় ক্রিকেটের সেরা পেস-অস্ত্র। তার পর থেকে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে বুমরা এবং তাঁর বোনকে একাই বড় করে তোলেন মা দলজিৎ। শুধু ভারতীয় ক্রিকেট বলে নয়, বিশ্বের দরবারের কাছেই তাঁর উত্থান এক চমকপ্রদ কাহিনি। এ দিন যেমন অস্ট্রেলিয়া তাঁর বোলিংয়ের সামনে বিধ্বস্ত হয়ে সেই সব গায়ে কাঁটা দেওয়া কাহিনি শুনল মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে। শেন ওয়ার্ন পর্যন্ত বার বার কমেন্ট্রি করতে গিয়ে বলছিলেন, ‘‘কী অসাধারণ জীবনকাহিনি ছেলেটার! সেরা ক্রিকেট রূপকথা।’’

স্কোরকার্ড
ভারত ৪৪৩-৭ ডি. ও ৫৪-৫
অস্ট্রেলিয়া ১৫১

অস্ট্রেলিয়া (প্রথম ইনিংস, ৮-০ এর পর)
হ্যারিস ক ইশান্ত বো বুমরা ২২
ফিঞ্চ ক মায়াঙ্ক বো ইশান্ত ৮
খোয়াজা ক মায়াঙ্ক বো জাডেজা ২১
শন মার্শ এলবিডব্লিউ বুমরা ১৯
ট্র্যাভিস হেড বো বুমরা ২০
মিচেল মার্শ ক রাহানে বো জাডেজা ৯
পেন ক ঋষভ বো বুমরা ২২
প্যাট কামিন্স বো শামি ১৭
মিচেল স্টার্ক ন.আ ৭
নেথান লায়ন এলবিডব্লিউ বুমরা ০
জশ হেজলউড বো বুমরা ০
অতিরিক্ত ৬
মোট ১৫১
পতন: ১-২৪ (ফিঞ্চ, ১০.৩), ২-৩৬ (হ্যারিস, ১৩.৩), ৩-৫৩ (খোয়াজা, ১৯.৫), ৪-৮৯ (শন মার্শ, ৩২.৬), ৫-৯২ (হেড, ৩৬.৪), ৬-১০২ (মিচেল মার্শ, ৪৩.৩), ৭-১৩৮ (কামিন্স, ৬০.৬), ৮-১৪৭ (পেন, ৬৪.৩), ৯-১৫১ (লায়ন, ৬৬.২), ১০-১৫১ (হেজলউড, ৬৬.৫)।
বোলিং: ইশান্ত শর্মা ১৩-২-৪১-১, যশপ্রীত বুমরা ১৫.৫-৪-৩৩-৬, রবীন্দ্র জাডেজা ২৫-৮-৪৫-২, মহম্মদ শামি ১০-২-২৭-১, হনুমা বিহারী ৩-২-১-০।

ভারত (দ্বিতীয় ইনিংস)
হনুমা ক খোয়াজা বো কামিন্স ১৩
মায়াঙ্ক আগরওয়াল ব্যাটিং ২৮
পূজারা ক হ্যারিস বো কামিন্স ০
কোহালি ক হ্যারিস বো কামিন্স ০
রাহানে ক পেন বো কামিন্স ১
রোহিত ক মার্শ বো হেজলউড ৫
ঋষভ পন্থ ব্যাটিং ৬
অতিরিক্ত ১
মোট ৫৪
পতন: ১-২৮ (হনুমা, ১২.৬), ২-২৮ (পূজারা, ১৪.২), ৩-২৮ (কোহালি, ১৪.৬), ৪-৩২ (রাহানে, ১৬.১), ৫-৪৪ (রোহিত, ২২.৫)।
বোলিং: মিচেল স্টার্ক ৩-১-১১-০, জশ হেজলউড ৮-৩-১৩-১, নেথান লায়ন ১০-১-১৯-০, প্যাট কামিন্স ৬-২-১০-৪।

ওয়ার্ন তত ক্ষণে দেখে নিয়েছেন, কী ভাবে তাঁর দেশের ব্যাটসম্যানেরা বিধ্বস্ত হয়েছেন বুমরার হাতে। মাত্র ১৫১ রানে গুটিয়ে যায় অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংস। ২৯২ রানে এগিয়ে থাকলেও খারাপ হতে থাকা পিচে চতুর্থ ইনিংসে ব্যাট করার ঝুঁকি রাখবেন না বলে ফলো-অন করাননি কোহালি। আর দ্বিতীয় ইনিংসে ভারত ব্যাট করতে নামতেই পাল্টা প্রত্যাঘাত করেন প্যাট কামিন্স। দিনের শেষে ভারত ৫৪-৫। কোহালি, পূজারা, রোহিত, রাহানে, সবাই ফিরে গিয়েছেন। ক্রিজে মায়াঙ্ক আগরওয়াল (২৮) এবং ঋষভ পন্থ (৬)। কামিন্স ছয় ওভারে ১০ রান দিয়ে একাই নিয়েছেন চার উইকেট। ভারত এগিয়ে ৩৪৬ রানে। মনে করা হচ্ছে, ৪০০ রানের ‘লিড’ নিতে চাইছেন কোহালিরা। কিন্তু আবহাওয়ার পূর্বাভাসও মাথায় রাখতে বলছেন স্থানীয়েরা। শনি এবং রবিবারে ৬০-৭০ শতাংশ বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে।

আরও পড়ুন: এক্সপ্রেস গতি ও সুইংয়েই বাজিমাত

‘গাইডেড টুর’ ধরে চলে আসা যাক আইপিএল গ্রহে তাঁর ঢুকে পড়ার নাটকীয় বাঁকে। ঘরোয়া ক্রিকেটের ম্যাচ দেখতে জন রাইটের ছুটে যাওয়া। সৌরভের টিম ইন্ডিয়ার কোচ তখন মুম্বই ইন্ডিয়ান্স কোচ এবং স্পটার হিসেবে এসেছেন। ম্যাচ দেখতে বসে হতবাক রাইট। ভারতীয় লাসিথ মালিঙ্গা দেখছেন না কি? তখনই বুমরার গতি এবং বাউন্স দেখে মুগ্ধ রাইট। একটা বল এমন দ্রুতগতিতে লাফাল যে, উইকেটকিপারের মাথার উপর দিয়ে গিয়ে সোজা বাই চার হয়ে গেল। সেই ম্যাচে বুমরার উইকেটকিপার ছিলেন পার্থিব পটেল। ভারতীয় দলে আগে খেলেছেন বলে রাইট চিনতেন তাঁকে। দিনের খেলা শেষেই পার্থিবের কাছে ছুটলেন তিনি। জানতে চাইলেন, ছেলেটা কে? পার্থিব তাঁকে বললেন, ওর নাম বুমরা। অসামান্য প্রতিভা।

শোনা যায়, লিয়োনেল মেসিকে লা মাসিয়া অ্যাকাডেমিতে সই করানো নিয়ে এতটাই তাড়াহুড়ো ছিল যে, রেস্তরাঁয় বসে কথাবার্তা বলতে বসে কর্তাদের খেয়ালই ছিল না যে, কাগজপত্র সঙ্গে আনেননি। অথচ, দেরি করাও যাবে না। যদি এমন অমূল্য পাখি অন্য কোনও ক্লাবে উড়ে যায়। তাই তড়িঘড়ি রেস্তরাঁর ন্যাপকিন পেপারেই চুক্তি সই হয় মেসি এবং লা মাসিয়ার। বুমরার মুম্বই ইন্ডিয়ান্সে যোগ দেওয়ার কাহিনিও অনেকটা সে রকমই। সেই সন্ধেতেই মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের প্রতিনিধি হিসেবে আসা জন রাইট এবং প্রাক্তন ক্রিকেটার রাহুল সঙ্ঘভি মিলে কর্তাদের সঙ্গে কথা বলে সই করিয়ে নেন নতুন পেস প্রতিভাকে। মুম্বই ইন্ডিয়ান্সে এসে এক দিকে তিনি পান সচিন তেন্ডুলকর, রিকি পন্টিংয়ের মতো মহাতারকাদের। অন্য দিকে তাঁর আদর্শ লাসিথ মালিঙ্গাকে। শ্রীলঙ্কার পেস তারকার মতোই অন্যরকম বোলিং অ্যাকশন বুমরার। ইয়র্কার শেখার ব্যাপারে অনেক সাহায্যও পেয়েছেন মালিঙ্গার থেকে। আইপিএলের প্রথম ম্যাচে স্নায়ুর চাপে ভুগলেও তিন উইকেট নিয়ে দারুণ শুরু করেন বুমরা। রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের বিরুদ্ধে ৩২ রানে তিন উইকেটের মধ্যে একটি শিকারের নাম বিরাট কোহালি। তাঁর এখনকার ভারত অধিনায়ক এবং এ দিন ছয় উইকেট নেওয়ার পরে যিনি টুপি খুলে সেলাম জানালেন তাঁকে।

বুমরা পরে অবশ্য বলে গেলেন, রোহিত শর্মা তাঁকে বুদ্ধিটা দেন। উইকেট পড়ছে না দেখে তাঁকে বলেন, স্লোয়ার ইয়র্কার দিয়ে দ্যাখ কী হয়। দুর্দান্ত রিভার্স সুইংও করালেন তিনি। ‘‘ভারতে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলতে গিয়েই আমি রিভার্স সুইং শিখেছি। এই পিচে গতি খুব একটা নেই বলে রিভার্স খুব কাজে দিচ্ছে।’’ যদিও শুধু ইয়র্কার নয়, বুমরার হাতে এখন নানা অস্ত্র রয়েছে। ১৫.৫ ওভারে মাত্র ৩৩ রান দিয়ে ছয় উইকেট নিলেন তিনি। উপমহাদেশে তিনিই একমাত্র বোলার, যাঁর দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া— তিনটি দেশেই একই বছরে ইনিংসে পাঁচ উইকেট রয়েছে। সব চেয়ে দেখার মতো ব্যাপার হচ্ছে, বাউন্সার, ইয়র্কার, স্লোয়ার— সব ধরনের ডেলিভারিতে উইকেট তুলছেন তিনি। এ দিন লাঞ্চের ঠিক আগে উইকেট পেলেন স্লোয়ারে। সচরাচর যেটা টেস্ট ক্রিকেটে দেখা যায় না, সীমিত ওভারেই বেশি ব্যবহৃত হয়।

শুধু সীমিত ওভারের বোলার হিসেবে একটা ছাপ্পাই পড়ে গিয়েছিল তাঁর উপরে। টেস্টে তাঁকে খেলানোর পিছনে মস্তিষ্ক হেড কোচ রবি শাস্ত্রী এবং বোলিং কোচ বি অরুণ। দক্ষিণ আফ্রিকার বাউন্সি পিচে বুমরা দারুণ কাজে আসতে পারেন বলে তাঁরাই প্রথম ভাবেন। দ্রুত তাঁকে বেঙ্গালুরুর জাতীয় অ্যাকাডেমিতে স্ট্রেংথ কন্ডিশনিং করতে পাঠানো হয়। বুমরাকে যখন দক্ষিণ আফ্রিকাতে প্রথম টেস্ট খেলানো হচ্ছে, তখনও ভারতীয় মিডিয়া শাস্ত্রী-কোহালি জুটিকে আক্রমণ করে চলেছে। বলে চলেছে, সাদা বলের বোলারকে টেস্ট খেলানো হচ্ছে, অথচ ভুবনেশ্বর কুমারকে বসিয়ে দেওয়া হল! বুমরা সব পণ্ডিতদের ভুল এবং শাস্ত্রী-কোহালিদের সঠিক প্রমাণ করে দিয়েছেন। চলতি বছরে ন’টি টেস্টে ৪৫ উইকেট হয়ে গিয়েছে তাঁর। দেখার মতো হচ্ছে, ভারতের সাফল্যে তাঁর অবদান। জোহানেসবার্গে পাঁচ উইকেট পেয়েছিলেন বুমরা। টেস্ট জেতে ভারত। ট্রেন্ট ব্রিজে পাঁচ উইকেট নেন। ভারত জেতে। মেলবোর্নে ছয় উইকেট। এখানেও জেতার মতো মঞ্চ তৈরি।

ভারতীয় ক্রিকেটে কিং কোহালির পরেই সব চেয়ে জনপ্রিয় ধ্বনি এখন— বুম বুম বুমরা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE