Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

জীবনযুদ্ধে জয়ী ত্রয়ীর হাতে তৈরি বিজয়মঞ্চ

কে জানত, সিডনির সময় দুপুরবেলা থেকে মুম্বই নয়, আলোচনা ঘুরে যাবে দিল্লিতে।

উচ্ছ্বাস: সিডনিতে সেঞ্চুরির পরে ঋষভ। শুক্রবার। ছবি: এএফপি

উচ্ছ্বাস: সিডনিতে সেঞ্চুরির পরে ঋষভ। শুক্রবার। ছবি: এএফপি

সুমিত ঘোষ
সিডনি শেষ আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০১৯ ০৩:৩৫
Share: Save:

মুম্বইয়ের সেই ঘুপচি ঘরটা খুঁজে বের করার হিড়িক পড়ে গিয়েছিল সকালে।

যেখানে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে পেয়িং গেস্ট হিসেবে উঠেছিলেন অরবিন্দ পূজারা। মুম্বইয়ের গনগনে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ক্রিকেটের আঁচে ছেলেকে বড় করতে চান। অথচ, পকেটে অত পয়সা নেই যে, দিনের পর দিন মুম্বইয়ের মতো খরুচে শহরের কেন্দ্রে বসবাস করে জীবন চালাতে পারবেন। অগত্যা শহর থেকে দূরে ঘুপচিতে গিয়ে উঠতে হয়। সহায় বলতে অরবিন্দের বন্ধু প্রাক্তন অলরাউন্ডার কারসন ঘাউড়ি। শোনা যায়, রান্নাবান্না থেকে শুরু করে জামাকাপড় ধোয়া, সব কিছুই করতে হত অরবিন্দ পূজারাকে। ফল? ছেলের চে পূজারা হয়ে টেস্ট ক্রিকেটকে আলোকিত করা। মাত্র ৭ রানের জন্য ডাবল সেঞ্চুরি হাতছাড়া করে যখন মাঠ ছাড়ছিলেন পূজারা, তখন অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক টিম পেনকেও দেখা গেল এগিয়ে এসে সান্ত্বনা দিতে।

কে জানত, সিডনির সময় দুপুরবেলা থেকে মুম্বই নয়, আলোচনা ঘুরে যাবে দিল্লিতে। সচিনের শহরের ঘুপচি ছেড়ে তল্লাশি শুরু হয়ে যাবে, রাজধানীর সেই গুরুদ্বারটা কোথায়? যেখানে ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে সংগ্রামের চাদর গায়ে দিয়ে রাতে ঘুমোতেন ঋষভ পন্থ! সেই পার্কটা কোথায়, গুরুদ্বারে যেতে না পেরে যেখানকার বেঞ্চে শুয়ে রাত কাটিয়েছিলেন সিডনিতে দেড়শো করে ক্রিকেট বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেওয়া নতুন তারা!

পূজারার সঙ্গী ছিলেন বাবা। ঋষভের মা। স্বপ্নের কোনও লিঙ্গ বাছবিচার হয় না। হরিদ্বারের রুরকিতে থাকতেন ঋষভরা। সেখান থেকে দিল্লিতে তারক সিনহার কোচিং ক্যাম্পে আসতে হত। ভোর তিনটের সময় বাসে চেপে ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন সরোজ পন্থ। অনেক রাত না ঘুমিয়ে জেগেই বসে থাকতেন। পাছে ছেলের প্রথম বাস মিস হয়ে যায়। যদি ক্রিকেটার হওয়ার দৌড়ে পিছিয়ে পড়ে ছেলে!

শুক্রবার সিডনির মাঠে যখন মিচেল স্টার্ক, প্যাট কামিন্সরা একের পর এক বাউন্সার নিক্ষেপ করছিলেন, তখন মনে হচ্ছিল, এ সব কোনও চ্যালেঞ্জই নয় ঋষভের কাছে। এর চেয়ে অনেক ভয়ঙ্কর সব ডেলিভারি তিনি জীবনের বাইশ গজে খেলে এত দূর এসেছেন।

তিনি যখন রান নেওয়ার জন্য বাইশ গজের মধ্যে প্রাণপণে ছুটছেন, মনে পড়ে যাচ্ছিল অন্য দৌড়ের কথা। রুরকি থেকে দিল্লির বাস ধরার জন্য রাত থাকতে বেরিয়ে পড়তেন মা ও ছেলে। বেশির ভাগ সময়েই মা দেখতেন, বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত যাওয়ার কোনও যানবাহন নেই। রুরকির বাড়ি থেকে মা-ছেলে দৌড়ে বাস স্টপে পৌঁছতেন। ক্রিকেট এক বলের খেলা— এটা জেনে বুক কাঁপেনি ঋষভের। তিনি তো দেখে অভ্যস্ত যে, জীবন মাত্র এক বাসের দৌড়। সেটা মিস হয়ে যাওয়া মানে সে দিনের মতো স্টাম্প ছিটকে গেল। সেই কারণেই হয়তো ক্রিজে এত ডাকাবুকো। কাউকে ভয় পান না। এ দিন ঘণ্টায় ১৪০ কিলোমিটার গতিতে বল করা জশ হেজ্‌লউডকে হাত ঘুরিয়ে সুইচ হিট মারতে গেলেন। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে এই প্রথম কোনও ভারতীয় উইকেটকিপার হিসেবে প্রথম সেঞ্চুরি পেলেন ঋষভ। সেটা এক দিন না এক দিন কেউ করতেনই। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় এসে তাদের পেসারকে সুইচ হিট মারতে যাওয়ার মতো দুঃসাহস দেখানোর কথা কেউ দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি।

যা দেখে রিকি পন্টিং ভবিষ্যদ্বাণী করে দিলেন, ‘‘আমার মনে হয় বিশ্ব ক্রিকেট দ্বিতীয় অ্যাডাম গিলক্রিস্টকে পেতে চলেছে। দিল্লি ডেয়ারডেভিলসে ঋষভের কোচ পন্টিং কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট বোর্ডের ওয়েবসাইটকে তিনি বলেছেন, ‘‘দুর্দান্ত হিটার। মাত্র একুশ বছর বয়স। সমস্ত ফর্ম্যাটেই প্রচুর ক্রিকেট খেলবে ও।’’

মাত্র নবম টেস্টেই দ্বিতীয় সেঞ্চুরি করে ফেলেছেন পন্থ। এবং, দু’টোই উপমহাদেশের বাইরে। একটা ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ওভালে, অন্যটি অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সিডনিতে। দু’টোই বিশ্বমানের বোলিং আক্রমণের বিরুদ্ধে করা। ধোনির যোগ্য উত্তরসূরি বলা হচ্ছে তাঁকে। কিন্তু পন্টিং বলে দিচ্ছেন, ধোনির ছ’টা টেস্ট সেঞ্চুরিকে ছাপিয়ে যাবেন ঋষভ। ‘‘কোহালির মতোই সব সময় জেতার কথা ভাবে ঋষভ। এই মানসকিতাটা ওকে অনেক দূর নিয়ে যাবে,’’ বলছেন পন্টিং।

যাঁর সঙ্গে তিনি পন্থের তুলনা করা শুরু করলেন সেই অ্যাডাম গিলক্রিস্টও উচ্ছ্বসিত। কমেন্ট্রি করার সময় বলে দিলেন, পন্থের ব্যাটিং দেখতে অবশ্যই তিনি পয়সা দিয়ে টিকিট কেটে আসবেন। দিল্লির তরুণ এমনিতে আরও ঝোড়ো ব্যাটিং করেন। এ দিন হাফ সেঞ্চুরি পূরণ করলেন ৮৫ বলে। শুরুতে সতর্ক থাকার কারণ সকালে তাঁকে আলাদা করে ডেকে হেড কোচ রবি শাস্ত্রী বলেছিলেন, প্রথম দিকটায় দেখে দেখে খেলো। ক্রিজে এক বার থিতু হয়ে যেতে পারলে দেখবে সেঞ্চুরি অপেক্ষা করছে।

সকালে ভারতীয় দল যখন ওয়ার্ম আপ করছিল, তখন আর একটা অভিনব দৃশ্য দেখা গেল। পন্থকে বল ছুড়ে ছুড়ে ব্যাটিং প্র্যাক্টিস দিচ্ছিলেন কোহালি। অধিনায়ক বল ছুড়ে ছুড়ে তরুণ ব্যাটসম্যানকে তৈরি করছেন, এমন দৃশ্য সচরাচর ভারতীয় ক্রিকেটে দেখা যায়নি। পন্থ কোচ এবং অধিনায়কের আস্থার মর্যাদা দিয়েছেন। ১৮৯ বলে ১৫৯ দেখে অনেকের মনে হতে শুরু করেছে, ভারতীয় টেস্ট দলে উইকেটকিপারের জায়গা তালা বন্ধ করে দিলেন তিনি। বিশ্বকাপে যদি ধোনি উইকেটকিপার হিসেবে যান, বিশেষজ্ঞ ব্যাটসম্যানের ভূমিকায় পন্থকে না দেখতে পেলে অবাকই হতে হবে। এর পরেও বলতে হচ্ছে, ১৫৯ রানের ইনিংসে মারা পনেরোটি চার বা একটি ছয় নয়, পন্থ আসল স্ট্রোকটা নিলেন দিনের খেলা শেষে। যখন তিনি ফাঁস করলেন, এ দিনই মায়ের জন্মদিন ছিল আর এই ইনিংসটা মাকেই উৎসর্গ করছেন। রুরকি থেকে দিল্লি যাত্রাপথটা নিশ্চয়ই মা ও ছেলেকে আবেগরুদ্ধ করে রেখেছিল।

মাকে হারানো পূজারা। বাবাকে হারানো পন্থ। মাকে হারানো রবীন্দ্র জাডেজা। বাবা সামান্য ওয়াচম্যানের চাকরি করে ছেলেকে বড় করে তুলেছেন। মায়ের মৃত্যুতে এতটাই ভেঙে পড়েছিলেন জাডেজা যে, ক্রিকেট খেলাই ছেড়ে দেবেন ভেবেছিলেন। সিডনির মাঠে হাফ সেঞ্চুরি করে তাঁর তরবারি চালনা দেখে মনে হবে যেন, জীবনের রাস্তায় সব বাধাবিঘ্ন, ঝড়ঝাপ্টা পেরিয়ে এগিয়ে চলেছেন এক ঘোড়সওয়ার। ১১৪ বলে ৮১। সাতটি বাউন্ডারি, একটি ওভার বাউন্ডারি। সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার সব চেয়ে সফল বোলার প্যাট কামিন্সের বাউন্সার একের পর এক হুক মেরে বাউন্ডারিতে ফেললেন তিনি। ঋষভের সঙ্গে সপ্তম উইকেটে যোগ করলেন ২০৪ রান। অবিশ্বাস্য সেই পার্টনারশিপের দমকা হাওয়ায় ভারত গিয়ে উঠল ৬২২-৭ স্কোরের উঁচু জমিতে। এখান থেকে টেস্ট হারার কোনও সম্ভাবনা নেই। ব্যাট করতে নেমে অস্ট্রেলিয়া দশ ওভারে ২৪-০। ঋষভ ক্যাচ না ফেললে শেষ বেলায় অস্ট্রেলিয়ার একটা উইকেট পড়েও যায়। তবু কার্যত নতুন বলে শনিবার সকালে বুম বুম বুমরাকে ফের খেলতে হবে অস্ট্রেলীয় ওপেনারদের।

প্রশ্ন এখন ৩-১ হবে না কি ২-১ থাকবে? কোহালিদের ইতিহাসের মঞ্চ তৈরি। কিন্তু ক্রিকেটীয় ফলাফলের চেয়েও বৃহত্তর হয়ে উঠেছে অসাধারণ সব জীবনকাহিনি। বিশেষ করে ভারতীয় ত্রয়ীর ব্যক্তিগত সংগ্রামের কাহিনি যেন ক্রিকেটের বাউন্ডারির ও পারে নিয়ে যাচ্ছে সিডনি টেস্টকে। এক-এক সময় মনে হচ্ছে, সিডনিতে স্কোরবোর্ডটাই ক্রিকেটের নয়, জীবনের!

স্কোরকার্ড
ভারত ৬২২-৭ ডি. (১৬৭.২ ওভার)
অস্ট্রেলিয়া ২৪-০ (১০ ওভার)


ভারত (আগের দিনের ৩০৩-৪ এর পর প্রথম ইনিংস)
চেতেশ্বর পূজারা ক ও বো লায়ন ১৯৩
হনুমা ক লাবুশানে বো লায়ন ৪২
ঋষভ পন্থ ন. আ ১৫৯
রবীন্দ্র জাডেজা ব লায়ন ৮১
অতিরিক্ত ২০
মোট ৬২২-৭
পতন: ৫-৩২৯ (হনুমা, ১০১.৬), ৬-৪১৮ (পূজারা, ১২৯.৬), ৭-৬২২ (জাডেজা, ১৬৭.২)।
বোলিং: মিচেল স্টার্ক ২৬-০-১২৩-১, জশ হেজলউড ৩৫-১১-১০৫-২, প্যাট কামিন্স ২৮-৫-১০১-০, নেথান লায়ন ৫৭.২-৮-১৭৮-৪, মার্নাস লাবুশানে ১৬-০-৭৬-০, ট্র্যাভিস হেড ৪-০-২০-০, উসমান খোয়াজা ১-০-৪-০।

অস্ট্রেলিয়া (প্রথম ইনিংস)
মার্কাস হ্যারিস ব্যাটিং ১৯
উসমান খোয়াজা ব্যাটিং ৫
অতিরিক্ত ০
মোট ২৪-০
বোলিং: মহম্মদ শামি ৩-০-৯-০, যশপ্রীত বুমরা ৩-০-১২-০, রবীন্দ্র জাডেজা ২-১-১-০, কুলদীপ যাদব ২-১-২-০।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE