প্রায় ছ’বছর পরে আবার সেঞ্চুরি। বৃহস্পতিবার কটকে।
যুবরাজ সিংহের অসাধারণ ইনিংসটা দেখতে দেখতে আচমকা গত সেপ্টেম্বরের এক বিকেল মনে পড়ে গেল।
দলীপ ট্রফির ম্যাচ। কার বিরুদ্ধে খেলছিল যুবরাজ, এখন ঠিক মনে পড়ছে না। যা-ই হোক, ম্যাচটায় আমি কমেন্ট্রি করছিলাম। দিনের খেলা শেষে যুবরাজের সঙ্গে দেখা। সাধারণ টুকটাক কথাবার্তা থেকে শেষ পর্যন্ত আড্ডায় ঢুকে পড়েছিলাম আমরা।
মনে আছে, সে দিন একটা জিনিস ওর মধ্যে দেখে খুব ভাল লেগেছিল। আমাদের, মানে ক্রিকেটারদের একটা শান্ত মন নিয়ে চলাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বলতে চাইছি, টিম থেকে আমরা যখন বাদ পড়ি, আমাদের সব কিছু পাল্টে যায়। সেরা হোটেল অপেক্ষা করে না থাকার জন্য। টিম বাস অত ভাল হয় না। সবচেয়ে বড় কথা, হাউসফুল গ্যালারির জায়গায় আমাদের তখন অভ্যর্থনা জানায় ফাঁকা মাঠ, সব সময় মনে হতে থাকে সবাই আমার বিপক্ষে। আমার বিরুদ্ধে প্রত্যেকে ষড়যন্ত্র করছে। কোনও দিনই আমাকে আর টিমে নেবে না।
যুবরাজের মধ্যে সে দিন যে ব্যাপারগুলো দেখিনি। মনে আছে, খুব হাল্কা ছিল। ঠাট্টা-ইয়ার্কি মারছিল। বুঝতে পারছিলাম, এই যুবরাজ জাতীয় দলে কামব্যাক করতে চায়। এই যুবরাজ বিশ্বাস করে যে, সে পারবে। কিন্তু এই যুবরাজ জাতীয় দলে ফেরাটাকে আর জীবন-মৃত্যু হিসেবে ধরে না। বরং এই যুবরাজ জানে যে, না ফিরলেও তার জীবন ধ্বংস হয়ে যাবে না। তার পরেও সে বেঁচে থাকবে।
বৃহস্পতিবারের যুবরাজকে মনে করুন এক বার। সেঞ্চুরি করে একটু আবেগ দেখিয়েছে ঠিকই। কিন্তু বিশেষ নয়। দেড়শো করার পর তো দেখে মনেই হল না, নিজের কেরিয়ারের সর্বোচ্চ রানটা করে ফেলেছে ও। আসলে ওই যে বললাম। যুবরাজ এখন আর টিমে কামব্যাককে জীবন-মৃত্যু মনে করে না। মনের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা ও জিতে ফেলেছে। যা হবে দেখা যাবে, এ রকম একটা ভাবনা মনে হয় ওর ক্রিকেট-চেতনায় ঢুকে পড়েছে।
নায়কের সঙ্গে অধিনায়ক। বৃহস্পতিবার বরাবাটিতে।
এক-এক সময় ভাবলে আশ্চর্যই লাগছে। ছ’টা বছর! প্রায় ছ’টা বছর কি না লেগে গেল যুবির একটা সেঞ্চুরি পেতে। আজকের আগে শেষ সেঞ্চুরিটা ও করেছিল ২০১১ বিশ্বকাপে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে। পরের ছ’বছরে যে ভাবে জীবনকে দেখেছে যুবি, বোধ হয় আর কেউ দেখেনি। শরীরের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে। লড়তে হয়েছে ক্রিকেট-কেরিয়ারের বিরুদ্ধেও। প্রচুর লোকে তো বারবার প্রশ্ন তুলেছে, ও এখনও কেন খেলবে? এই ইংল্যান্ড সিরিজের আগেও অনেকে বলেছিল, যুবরাজকে টিমে নিয়ে আদতে একটা ধাপ পিছিয়ে যাওয়া হল। কেউ আবার বলছে, বিরাটের সঙ্গে সম্পর্কটা ভাল। তাই টিমে ঢুকেছে!
এই অবস্থা থেকে কি না ১৫০ করে গেল! মাত্র ১২৭ বলে, ভারত ২৫-৩ হয়ে যাওয়ার পর। বিরাট কোহালি দ্রুত আউট হয়ে যাওয়ার পর। এমএস ধোনির কথায় অবশ্যই আসব। এমএস-ও দুর্দান্ত খেলেছে। কিন্তু এ দিনের বিচারে রোম্যান্টিকতায় ফুল মার্কসটা যুবিকেই দিতে হচ্ছে।
আসলে এ দিন কটকে না পারলে লোকে বিরাটের দিকেও আঙুল তুলত। প্রশ্ন তুলত, ‘‘কোন যুক্তিতে যুবরাজকে টিমে নিলে তুমি?’’ আমার সবচেয়ে ভাল লাগছে এটা ভেবে যে, যুবরাজের ইনিংসটা কষ্টেসৃষ্টে করা নয়। একদম ভিন্টেজ যুবরাজ স্টাইলের। পনেরো বছর আগে ছিল যেমন।
সেই ব্যাট ফ্লো। সেই কভারের ওপর দিয়ে মসৃণ বল উড়িয়ে দেওয়া। সেই নিখুঁত টাইমিং। সেই স্ট্রোক প্লে।
এক কথায়, যা ট্রেডমার্ক যুবরাজ সিংহকে বোঝাত।
আমি তো বলব, যুবরাজের অন্যতম সেরা ইনিংসটা বৃহস্পতিবার দেখে নিলাম। আরও একটা জিনিস দেখে দারুণ লাগছে। টিম ম্যানেজমেন্টের ওকে নিয়ে মনোভাব। পুণের প্রথম ম্যাচে ও কিন্তু নিজের চেনা খেলাটাই খেলতে শুরু করেছিল। অর্থাৎ ওকে টিম ম্যানেজমেন্ট সেই স্বাধীনতাটা দিচ্ছে। দেখে মনে হল, ধোনিকেও দিচ্ছে।
এত দিন অনেকে বলাবলি করছিল যে, ধোনি এখন আর ক্যাপ্টেন নয়। তাই অনেক ঝরঝরে ভাবে খেলতে পারবে। আমি তা বিশ্বাস করি না। কোনও সিনিয়র ক্যাপ্টেন্সি ছেড়ে দিলে তার দায়িত্ব চলে যায় না। আর সেটা যে যায় না, এ দিনের ১৩৪ তার বড় প্রমাণ। আর খেলাটাও খুব পাল্টেছে কি? সেই প্রথম দিকে বল বেশি, রান কম। পরে রান বেশি, বল কম। হালফিলে ধোনি তো এ রকমই খেলছে। নেমে দুমদাম মারছে না। বরং ক্রিজে সময় নিচ্ছে। শেষে মারছে। এ দিন প্রথম ২০ রান করতে গোটা চল্লিশেক বল নিল। কিন্তু শেষে ১২২ বলে ১৩৪।
ইংল্যান্ড প্রবল চেষ্টা করেছিল, ধোনি-যুবরাজের পার্টনারশিপকে ভাঙতে। পারেনি। বরং ২৫৬ রানের পার্টনারশিপ হয়েছে। ইংল্যান্ড প্রবল চেষ্টা করেছিল, ভারতের বিশাল ৩৮১ তাড়া করতে। পারেনি সেটাও। ইয়ন মর্গ্যানের সেঞ্চুরি সত্ত্বেও ১৫ রানে হেরে সিরিজটাই হারতে হয়েছে। কিন্তু নিছক ওয়ান ডে সিরিজ জয় হিসেবে টুর্নামেন্টটাকে দেখলে হবে না। দেখতে হবে, আগামী জুনের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির মহড়া হিসেবে। যেখানে লেটার মার্কস নিয়ে বেরিয়ে গেল কোহালির ভারত। প্রমাণ হয়ে গেল, এমএস ধোনি তো বটেই, এই টিমে আজও একটা যুবরাজ সিংহের প্রয়োজন আছে। তা সে যতই দু’জনের মিলিত বয়স সত্তর হোক। যতই নতুন রক্ত আসুক টিমে।
ভারত ২৫-৩ হয়ে গেলে অভিজ্ঞতা ছাড়া আর বাঁচাবে কে?
ভারত
লোকেশ ক স্টোকস বো ওকস ৫
শিখর বো ওকস ১১
বিরাট ক স্টোকস বো ওকস ৮
যুবরাজ ক বাটলার বো ওকস ১৫০
ধোনি ক উইলি বো প্লাঙ্কেট ১৩৪
কেদার ক বল বো প্লাঙ্কেট ২২
হার্দিক ন.আ. ১৯
জাডেজা ন.আ. ১৬
অতিরিক্ত ১৬
মোট (৫০ ওভারে) ৩৮১-৬
পতন: ১৪, ২২, ২৫, ২৮১, ৩২৩, ৩৫৮
বোলিং: ওকস ১০-৩-৬০-৪, উইলি ৫-০-৩২-০, বল ১০-০-৮০-০,
প্লাঙ্কেট ১০-১-৯১-২, স্টোকস ৯-০-৭৯-০, মইন ৬-০-৩৩-০।
ইংল্যান্ড
রয় বো জাডেজা ৮২
হেলস ক ধোনি বো বুমরাহ ১৪
রুট ক বিরাট বো অশ্বিন ৫৪
মর্গ্যান রান আউট ১০২
স্টোকস বো অশ্বিন ১
বাটলার স্টাঃ ধোনি বো অশ্বিন ১০
মইন বো ভুবনেশ্বর ৫৫
ওকস বো বুমরাহ ৫
প্লাঙ্কেট ন.আ. ২৬
উইলি ন.আ. ৫
অতিরিক্ত ১২,
মোট (৫০ ওভারে) ৩৬৬-৮
পতন: ২৮, ১২৮, ১৭০, ১৭৩, ২০৬, ২৯৯, ৩০৪, ৩৫৪।
বোলিং: ভুবনেশ্বর ১০-১-৬৩-১, বুমরাহ ৯-০-৮১-২,
জাডেজা ১০-০-৪৫-১, হার্দিক ৬-০-৬০-০, অশ্বিন ১০-০-৬৫-৩, কেদার ৫-০-৪৫-০।
ছবি: পিটিআই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy