Advertisement
০৫ মে ২০২৪
Renuka Singh Thakur

Renuka Singh Thakur: রেণুকাই ‘সিংহ’! তিন বছরে বাবাকে হারানো, ১৩ বছরে ঘর ছাড়া বোলার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন ভারতকে

ভারত হারলেও অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে নজর কেড়ে নিয়েছে রেণুকা সিংহের পারফরম্যান্স। কী ভাবে ভারতীয় দলে উঠে এলেন তিনি।

রেণুকা সিংহ ঠাকুর।

রেণুকা সিংহ ঠাকুর। ছবি রয়টার্স

নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০২২ ১৪:২৬
Share: Save:

কমনওয়েলথ গেমসের প্রথম ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করেও হারতে হয়েছে ভারতকে। হরমনপ্রীত কৌরের দল হেরেছে তিন উইকেটে। তার মধ্যেও উজ্জ্বল রেণুকা সিংহ ঠাকুর। চার উইকেট নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার টপ অর্ডারকে একাই কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। পরের দিকে তাঁর ওভার না থাকার ফল ভুগতে হয় ভারতকে। দল হারলেও রেণুকার পারফরম্যান্স নিঃসন্দেহে আলাদা করে নজর কেড়ে নিয়েছে।

রেণুকাকে যাঁরা কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁরা জানেন কতটা কষ্ট করে উঠে এসেছেন এই মহিলা ক্রিকেটার। ভারতের আর পাঁচ জন মহিলা ক্রিকেটারকে যে ভাবে বহু বাধা পেরিয়ে ক্রিকেটকে বেছে নিতে হয়েছে, রেণুকার জীবনকাহিনিও তার থেকে কম নয়। মাত্র তিন বছর বয়সে বাবা কেহর সিংহকে হারান রেণুকা। বাবার স্মৃতিও আবছা। এখন আর ভাল করে মুখও মনে নেই। ক্রিকেটের জন্য ঘর ছাড়তে হয় ১৩ বছর বয়সে। ঘরোয়া ক্রিকেটে ভাল খেলে ভারতীয় দলের দরজায় কড়া নেড়েও বার বার হতাশ হতে হয়েছে। সব পেরিয়ে অবশেষে সফল হয়েছেন রেণুকা। পূরণ করতে পেরেছেন নিজের স্বপ্ন।

হিমাচল প্রদেশের রোহরু জেলার পারসা গ্রামে জন্ম রেণুকার। বাবা কেহর ক্রিকেটের অন্ধ ভক্ত ছিলেন। এতটাই যে, নিজের ছেলের নাম রেখেছিলেন বিনোদ কাম্বলির নামানুসারে। কেহরের জন্যেই বাড়িতে ক্রিকেটীয় আলোচনা এবং খেলাধুলোর পরিবেশ ছিল। স্কুলে পড়ার সময়েই ক্রিকেটের সঙ্গে প্রথম পরিচয় রেণুকার। দুপুরে স্থানীয় ছেলেরা টেনিস বলে ক্রিকেট খেলার সময় সে-ও যোগ দিত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্রিকেট খেলতে খেলতেই এক সময় খেলাটার প্রেমে পড়ে যায় ছোট্ট রেণুকা।

বাবা মারা যাওয়ায় রেণুকার ক্রিকেটকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রথমে কাউকে পাওয়া যায়নি। তখন এগিয়ে আসেন কাকা ভূপিন্দর সিংহ ঠাকুর। তাঁর উদ্যোগেই রেণুকাকে পাঠানো হয় ধরমশালায়। হিমাচল প্রদেশ ক্রিকেট সংস্থায় মহিলাদের জন্য যে আবাসিক অ্যাকাডেমি ছিল, সেখানে ভর্তি করে দেওয়া হয় রেণুকাকে।

দীপ্তির সঙ্গে উচ্ছ্বাস রেণুকার।

দীপ্তির সঙ্গে উচ্ছ্বাস রেণুকার। ছবি রয়টার্স

মাত্র ১৩ বছর বয়সে বাড়ি ছেড়ে থাকা খুব একটা সহজ কাজ ছিল না। তবে ছোটবেলা থেকেই রেণুকার ক্রিকেটপ্রেম এতটাই বেশি ছিল যে, দূরে থেকেও মন কাঁদেনি। ডেল স্টেনকে পছন্দ করতেন। মাঠেও পছন্দের ক্রিকেটারকে অনুকরণ করার চেষ্টা চলত। শুক্রবার অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে তাঁর পারফরম্যান্সে কেউ কেউ দেখতে পেয়েছেন স্টেনের ছায়াও। বিপক্ষকে শুরুতেই যে রকম গুঁড়িয়ে দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে নামতেন স্টেন, সেই আগ্রাসন দেখা গিয়েছে রেণুকার বোলিংয়েও। অস্ট্রেলিয়ার টপ অর্ডার যে কোনও দলকে চাপে ফেলার জন্য যথেষ্ট। কে নেই সেখানে? অ্যালিসা হিলি, বেথ মুনি, মেগ ল্যানিং! প্রত্যেককে আউট করেছেন রেণুকা। উইকেট পাওয়ার পর দু’হাত মেলে দৌড় অনেক ক্রিকেটপ্রেমীর মনে ইতিমধ্যেই জায়গা করে নিয়েছে।

দীর্ঘ দিন ধরে রেণুকাকে দেখেছেন ভারতের ক্রিকেটার সুষমা বর্মা। তিনি এক ওয়েবসাইটে বলেছেন, “মহিলাদের আবাসিক অ্যাকাডেমিতে আমরাই প্রথম ব্যাচ ছিলাম। ২০০৯ থেকে ওকে চিনি। প্রথম থেকেই জোরে বোলার হতে চাইত। অবশেষে স্বপ্নপূরণ করতে পেরেছে দেখে খুব ভাল লাগছে। যখন অ্যাকাডেমিতে আসে, তখন ওর বয়সই বোধহয় সবচেয়ে কম ছিল। অত কম বয়সে পরিবারকে ছেড়ে থাকা সোজা ছিল না। তবে দ্রুত ও মানিয়ে নিয়েছিল। সারা ক্ষণ আমরা একসঙ্গে থাকতাম। ওকে দেখতাম ক্রিকেট নিয়েই পড়ে থাকতে।”

রেণুকাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন পবন সেন। তিনি ছাত্রীর দক্ষতার উপরে জোর দিতেন। তবে সুষমা মনে করেন, রেণুকার উন্নতির পিছনে রয়েছেন তৎকালীন সতীর্থ অনীশা আনসারিও। দু’জনের বোলিং জুটি এতটাই ক্ষুরধার ছিল যে, কে কোথায় ভুল করছেন সেটা সহজেই বোঝা যেত। সুষমা বলেছেন, “অ্যাকাডেমিতে প্রথম ছ’মাস টেনিস বলে খেলত রেণুকা। পরের দিকে চামড়ার বলে খেলা শুরু করে। সেই সময় অনীশা এবং রেণুকা জুটি বেঁধে বল করত। পরিসংখ্যানে দেখা যাবে, সে সময় সবচেয়ে কম রান দেওয়ার নজির ছিল অনীশার। এক দিক থেকে ও চাপ দিত, অপর দিক থেকে রেণুকা উইকেট নিত। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে যে রেণুকাকে দেখলেন, তাঁকে আমরা হিমাচল প্রদেশ অ্যাকাডেমিতে আগে বহু বার দেখেছি।”

ঘরোয়া ক্রিকেটে ২০১৮-১৯ মরসুমে ২১টি উইকেট পেয়েছিলেন রেণুকা। চ্যালেঞ্জার ট্রফির দলে সুযোগ পান। এর পর ভারত ‘এ’ দলে। প্রতিটি জায়গাতেই তাঁর পারফরম্যান্স ছিল আকর্ষণীয়। ধীরে ধীরে জাতীয় দলের নির্বাচকদের নজরে পড়তে শুরু করেন তিনি। পরিবারকে চালানোর জন্য উত্তর রেলওয়েতে চাকরি নেন। সেই দলের হয়েও ঘরোয়া ক্রিকেটে ভাল পারফর্ম করতে থাকেন। মহিলাদের এক দিনের ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় পাঁচটি ম্যাচ ন’টি উইকেট নেন। গত বছর ভারতীয় দলে প্রথম বার সুযোগ মেলে। টি-টোয়েন্টিতে অভিষেক হয় অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে। এক দিনের ক্রিকেটে অভিষেক এ বছরই। নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ফেব্রুয়ারিতে। এখনও পর্যন্ত সাতটি টি-টোয়েন্টি খেলে সাতটি উইকেট নিয়েছেন। পাঁচটি এক দিনের ম্যাচে উইকেটের সংখ্যা ১০টি। ঝুলন গোস্বামী টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নেওয়ায় এবং শিখা পান্ডের ছন্দ খারাপ থাকায়, টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে এখন ভারতের প্রধান বোলার হয়ে উঠেছেন রেণুকাই। শুক্রবারের পারফরম্যান্স তাঁকে আরও কিছুটা প্রতিষ্ঠা দিল বলে মনে করছেন অনেকে।

কোচ পবন মনে করছেন, কঠোর পরিশ্রম এবং দায়বদ্ধতাই এই জায়গায় এনেছে রেণুকাকে। তাঁর কথায়, “ঘরোয়া ক্রিকেটে ভাল খেললেও ভারতীয় দলে ঢোকা ওর পক্ষে বেশ কঠিনই ছিল। মাঝেমাঝে হতাশ হয়ে পড়ত। তখন আমি ওকে চেতেশ্বর পুজারার উদাহরণ দিতাম। কী ভাবে নিজেকে উন্নত করে পুজারা ভারতীয় দলে জায়গা করে নিয়েছে, সে কথা বার বার বলতাম। এতে অনেকটা অনুপ্রাণিত হত।” পবনের সংযোজন, “বাবা মারা যাওয়ার পর ওর জীবনটা সহজ ছিল না। মা ভূমিখনন দফতরে চাকরি নেন। বেতন বেশি ছিল না। তবু তিনি দুই ছেলেমেয়েকেই ক্রিকেটে ভর্তি করতে চেয়েছিলেন। সেটা সম্ভব ছিল না। আমি বার বার রেণুকাকে বলতাম, তোর মা এত আত্মত্যাগ করেছে। এ বার তোকে বড় কিছু করে দেখাতে হবে।”

অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে হেরে গিয়ে স্বপ্ন হয়তো ভেঙেছে। তবে রেণুকা বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি এই দলে দাপট দেখাতেই এসেছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE