Advertisement
E-Paper

রাজনীতির আঁচ, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ভারত-পাক ম্যাচের উন্মাদনাকেও ছাপিয়ে যাচ্ছে ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচ

প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই ক্রিকেটের সঙ্গে রাজনীতি বা কূটনীতি মিশিয়ে দিয়েছিল ইংরেজরা। জেন্টলম্যান’স গেমকে মর্যাদার লড়াই হিসাবে দেখা হয়েছে বহু ক্ষেত্রে। ব্যতিক্রম নয় ভারতীয় উপমহাদেশও।

Picture of Cricket

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক

শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৯:৩৬
Share
Save

রাজনীতিকে ক্রিকেট থেকে দূরে রাখার দাবি ওঠে মাঝেমধ্যেই। তবু রাজনীতি বার বার জড়িয়ে পড়েছে ২২ গজের লড়াইয়ের সঙ্গে।

ব্যতিক্রম নয় ভারতীয় উপমহাদেশও। ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে দু’দেশের মানুষের উন্মাদনা তার প্রমাণ। মর্যাদার লড়াই হিসাবে দেখা হয় এই ম্যাচকে। ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার অ্যাশেজ় সিরিজ়ের উত্তেজনাকেও ছাপিয়ে যায় ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ। রাজনৈতিক কারণে সেই উত্তেজনা এখন অতীত। তবু বছরে এক-আধ বার দু’দেশ মুখোমুখি হলে আলাদা আবহ তৈরি হয়। সেই জায়গা এখন নিচ্ছে ভারত-বাংলাদেশ ম্যচ। কারণ বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে আগামী বৃহস্পতিবার দুই দেশ মুখোমুখি হবে। রবিবারের ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের থেকেও এই ম্যাচ নিয়ে উন্মাদনা বেশি।

গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কার ২২ গজের লড়াইও কম উত্তেজনা তৈরি করেনি। সেই উত্তেজনায় রাজনৈতিক উপাদান না থাকলেও দু’দেশের ক্রিকেটারদের লড়াই বাড়তি মাত্রা পেয়েছে বিভিন্ন কারণে। যা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল ২০২৩ সালের এক দিনের বিশ্বকাপে। শ্রীলঙ্কার অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুজ়কে ‘টাইমড আউট’ করেছিলেন বাংলাদেশের প্রাক্তন অধিনায়ক শাকিব আল হাসান। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ইতিহাসে সেটাই প্রথম এবং শেষ ‘টাইমড আউট’এর ঘটনা।

ক্রিকেটে রাজনীতির ইতিহাস

ইতিহাসের নথি অনুযায়ী প্রথম ক্রিকেট খেলা হয়েছিল ১৫৫০ সালে। তার পর ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে ক্রিকেট প্রথম পৌঁছেছিল ফ্রান্সে। কিন্তু ইংল্যান্ডে জন্ম নেওয়া খেলা গ্রহণ করেনি ফরাসিরা। দীর্ঘ দিন ইংল্যান্ডেই ‘গৃহবন্দি’ ছিল ক্রিকেট। ১৮ শতকে ক্রিকেটের প্রসারের জন্য ইংরেজরা নজর দেয় তাদের উপনিবেশগুলিতে। রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক প্রভাব বা নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এমন দেশগুলিতে ক্রিকেটকে ছড়িয়ে চেয়েছিল ইংরেজরা। ফলে ক্রিকেটের সঙ্গে রাজনীতি বা কূটনীতির সূক্ষ্ম যোগ তৈরি হয় প্রথম থেকেই। সেই সূত্রেই ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রেলিয়া- নিউ জ়িল্যান্ড, ভারত-পাকিস্তান লড়াইয়ে মিশে রয়েছে অলিখিত শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের তাগিদ।

উপমহাদেশের ক্রিকেটীয় লড়াই

খেলার মাঠে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলির সাফল্যের অনেকটাই ক্রিকেটকেন্দ্রিক। হকিতে ভারত, পাকিস্তানের রমরমার দিন অতীত। অন্য খেলাগুলিতেও সাফল্যের ইতিহাস দীর্ঘ এবং ধারাবাহিক নয়। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে লড়াই, উৎসাহ, উত্তেজনা, রেষারেষি।

Picture of Babar Azam and Rohit Sharma

(বাঁ দিকে) বাবর আজ়ম এবং রোহিত শর্মা (ডান দিকে)। — ফাইল চিত্র।

বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের একাংশ দাবি করেন, ভারত-পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক সিরিজ় বন্ধ হওয়ার পর ভারতীয় উপমহাদেশে এখন সবচেয়ে উন্মাদনাময় বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার লড়াই। এই দাবির পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত থাকতে পারে। বিতর্ক হতে পারে। কারণ ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেটের চরম উত্তেজনার সময়ও ‘টাইমড আউট’এর মতো ঘটনা ঘটেনি। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ক্রিকেট সম্পর্ক একটা সময় পর্যন্ত ছিল দাদা-ভাইয়ের মত। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিসিআই) প্রাক্তন সভাপতি জগমোহন ডালমিয়ার উদ্যোগে ২০০০ সালে টেস্ট খেলার মর্যাদা পায় বাংলাদেশ। তার পরও বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের ক্রিকেটের উন্নতিতে পাশে থেকেছে বিসিসিআই। গত কয়েক দশক ভারত-বাংলাদেশ ক্রিকেট আবহে মৈত্রী, সৌজন্যের অভাব হয়নি।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদল

পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করেছে কিছু দিন ধরে, গত অগস্টে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর থেকে। সাধারণ মানুষের বিদ্রোহের মুখে বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। আশ্রয় পেয়েছেন ভারতে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির আঁচ সীমান্ত পেরিয়ে এ দেশে এসেছে। হাসিনাকে ভারত রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশের মানুষের একাংশ ক্ষুব্ধ। হাসিনা সরকারের পতনের পরও অশান্তি, অসন্তোষের আবহ রয়েছে বাংলাদেশে। বিক্ষিপ্ত হিংসার ঘটনাও ঘটছে।

মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বধীন অন্তর্বর্তী সরকার এখনও সব কিছু স্বাভাবিক করতে পারেনি। ‌হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ায় ভারত- বিরোধী মনোভাব তৈরি হয়েছে সেখানকার কিছু মানুষের মধ্যে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারত-নির্ভরতা কমানোর কথা বলছেন তাঁরা। অন্য দিকে, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন নয়াদিল্লি। সে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সরাসরি মন্তব্য করা না হলেও নজর রাখা হচ্ছে। সে দেশের সংখ্যালঘুদের সমস্যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। সীমান্ত সুরক্ষিত করতে বিভিন্ন জায়গায় কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার কাজে গতি আনা হয়েছে। গত ছ’মাসে একাধিক বার দু’দেশ পরস্পরের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠিয়ে বার্তা দিয়েছে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ভারতের উপর চাপ তৈরির চেষ্টা করছে হাসিনাকে প্রত্যার্পণের জন্য। বাংলাদেশে সম্মিলিত সনাতন জাগরণ জোটের মুখপাত্র তথা ইসকনের পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময়কৃষ্ণ প্রভুর গ্রেফতারি নতুন মাত্রা যোগ করেছে সামাজিক যোগাযোগের স্তরে। হাসিনা-পরবর্তী সময় ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নতুন খাতে বইছে। ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের মতো রাজনীতির চড়া আঁচ নেই। জমি বিবাদ (সীমান্ত) নেই। কট্টর সন্ত্রাসবাদ নেই। যদিও আছে অনুপ্রবেশের মতো গুরুতর সমস্যা। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এখন রাজনীতির ঢিমে আঁচে। যা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশকে কাছে আনার চেষ্টা করছেন পাকিস্তানের রাজনীতিকদের একটা অংশ। লক্ষ্য, ভারতকে চাপে রাখা।

Picture of Sheikh Hasina and Narendra Modi

(বাঁ দিকে) শেখ হাসিনা এবং নরেন্দ্র মোদী (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।

মোদীর আমেরিকা সফর

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আমেরিকা সফর হতাশ করতে পারে বাংলাদেশকে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে বলেছেন, ‘‘দীর্ঘ দিন ধরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী এই সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করছেন। বহু বছর ধরে এই চেষ্টা চলছে। আমি এই সংক্রান্ত খবরাখবর পড়েছি। তবে বাংলাদেশের ব্যাপারটা আমি মোদীর উপরেই ছাড়তে চাই।’’

২২ গজই জবাবের মঞ্চ?

আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারি শুরু চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ একই গ্রুপে রয়েছে। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ নিয়ে পরিচিত উত্তেজনা রয়েছে। উত্তেজনার নতুন উপাদান ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচ। সীমান্তের দু’পারের কিছু মানুষের মধ্যে তৈরি হওয়া পারস্পরিক বিরোধিতার মনোভাব ইন্ধন যোগাচ্ছে। ও পারের যাঁরা হাসিনা জমানার ভারতপ্রীতি বা ভারত-নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছেন, তাঁরা চান নাজমুল হোসেন শান্তরা কড়া চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলুন রোহিত শর্মাদের। আবার এ পারের মানুষের একাংশের চাওয়া, ২২ গজই হোক জবাবের মঞ্চ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ তৈরি হওয়ার পর ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বা মানুষে-মানুষে সম্প্রীতি, বন্ধুত্ব, সৌভ্রাতৃত্বের আবহ এতটা অনিশ্চিত মনে হয়নি কখনও। দু’দেশের কিছু মানুষ গত কয়েক মাস ধরে ইন্ধন, প্ররোচনা দিয়ে চলেছেন। তাতে পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে।

আর্টারি-ওয়াঘা বা পেট্রাপোল-বেনাপোল সীমান্তের সৌহার্দের পরিবেশ আন্তর্জাতিক সীমান্তের বাকি অংশে নেই। ১৯৪৭ সালে এক দেশের দু’দিকে তৈরি হয়েছিল আন্তর্জাতিক সীমান্ত। বহু পরিবার ভাগ হয়ে গিয়েছিল। বহু মানুষকে ভিটে ছাড়তে হয়েছিল। দেশভাগের সেই ক্ষত আজও বিদ্যমান তিন দেশেই। তিন দেশের বহু নাগরিকের জন্ম, বেড়ে ওঠা অন্য দেশে। তাঁদের শৈশবের খেলার মাঠ, স্কুল, ছেলেবেলার বন্ধু বিদেশে। দেওয়াল তুলে দিয়েছে রাজনীতি।

Picture of India-Bangladesh Border

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত। —ফাইল চিত্র।

দক্ষিণ এশিয়ার তিন সহোদর দেশের সম্পর্কে রয়েছে নানা সমীকরণ। স্বার্থ-নৈকট্য, কৌশলী-দূরত্ব আছে। সে সবের মধ্যে বার বার এসে পড়েছে ক্রিকেট। ২২ গজের লড়াই হয়ে উঠেছে কূটনৈতিক কৌশলের অঙ্গ। ২০০৮ সালের পর ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে ফাঁক খুঁজে পায়নি ক্রিকেট বল। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের পরিস্থিতি তেমন না হলেও তৈরি হচ্ছে চেক পোস্ট। অবিশ্বাস। অসহিষ্ণুতা। কিছু ক্ষেত্রে অশ্রদ্ধাও।

এই পরিস্থিতিতে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচ ঘিরে অপরিচিত উন্মাদনা। বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার মধ্যে তৈরি হওয়া গত কয়েক বছরের নিরীহ ক্রিকেটীয় উত্তেজনার থেকে যা অনেকটা আলাদা। দুবাইয়ে আগামী ২০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের জয়ের মধ্যে একটা জুতসই জবাবের আশায় রয়েছেন ও পারের কিছু মানুষ। আবার এ পারের কিছু মানুষের আশা, শান্তদের মুরোদ বুঝিয়ে দেবেন রোহিতেরা। জবাব আর মুরোদের দ্বন্দ্বে আবর্তিত হচ্ছে ভারত-বাংলাদেশ ক্রিকেট।

ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচকে ভারত-পাকিস্তান লড়াইয়ের থেকে এগিয়ে রাখতে নারাজ বাংলার প্রাক্তন ক্রিকেটারেরা। সিএবি সভাপতি তথা প্রাক্তন ক্রিকেটার স্নেহাশিস গঙ্গোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘মনে হয় না ভারত-পাকিস্তান লড়াইয়ের উন্মাদনার সঙ্গে পৃথিবীর আর কিছুর তুলনা হয় বলে। সমাজমাধ্যমে খুব একটা সক্রিয় নই। কে কী বলছেন, কেন বলছেন জানি না। ক্রিকেটের সঙ্গে রাজনীতি মেলানো ঠিক নয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও কিছু বলব না। তবে বাংলাদেশ ভাল দল। ভারতও শক্তিশালী। নিরপেক্ষ মাঠে খেলা হবে। ক্রিকেট নিয়ে স্বাভাবিক যেমন আগ্রহ থাকে, তেমন থাকবে। কিন্তু ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের সঙ্গে তুলনা হয় না।’’ সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেই রাজি নন। বাংলার প্রাক্তন অধিনায়কের বক্তব্য, ‘‘কিছু দিন আগে জনৈক প্রাক্তন ক্রিকেটার সমাজমাধ্যমে লিখেছিলেন, ‘বুমরাহ বল ছোড়ে।’ পাগলেও এ কথা বিশ্বাস করবে না। অথচ তাতে বাংলাদেশ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার লাইক এসেছিল। এর থেকে বোঝা যায় ভারত সম্পর্কে ওখানকার একাংশ মানুষের মনোভাব কেমন। এ সবের প্রভাব মাঠে পড়ে না। ক্রিকেটীয় শক্তিতে ভারতের তুলনায় বাংলাদেশ বেশ দুর্বল। পরিসংখ্যানই প্রমাণ। এ বার তো শাকিব আল হাসানও নেই। জানি না কেমন খেলবে ওরা। দলগত শক্তিতে ভারত ৯০ হলে বাংলাদেশ ১০। প্রতিটি জায়গার ক্রিকেটার ধরে হিসাব করলেও রোহিত শর্মারা অনেক এগিয়ে। এটা ভারতের কাছে কোনও কঠিন ম্যাচ নয়। ভারতীয় ক্রিকেটারদের কাছে অফিসের একটা সাধারণ দিন। চাপে থাকবে বাংলাদেশই। ভারতের আসল ম্যাচ পাকিস্তানের সঙ্গেই। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের উত্তেজনা আলাদা। ওই ম্যাচে দু’দলই চাপে থাকে। শুধু ক্রিকেট নয়, ভারত-পাকিস্তান ক্যারাম খেললেও চাপ থাকে।’’

ক্রিকেটারেরা কি উত্তেজিত?

ভারত এবং বাংলাদেশ, দু’দেশেই জনপ্রিয়তম খেলা ক্রিকেট। যে কোনও জয়েই আনন্দে ভাসেন ক্রিকেটপ্রেমীরা। ২২ গজের একটা জয় বহু মানুষকে কষ্ট, যন্ত্রণা, অনাহার ভুলিয়ে দেয়। কয়েক ঘণ্টা মন ভাল করে দেয় তাঁদের। নিখাদ আনন্দের মধ্যে মিশে যাচ্ছে রাজনীতির খাদ। অভ্যন্তরীণ, আন্তর্জাতিক রাজনীতির সমীকরণ।

বিরাট কোহলি, শুভমন গিল, মহম্মদ শামিদের মতো মুশফিকুর রহিম, সৌম্য সরকার, তাসকিন আহমেদরা রাজনীতি থেকে দূরে থাকেন। দু’দেশেই রয়েছেন তাঁদের গুণমুগ্ধেরা। দু’দলের ক্রিকেটারদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক দেখা গিয়েছে গত সেপ্টেম্বরের টেস্ট সিরিজ়েও। ক্রিকেটারেরা রাজনৈতিক জটিলতার বাইরে রাখেন নিজেদের। আর পাঁচটা ম্যাচ জেতার মানসিকতা নিয়েই মাঠে নামেন। ২২ গজে নিজেদের সেরাটা উজাড় করে দিতে চান দেশের জার্সি গায়ে। সমর্থকদের একটা অংশ বাড়তি রং, উত্তেজনা যোগ করেন। ভারতীয় উপমহাদেশে ক্রিকেটেই একমাত্র এবং প্রমাণিত শান্তিপূর্ণ মাধ্যম, যা সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত করতে পারে। দেশাত্মবোধ বা বিদেশ-বিদ্বেষের জিগির তুলে কিছু মানুষকে তাতিয়ে দিতে পারলে তো কথাই নেই।

Picture of India vs Bangladesh match

ক্রিকেট মাঠের লড়াইয়ে বাংলাদেশের থেকে অনেক এগিয়ে ভারত। —ফাইল চিত্র।

উত্তেজনা অতীতেও

গত এমার্জিং এশিয়া কাপের ম্যাচে বাংলাদেশের সৌম্যর সঙ্গে বিবাদে জড়িয়েছিলেন হর্ষিত রানা। আম্পায়ারদের হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে। তাঁরা দু’জনেই রয়েছেন চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির দলে। ভারত-বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের বাগ্‌যুদ্ধ নতুন নয়। ২০০৭ সালে এক দিনের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের কাছে হেরে ছিটকে গিয়েছিল ভারত। সেই ম্যাচের আগে মাশরাফি বিন মোর্তাজা নড়াইলের ভাষায় রাহুল দ্রাবিড়ের দলকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘ধরে দিবানি।’’ ২০১০ সালে বীরেন্দ্র সহবাগ বাংলাদেশে টেস্ট খেলতে গিয়ে প্রতিপক্ষকে সাধারণ মানের দল হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে রোহিত ক্যাচ দিয়েও বেঁচে যান ‘নো’ বল হওয়ায়। সেই ‘নো’ বল নিয়ে তৈরি হয়েছিল বিতর্ক। এমনকি হাসিনাও মুখ খুলেছিলেন। তখন ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) সভাপতি ছিলেন বাংলাদেশেরই আহম মোস্তফা কামাল। বিক্ষোভের মুখে পড়েন তিনিও। সে বছরই ভারতের বিরুদ্ধে প্রথম কোনও সিরিজ় (এক দিনের) জিতেছিল বাংলাদেশ। সেই সিরিজ়ও বিতর্কহীন ছিল না। রান নেওয়ার সময় মহেন্দ্র সিংহ ধোনি ধাক্কা দিয়েছিলেন রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে থাকা মুস্তাফিজুর রহমানকে। মাটিতে পড়ে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের বোলার। ২০১৮ সালের এশিয়া কাপের ফাইনালে লিটন দাসের স্টাম্প আউট হওয়া নিয়েও বিতর্ক কম হয়নি। ইন্ধন দিয়েছে দু’দেশের কিছু মানুষ। যা ধীরে ধীরে দু’দেশের ক্রিকেট সম্পর্ককে মধুর থেকে অম্লমধুর করে তুলেছে।

আসরে পাকিস্তানের সমর্থকেরাও

পাকিস্তানের ক্রিকেটপ্রেমীরা চান ভারতীয় দল সে দেশে যাক। কয়েক দিন আগে গদ্দাফি স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে দেখা গিয়েছিল তেরঙা। সঙ্গের পোস্টারে ভারতীয় দলকে নির্ভয়ে পাকিস্তানে খেলতে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন কিছু পাক সমর্থক। সমাজমাধ্যমেও মুখ খুলেছেন পাকিস্তানের ক্রিকেটপ্রেমীরা। বিসিসিআই দল পাঠাতে রাজি না হওয়ায় তাঁরা হতাশ এবং ক্ষুব্ধ। তাঁরা চাইছেন বাংলাদেশের কাছে হেরে যাক ভারত। কয়েক জন মহম্মদ রিজ়ওয়ানকে অনুরোধ করেছেন, ম্যাচের পর পাকিস্তানের ক্রিকেটারেরা যেন রোহিত, কোহলিদের জড়িয়ে ধরে সৌজন্য বিনিময় না করেন। এক জন বলেছেন, ‘‘সব দল পাকিস্তানে খেলতে আসছে। শুধু ভারতীয় বোর্ড নিরাপত্তার দোহাই দিয়েছে। কোহলি, রোহিত, বুমরাহদের খেলা মাঠে বসে দেখার আশায় ছিলাম। ক্রিকেটপ্রেমী হিসাবে আমি ওদের ভক্ত। খুবই হতাশ হয়েছি।’’

দুই দেশের ক্রিকেটীয় শক্তি, দুর্বলতা

বাংলাদেশ পারবে দুবাইয়ের ২২ গজে ভারতকে হারাতে? অসম্ভব নয়। এক দিনের ক্রিকেটে বিশ্বের সেরা আট দল খেলছে এই প্রতিযোগিতায়। নিজেদের দিনে যে কোনও দল জিততে পারে। শক্তির নিরিখে সব দল উনিশ-বিশ। আঠারো-একুশ হলেও সম্ভব। দু’দেশের সম্ভাব্য প্রথম একাদশ পাশাপাশি রাখলে নিশ্চিত ভাবে এগিয়ে ভারত। অভিজ্ঞতায় এগিয়ে। দক্ষতায় এগিয়ে। সাফল্যে এগিয়ে। দলগত শক্তিতে এগিয়ে।

Picture of Cricket Fans

পাকিস্তান বনাম নিউ জ়িল্যান্ড ম্যাচে গ্যালারিতে তেরঙা। —ফাইল চিত্র।

তবে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে বাংলাদেশকে হালকা ভাবে নেওয়ার কারণ নেই। ব্যাটিং এবং ফিল্ডিংয়ের ক্ষেত্রে ভারত এগিয়ে থাকলেও বোলিং শক্তিতে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশ। এ বার ভারতের মূল বোলিং আক্রমণ অনভিজ্ঞ। অর্শদীপ সিংহ ন’টি, হর্ষিত রানা তিনটি এবং বরুণ চক্রবর্তী একটি এক দিনের ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা নিয়ে দুবাই যাচ্ছেন। চোট সারিয়ে ফেরা শামিকেও চেনা ফর্মে দেখা যায়নি এখনও। অন্য দিকে তাসকিন, মুস্তাফিজুর, নাহিদ রানাকে নিয়ে গঠিত বাংলাদেশের জোরে বোলিং বেশ শক্তিশালী। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের সম্ভাবনা যথেষ্ট।

পরিসংখ্যানে কারা এগিয়ে?

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ নিয়ে যত আলোচনা হচ্ছে, ততটাই হচ্ছে ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচ নিয়েও। রোহিতদের অনায়াস টেস্ট সিরিজ় জয়ের পরও হয়নি। দু’দলের মধ্যে শক্তির পার্থক্যে এগিয়ে থেকেই মাঠে নামে ভারত। এক দিনের ক্রিকেটেও ভারত এগিয়ে ৩২-৮ ব্যবধানে। দু’দলের একটি ম্যাচে ফল হয়নি। বাংলাদেশের আটটি জয়ের ছ’টিই দেশের মাটিতে। নিরপেক্ষ মাঠে ভারত এগিয়ে ১০-২ ব্যবধানে। টেস্ট ক্রিকেটে ভারতকে এখনও হারাতে পারেনি বাংলাদেশ। ১৫টি টেস্টের ১৩টিই জিতেছে ভারত। ১৭টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচের একটিতে জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। ১৬টি জিতেছে ভারত। তবু নতুন ধরনের উত্তেজনা। যার রসদ লুকিয়ে উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে।

Picture of Rohit Sharma and Najmul Hossain Shanto

(বাঁ দিকে) রোহিত শর্মা এবং নাজমুল হোসেন শান্ত (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র

বাংলাদেশের হুঙ্কার

বাংলাদেশের অধিনায়ক শান্ত সরাসরি ভারতের নাম করেননি। শান্তর দাবি, বড় দলগুলিকে টেক্কা দেওয়ার ক্ষমতা তাঁদের রয়েছে। তিনি বলেছেন, “আমরা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলতে নামব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্যই। আটটা দলই ট্রফি জেতার জন্য খেলতে নামবে। প্রত্যেকেই ভাল দল। আমার মনে হয়, বাংলাদেশের ট্রফি জেতার ক্ষমতা রয়েছে। দলের কারও বাড়তি চাপ নেই। আশা করি নিজেদের লক্ষ্য পূরণ করতে পারব।” প্রত্যেক দলের মধ্যে রয়েছে ভারতও। শান্ত প্রচ্ছন্ন ভাবে সতর্ক করে দিতে চেয়েছেন হয়তো। যে কোনও খেলোয়াড় বা দল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার লক্ষ্যেই অংশগ্রহণ করে। একই লক্ষ্য নিয়ে দুবাই যাচ্ছে ভারতীয় দলও।

ক্রিকেটকে বলা হয় ‘জেন্টলম্যান’স গেম’ বা ভদ্রলোকের খেলা। সেই খেলার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে রয়েছে রাজনীতি, কূটনীতি। সেই ইংলিশ চ্যানেল পার হওয়ার সময় থেকেই। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের সাম্প্রতিক উত্তেজনাও মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে ক্রিকেটের উত্তাপে। সেই আঁচে গা সেঁকছে উপমহাদেশের রাজনীতি।

India Vs Bangladesh India vs Pakistan India-Bangladesh Relation

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}