আইপিএলের মাঝেই একটি বিজ্ঞাপনে রোহিত শর্মাকে দেখা যায়, সকলকে মিউচুয়াল ফান্ড নিয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন। ঝুঁকি নিতে বলছেন। কিন্তু বাস্তবে ঝুঁকি নিলেন না রোহিত। আইপিএলের মাঝেই টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নিলেন তিনি। টেস্ট ক্রিকেটে রোহিতকে নিয়ে গত বছর ধরে লাগাতার সমালোচনা হয়েছে। শোনা যাচ্ছিল, ইংল্যান্ড সিরিজ়ে অধিনায়কত্ব যেতে পারে তাঁর। সেই সিদ্ধান্তের আগেই টেস্ট থেকে সরে দাঁড়ালেন তিনি। রোহিত বুঝিয়ে দিলেন, তাঁর এই সিদ্ধান্ত ‘সহি হ্যায়’।
শেষটা কি এমন হওয়ার কথা ছিল? না। এক বছরও হয়নি ভারতের ক্রিকেটভক্তদের মুখে হাসি ফুটিয়েছিলেন তিনি। ১৩ বছরের খরা কেটেছিল। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেছিল ভারত। গত মার্চে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। বার বার নক আউটে গিয়ে হারার যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে কোথাও যেন বিশ্বাসটাই চলে গিয়েছিল যে ভারত আইসিসি ট্রফি জিততে পারবে। সেই বিশ্বাসটা আবার সকলকে করতে শিখিয়েছিলেন তিনি। শুধু বিশ্বাস নয়, শুধু স্বপ্ন দেখা নয়, তাকে বাস্তবেও পরিণত করেছিলেন। ২০২৪ সালের ২৯ জুন আসমুদ্র হিমাচল আনন্দ করেছিল। সেই আনন্দের কেন্দ্রে ছিলেন তিনি। চার মাস আগে আরও এক বার দেশবাসীর মুখে হাসি ফুটিয়েছিলেন। অথচ এক বছর যেতে না যেতেই সবটা কেমন বদলে গেল। আইপিএলের মাঝেই টেস্ট ক্রিকেট থেকে সরে গেলেন তিনি। বিশ্বকাপ জেতার পরেই অবসর নিয়েছিলেন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকে। হাতে রইল শুধু এক দিনের আন্তর্জাতিক। যে মানুষটা ক্রিকেটভক্তদের এতটা আনন্দ দিয়েছিলেন, সেই মানুষটাই বিশ্বজয়ের পর সমালোচনায় বিদ্ধ। কারণ, অস্ট্রেলিয়া সফরে একের পর এক ম্যাচে ব্যর্থতা। হারের লজ্জা। সেই লজ্জা মাথায় নিয়েই টেস্ট ক্রিকেট থেকে সরে গেলেন তিনি। রোহিত গুরুনাথ শর্মা। ভারতের লাল বলের ক্রিকেটে শেষ হয়ে গেল ‘হিটম্যান’ যুগ। তবে শেষটা এমন হওয়ার কথা ছিল না। মাথা উঁচু করে যাঁর ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর কথা ছিল, তিনি বিদায় জানালেন মাথা নিচু করে।
এক বছর আগের সেই দিনটা এখনও জ্বলজ্বল করে ভারতের ক্রিকেটভক্তদের মনে। হার্দিক পাণ্ড্য শেষ বলটা করার পরেই কভার এলাকায় দাঁড়িয়ে থাকা রোহিত হাঁটু মুড়ে বসে পড়লেন। চুমু খেলেন ঘাসে। মাঠে তিন-চার বার চাপড় মারলেন। তার পর হাঁটু মুড়েই দু’হাত তুললেন আকাশে। তত ক্ষণে বাকি সতীর্থেরা এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরেছেন। ২০২৩ সালে দেশের মাটিতে যেটা করতে পারেননি সেটাই রোহিত করে দেখালেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের বার্বাডোজ়ে। বিশ্বকাপ জিতে মাঠেই পুঁতে দিলেন জাতীয় পতাকা। পিচে গিয়ে মাটি খুঁটে খেলেন। যে পিচ তাঁকে এত সম্মান দিয়েছে, সেই পিচের স্বাদ নিতে চেয়েছিলেন রোহিত। চোখে জলের পাশপাশি মুখে ছিল সেই অমলীন হাসি। হিটম্যানের হাসি। পরে বিশ্বকাপ ট্রফি নেওয়ার সময়ও লিয়োনেল মেসির কায়দায় হাঁটলেন রোহিত। জানিয়ে দিলেন, আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নিচ্ছেন। সেই ঘোষণার সময়েও তাঁর মুখে ছিল চওড়া হাসি। সেই হাসিই মিলিয়ে গেল এক বছরে।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ হাতে রোহিত শর্মা। —ফাইল চিত্র।
আর্থিক অবস্থা ভাল না হওয়ায় ছোটতে বাবা-মার সঙ্গে থাকতেন না রোহিত। বাবা গুরুনাথ মরাঠি হলেও মা পুর্ণিমা অন্ধ্রপ্রদেশের মেয়ে। ডোম্বিভলিতে এক কামরার ঘরে থাকতেন তাঁরা। সেই কারণে, রোহিত থাকতেন বোরিভলিতে। ঠাকুর্দা, ঠাকুমা, কাকাদের সঙ্গে। সপ্তাহে এক বার বাবা-মার সঙ্গে দেখা হত। রোহিতের কাকা তাঁকে একটি ক্রিকেট ক্যাম্পে ভর্তি করে দেন। রোহিতের ছোটবেলার কোচ দীনেশ লাড তাঁর মধ্যে প্রতিভা দেখেছিলেন। ছোটতে রোহিত ছিলেন অফ স্পিনার, যিনি ব্যাট করতে পারেন। তাঁকে ব্যাটার তৈরি করেন দীনেশ। এক বার মুম্বইয়ের বয়সভিত্তিক দলে সুযোগ পাওয়ার পর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি রোহিতকে। তবে সহজে সেই জায়গায় পৌঁছননি রোহিত। তার জন্য করতে হয়েছে পরিশ্রম। পরবর্তী সময়ে তিনি নিজেই বলেছেন, “আপনি যতই প্রতিভাবান হোন না কেন, পরিশ্রমের কোনও বিকল্প নেই। প্রতিভা কোনও দিন পরিশ্রমকে হারাতে পারে না। কিন্তু পরিশ্রম প্রতিভাকে হারিয়ে দেয়।” সেই পরিশ্রমই রোহিতকে জায়গা করে দিয়েছে ভারতীয় দলে।
২০০৭ সালে ভারতের জাতীয় দলে পথচলা শুরু রোহিতের। সেই সময় ভারতীয় ক্রিকেটে রয়েছেন সচিন তেন্ডুলকর, বীরেন্দ্র সহবাগ, রাহুল দ্রাবিড়, ভিভিএস লক্ষ্মণ, জাহির খান, মহেন্দ্র সিংহ ধোনিরা। তাঁদের সঙ্গে সাজঘরে থাকার কিছু লাভ রোহিত পেয়েছিলেন। শুরু থেকেই নিজের খেলা নিয়ে খুবই মনোযোগী। প্রথমে তিনি নামতেন মিডল অর্ডারে। ধীরে ধীরে ওপেনার হিসাবে জায়গা পাকা করেন। সহবাগের ছেড়ে যাওয়া জুতোয় পা গলান রোহিত। একই রকম আক্রমণাত্মক ব্যাটিং। প্রতিপক্ষ বোলারদের নিয়ে ছেলেখেলা করা।
আরও পড়ুন:
রোহিতকে দেখে মনে হত, বাকিদের থেকে একটু বেশি সময় পান তিনি। মুম্বইয়ের ক্রিকেটারদের মতো অলস ব্যাটিং করতেন। সুনীল গাওস্কর তাঁকে দেখে বলেছিলেন, “রোহিতকে দেখলে মনে হয়, কোনও তাড়াহুড়ো নেই ওর। আরাম করে শট খেলছে। কোমরের উপরে ওকে বল করলে সেই বল গ্যালারিতে গিয়ে পড়বেই। এটাই মুম্বই ক্রিকেটের ধারা। রোহিত তা বহন করছে।” রোহিতের পছন্দের শট পুল। মিড উইকেট থেকে ফাইন লেগ এলাকায় যে কত বল বাউন্ডারির বাইরে গিয়ে পড়েছে তার ইয়ত্তা নেই। তাঁর খেলার ধরনের কারণেই ‘হিটম্যান’ নাম হয়ে গিয়েছিল রোহিতের। সাদা বলের ক্রিকেটে তাঁকে ভয় পেতে শুরু করেন বোলারেরা।
ব্যাট হাতে দাপট দেখিয়েছেন রোহিত শর্মা। —ফাইল চিত্র।
২০০৭ থেকে টেস্ট ও এক দিনের ক্রিকেট খেললেও লাল বলের ক্রিকেটে রোহিত সুযোগ পান অনেকটা পরে। সেই সময় দলে জায়গাও ছিল না। ২০১৩ সালে মিডল অর্ডারে জায়গা পান তিনি। আর প্রথম দর্শনেই বাজিমাত। ইডেনে প্রথম টেস্টে শতরান। ঘরের মাঠ ওয়াংখেড়েতে দ্বিতীয় টেস্টেও শতরান। এত ভাল শুরু করার পরেও হোঁচট খেতে হয়েছে রোহিতকে। একটা সময় এমন কথাও শুরু হয় যে রোহিত শুধু সাদা বলের ক্রিকেটার। কিন্তু ২০১৮-১৯ সালে ওপেন করা শুরু করেন রোহিত। আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। লাল বলের ক্রিকেটেও দাপট দেখান তিনি।
টেস্টে ৪,৩০১ রান, এক দিনের ক্রিকেটে ১১,১৬৮ রান ও টি-টোয়েন্টিতে ৪,২৩১ রান করেছেন রোহিত। তিন ফরম্যাট মিলিয়ে ১০৮টি অর্ধশতরান ও ৪৯টি শতরান করেছেন। তাঁর কৃতিত্বও কম নয়। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে সর্বাধিক রানের মালিক তিনি। এক দিনের ক্রিকেটে তাঁর তিনটি দ্বিশতরান রয়েছে, যা আর কারও নেই। ৫০ ওভারের ক্রিকেটে একটি ইনিংসে সবচেয়ে বেশি ২৬৪ রানও তাঁর দখলে। এক বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি পাঁচটি শতরান করেছেন রোহিত। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি ছক্কা মেরেছেন। আক্ষরিক অর্থেই হিটম্যান হয়ে উঠেছেন বোরিভলির গলিতে ঠাকুমার সেলাই করা ৪৫ নম্বর গেঞ্জি পরে খেলা ছেলেটা। পরে সেই ৪৫ নম্বর জার্সি পরেই মাঠ কাঁপিয়েছেন রোহিত।
তবে ব্যাটার রোহিতকেও যেন কোথাও ছাপিয়ে গিয়েছেন অধিনায়ক রোহিত। তাঁর নেতৃত্বের হাতেখড়ি মুম্বই ক্রিকেটে। অজিত আগরকর অবসর নেওয়ার পর রোহিতকে অধিনায়ক করা হয়। তার পরে আইপিএল। মুম্বই ইন্ডিয়ান্সকে পাঁচ বার চ্যাম্পিয়ন করেছেন। পরে সেই রেকর্ডে ভাগ বসিয়েছেন ধোনি। বিরাট কোহলির পরে তাই রোহিত ছাড়া আর কারও কথা ভাবেননি নির্বাচকেরা। তাঁদের ভাবনা যে ঠিক ছিল, তা প্রমাণ করেছেন রোহিত। কোহলির সময় ভারতীয় ক্রিকেট যে অধিনায়কত্ব দেখেছিল, তার ঠিক উল্টো ছবি দেখালেন রোহিত। সেখানে আগ্রাসনের পাশাপাশি মাঠে হাসি-ঠাট্টা-মজা রয়েছে।
চাপে ভারত অধিনায়ক রোহিত শর্মা। —ফাইল চিত্র
মাঠে বড় দাদার ভূমিকায় পাওয়া যেত রোহিতকে। ভুল করলে যেমন বকেন, ভাল খেললে তেমনই পিঠ চাপড়ে দেন। ক্রিকেটারদের পাশে থাকতেন রোহিত। তাঁদের ভরসা দিতেন। মাঠে রোহিতের বিভিন্ন কথা ভাইরাল হয়ে যেত। যেমন, অমনোযোগী ফিল্ডারদের বলেছিলেন, “কী রে তোরা বাগানে ঘুরতে এসেছিস নাকি। বলের দিকে খেয়াল রাখ।” বা সিলি পয়েন্টে দাঁড়ানো বিনা হেলমেটের সরফরাজ় খানকে তিনি বলেছিলেন, “বেশি হিরো হওয়ার দরকার নেই। হেলমেট পরে আয়।” রোহিতের এই ধরনই তাঁকে বাকিদের থেকে আলাদা করে তুলেছিল।
ভারতের ক্রিকেট খেলার ধরন বদলে ফেলেছিলেন রোহিত। ধোনি বার বার বলেন একটি প্রসেস-এর কথা। সেখানে হার-জিতের থেকেও খেলার ধরন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একটি নির্দিষ্ট ধরন নিয়ে এগোলে ধীরে ধীরে তা রপ্ত করা যায়। সেই প্রসেস-এর উপর জোর দিয়েছিলেন রোহিতও। ২০২৩ সালে দেশের মাটিতে এক দিনের বিশ্বকাপে তা দেখা গিয়েছে। আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলেছে ভারত। সেই ক্ষেত্রেও সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন রোহিত। কোনও ম্যাচে ব্যক্তিগত মাইলফলকের কথা ভাবেননি। শুরু থেকে ব্যাট চালিয়েছেন। বাকিদের জন্য ভিত তৈরি করে দিয়েছেন। কিন্তু ফাইনালে তাল কেটেছে। সেই হারের পরেও খেলার ধরন বদলাননি রোহিত। পরের বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও তা দেখা গিয়েছে। রোহিতের এই ধরনটির প্রশংসা করেছেন বিশেষজ্ঞেরা। তার সুফল পেয়েছেন রোহিত। খরা কাটিয়ে দেশকে দিয়েছেন বিশ্বকাপ।
সেই ধরনটাই যেন কাল হয়েছে রোহিতের। আসলে ভারতের মাটিতে যে ভাবে খেলা যায়, সেই একই ভাবে যে অস্ট্রেলিয়ায় খেলা যায় না, সেটা হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন রোহিত। তার খেসারত দিতে হয়েছিল। ডিফেন্সটাই যেন হারিয়ে গিয়েছিল তাঁর। বার বার শুরুতেই আউট। তার খেসারত দিতে হয়েছিল দলকেও। রোহিতকে খেলাতে বাদ পড়তে হয়েছিল শুভমন গিলকে। ব্যাটিং অর্ডারে নামতে হয়েছিল লোকেশ রাহুলকে। তার পরেও রোহিত সাফল্য পাননি। দেওয়াল লিখন যেন দেখতে পাচ্ছিলেন রোহিত। সেই কারণে সাংবাদিক বৈঠকে নিজের খেলার সমালোচনা করছিলেন। খারাপ পারফরম্যান্সের প্রভাব পড়েছিল রোহিতের অধিনায়কত্বেও। মাঠের মধ্যে সেই হাসি-ঠাট্টা উধাও হয়ে যাচ্ছিল। বদলে আসছিল বিরক্তি। সতীর্থদের ধমক বাড়ছিল। ভুল করছিলেন রোহিত।
কোচ গৌতম গম্ভীরকে (বাঁ দিকে) পাশে পাননি রোহিত শর্মা। —ফাইল চিত্র
বাড়ছিল সমালোচনা। বাড়ছিল লজ্জা। আর হয়তো নিতে পারছিলেন না তিনি। মাঝের আইপিএল সেই লজ্জা হয়তো অনেককেই ভুলিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু বোঝা গেল ভোলেননি রোহিত। অস্ট্রেলিয়া সফরে কোচ গৌতম গম্ভীরকেও পাশে পাননি রোহিত। সিডনিতে শেষ টেস্টের আগে সাংবাদিক বৈঠকে গম্ভীর স্পষ্ট করেননি যে, রোহিত খেলবেন কি না। তখন দেখে মনে হচ্ছিল, রোহিত নন, গম্ভীরই দল চালাচ্ছেন। অনুশীলনেও দেখা গিয়েছিল, নিজের পরিচিত জায়গা স্লিপে ছিলেন না রোহিত। দলের সহ-অধিনায়ক জসপ্রীত বুমরাহের সঙ্গে দীর্ঘ ক্ষণ কথা বলতে দেখা গিয়েছিল অজিত আগরকর ও গম্ভীরকে। ব্যাট করতেও শুরুতে নামেননি তিনি। সিডনিতে বাদই পড়তে হয়েছিল রোহিতকে। তখনই ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। সেটা সত্যি হল চার মাস পর। টেস্ট শেষে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন ভারত অধিনায়ক। অবসর নিলেন টেস্ট থেকে। শেষ হয়ে গেল একটা যুগ।