Advertisement
E-Paper

ফিনিশার ধোনি এখন অস্বস্তির! নীলকণ্ঠ হয়ে টানছেন ভাবমূর্তির কফিন

মহেন্দ্র সিংহ ধোনি গোটা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটজীবনে মাইলফলক নিয়ে ভাবেননি। রেকর্ড নিয়ে আহ্লাদিত হননি। তিনিই আঁকড়ে থাকতে চাইছেন আইপিএলের মতো ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি লিগ!

অভিরূপ দত্ত

শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০২৫ ১২:৪৩
picture of MS Dhoni

মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। —ফাইল চিত্র।

মাস দুয়েক বাকি। ৪৪ বছর পূর্ণ করে ফেলবেন মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। গত দু’দশকে ভারতীয় তথা বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম ‘মহাতারকা’ হয়ে উঠেছেন ধোনি। মাহিতে মোহিত ক্রিকেট বিশ্ব এখন চাক্ষুষ করছে তারা খসার পর্ব!

দেশের হয়ে ৯০টি টেস্ট, ৩৫০টি এক দিনের ম্যাচ এবং ৯৮টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলার পর হঠাৎ অবসর নেন ধোনি। তখন ক্রিকেটপ্রেমীদের প্রতিক্রিয়া ছিল, এখনই কেন? আরও কিছু দিন তো খেলতেই পারতেন! ২০১৯ থেকে ২০২৫— ছ’বছরে বদলে গিয়েছে বিশ্ব। ‘মহাতারকা’র জ্যোতি কমেছে। সেই ক্রিকেটপ্রেমীরাই এখন বলছেন, এখনও নয় কেন? আর কত দিন খেলবেন!

ধোনি গোটা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটজীবনে মাইলফলক নিয়ে ভাবেননি। রেকর্ড নিয়ে আহ্লাদিত হননি। তিনিই আঁকড়ে থাকতে চাইছেন আইপিএলের মতো ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি লিগ! পারছেন না, তা-ও ছাড়ছেন না। অপ্রিয় শুনতে লাগলেও এটাই বাস্তব। আইপিএল এখন বৈভব সূর্যবংশী, প্রিয়াংশ আর্য, আয়ুষ মাত্রে, অঙ্গকৃশ রঘুবংশীদের মঞ্চ। সেই মঞ্চে ধোনি মানিয়ে নিতে পারছেন না। নিজে খেলতে পারছেন না। দলকে জেতাতে পারছে না তাঁর ক্রিকেটমস্তিষ্ক। অভিজ্ঞ উইকেটরক্ষক-ব্যাটার ব্যর্থতার সব দায় নিজের ঘাড়ে নিচ্ছেন। শনিবার রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর কাছে হাড্ডাহাড্ডি ম্যাচে চেন্নাই সুপার কিংস ২ রানে হারার পর ধোনি বলেছেন, “যখন ব্যাট করতে নেমেছিলাম, তখন অনেকটা রান দরকার ছিল। হাতে বলও কম ছিল। আমার মনে হয়, চাপ কমানোর জন্য আরও অন্তত দুটো বড় শট খেলার দরকার ছিল। সেটা আমি পারিনি। তাই দোষ আমারই।”

নীলকণ্ঠ হতে চাইছেন মাহি? চেন্নাই কর্তৃপক্ষের চাপ এড়াতে পারছেন না? ৪ কোটি টাকা নিয়ে ফেলেছেন? না কি বুঝতে চাইছেন না, ২০ ওভারের ক্রিকেটে তিনি এখন অচল। ধোনিপ্রেমীদের মন মানতে চাইবে না নিশ্চিত। তবু সত্যকে অস্বীকার করার সুযোগ কোথায়? ধোনি থামতে জানেন। নিখুঁত সময়জ্ঞানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটজীবনে হ্যাঁচকা ব্রেক কষে দেখিয়ে দিয়েছেন। ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে আফসোস তৈরি করতে পেরেছেন। আইপিএল জীবনে ব্রেক ফেল করছে। আবারও আফসোস তৈরি করছেন। ধরনটা ভিন্ন।

চার-পাঁচ বছর আগের ধোনি হলে শনিবারের লড়াই জিতত সিএসকে-ই। বিশ্বের অন্যতম সেরা ফিনিশার ধোনি হয়তো কয়েক বল বাকি থাকতেই খেলা শেষ করে দিতেন। এখন আর পারছেন না। তাঁর ৮ বলে ১২ রানের ইনিংস কার্যকর ভূমিকা নিতে পারেনি। অধিনায়ক ধোনি ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার তরুণ শিবম দুবেকেও নিজের আগে ব্যাট করতে পাঠাননি। টান টান উত্তেজনার সময় নিজে নেমেছিলেন ব্যাট হাতে। আত্মবিশ্বাস না কি অধিনায়ক হিসাবে নিজেকেই চাপের মুখে ফেলতে চেয়েছিলেন? কারণ যা-ই হোক, ধোনি দোষ স্বীকার করে নিয়েছেন। এ বারের আইপিএলে ধোনি এখনও পর্যন্ত ১১টি ম্যাচ খেলে করেছেন ১৬৩ রান। সর্বোচ্চ অপরাজিত ৩০। গড় ২৩.২৯। স্ট্রাইক রেট ১৪৮.১৮। সাধারণ চোখে খুব খারাপ না দেখালেও ম্যাচ জেতাতে পারছেন না তিনি। মুম্বইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের দু’টি দর্শকাসন সংরক্ষিত করা হয়েছে। ২০১১ সালে ভারতকে বিশ্বকাপ এনে দেওয়া তাঁর ছক্কা সেখানে গিয়ে পড়েছিল। ক্রিকেটজনতা সেই ধোনিকেই চায়। ম্যাচ জেতানো ক্রিকেটমস্তিষ্ক দেখতে চায়।

ধোনি এখন অতীতের ছায়া। যে ছায়ায় নিশ্চিত থাকতে পারছে না সিএসকে। যে ছায়া স্বস্তি দিতে পারছে না ভক্তদের। তবু ধোনি খেলছেন। উইকেটের পিছনে বা সামনে বিক্ষিপ্ত ভাবে দু’-একটি ভাল মুভ বা শট দেখা যাচ্ছে। অভিজ্ঞতা, ক্রিকেটীয় দক্ষতার ঝলক দেখা যাচ্ছে কখনও কখনও। ধারাবাহিকতা নেই। অনিশ্চিত এই ঝলকানি চোখের আরাম দিলেও মন ভরাতে পারছে কই? ব্যাট করার সময় পা সরছে না। ক্রিজ়ে দ্রুত দৌড়তে পারছেন না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ব্যাটিং এবং কিপিং করার চেষ্টা করছেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে। মাহি নিজের ক্রিকেটজীবনকেই দাঁড় করিয়ে ফেলছেন প্রশ্নের মুখে। তাঁর নেতৃত্বেই আইপিএলের ইতিহাসে প্রথম বার টানা দু’মরসুম প্লে-অফে পৌঁছোতে পারল না চেন্নাই।

প্রায় সাড়ে পাঁচশো আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা ধোনি এ বার স্রেফ ঘরোয়া ক্রিকেটার! ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড (বিসিসিআই) নিয়ম পরিবর্তন করেছে আইপিএলের নিলামের আগে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারের সংজ্ঞা বদলে দেওয়া হয়েছে। শেষ পাঁচ বছর দেশের হয়ে কোনও ম্যাচ না খেলার সুবাদে ধোনি ঘরোয়া ক্রিকেটার। অনেকটা শিং ভেঙে বাছুরের দলে ঢোকার মতো। চেন্নাই কর্তৃপক্ষ তাঁদের অ্যাকাডেমিতে গত ১৭ বছরে আর একটা ধোনি তৈরি করতে পারেননি। তাই বিসিসিআইয়ের নতুন নিয়ম কাজে লাগিয়ে ধোনিকেই ঘরোয়া ক্রিকেটার হিসাবে খেলানো হচ্ছে। ভবিষ্যতের ভাবনা নেই। অতীত আঁকড়ে টিকে থাকার চেষ্টা। ইন্ধন জোগাচ্ছেন ধোনিও। নিজের সুনাম খুইয়ে চেন্নাই কর্তৃপক্ষকে সন্তুষ্ট করছেন।

ক্রিকেটার ধোনিও নিজেকে বন্ধক রাখলেন ৪ কোটি টাকার কাছে। ধোনি চাইছেন না চেন্নাইকে আর নেতৃত্ব দিতে। তবু অধিনায়কত্ব তাঁর পায়ে লুটোপুটি খাচ্ছে। রবীন্দ্র জাডেজা, রুতুরাজ গায়কোয়াড়দের কাছ থেকে তাঁর কাছে নেতৃত্ব ফিরে আসছে বিবিধ কারণে। বিকল্প নেই! ধোনির খেলে যাওয়া হোক বা তাঁর কাছে বার বার নেতৃত্ব ফিরে যাওয়া হোক— দুই-ই আসলে অতীতে ফেরা। গত বছর পায়ে চোট নিয়েও ধোনিকে খেলে যেতে হয়েছে টানা। আসলে ভারতীয় ক্রিকেটকে মাহি যুগে আটকে রাখতে চাইছেন চেন্নাই কর্তৃপক্ষ।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ছেড়ে দেওয়ার পরও সাত বছর ধরে আইপিএল খেলে চলেছেন ধোনি। আসলে বয়ে নিয়ে চলেছেন ক্রিকেট থেকে অবসরের মাহেন্দ্রক্ষণকে। বছরে মাস তিনেকের বেশি ২২ গজের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক থাকে না। যিনি ঝটিকা সিদ্ধান্তে দেশের জার্সি খুলে ফেলতে পারেন, তিনি চেন্নাইয়ের জার্সির মায়া ত্যাগ করতে পারছেন না! মুখ ফুটে বলতে পারছেন না— অনেক হয়েছে, এ বার থাক। না কি বলছেন, কিন্তু কাশী বিশ্বনাথনেরা (সিএসকের সিইও) শুনছেন না? ভারতীয় ক্রিকেটে ধোনির প্রভাব, দাপট অতীত। ব্যক্তি ধোনির ব্যক্তিত্বও হার মেনে যাচ্ছে? ক্রিকেটার ধোনি সুনাম নষ্ট করছেন। অ্যাডাম গিলক্রিস্টের মতো অন্ধ ধোনি ভক্তও বলেছেন, এ বার অবশ্যই অবসর নেওয়া উচিত। বলেছেন আরও অনেকে। ধোনি অবশ্য সমাজমাধ্যম, ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের কথা, সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন দেখেন না। শোনেন না। পড়েন না। পরামর্শ না-ই শুনলেন। নিজে বুঝতেও পারছেন না!

ধোনিকে আসলে ব্যবহার করছে চেন্নাই। তাঁর জনপ্রিয়তা ভাঙিয়ে ব্যবসা করছে। ‘থালা’ বাজিয়ে যতটা সম্ভব রোজগারের চেষ্টা করছে। এই মানসিকতায় ক্রিকেট নেই। মুনাফাময় দৃষ্টিভঙ্গি। ধোনি দু’বলের জন্য ব্যাট করতে নামলেও ক্রিকেটজনতার একাংশ উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন এখনও। চেন্নাইয়ের সমর্থকদের একটা অংশ আসলে ধোনির সমর্থক। তাঁকে দেখতেই মাঠে আসেন। আগে তাঁরা ফিরতেন খুশি মনে। এখন ফিরছেন হতাশা নিয়ে। এই সংখ্যাটা কম নয়। এমএ চিদম্বরম স্টেডিয়ামের ওই আসনগুলি ভরিয়ে রাখতে চাইছেন বিশ্বনাথনেরা। জনপ্রিয়তা উপভোগ করছেন ধোনিও।

আইপিএল শুরুর আগে এক সাক্ষাৎকারে ধোনি বলেছিলেন, যে ক’দিন খেলবেন মনের আনন্দে খেলবেন। শিশুর মতো খেলবেন। তেমনই খেলছেন। ক্রিকেটার বা অধিনায়ক ধোনির মধ্যে প্রত্যাশিত পরিণতিবোধ দেখা যাচ্ছে না। ক্রিকেটীয় দক্ষতা যেমন আগের মতো নেই, তেমন অধিনায়ক হিসাবেও আগের মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। কৌশলে মার খাচ্ছেন। প্রতিপক্ষের কাছে ধরা পড়ে যাচ্ছেন। নতুনত্ব নেই রণকৌশলে। তবু খেলছেন। খেলেই চলেছেন। অবসরের প্রশ্নে মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছেন ধোনি। রসিকতা করছেন। আসলে নিজের ক্রিকেটজীবন নিয়েই রসিকতা করছেন। ভারতীয় ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ নিয়েও করছেন।

দেশকে দু’টি বিশ্বকাপ, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি দেওয়া প্রাক্তন অধিনায়কের সঙ্গে যা বড্ড বেমানান। তবু মানিয়ে নিতে হচ্ছে ক্রিকেটপ্রেমীদের। হয়তো মানিয়ে নিচ্ছেন ধোনিও। নিজেকে যে বিক্রি করে দিয়েছেন! টাকার থলি নিয়ে বসে থাকা আইপিএলের দলগুলির মালিকদের কেউ কেউ বোধহয় ক্রিকেটারদের আখ পেষাইয়ের মতো করে সব রস নিংড়ে নিতে চান। ধোনিরও ছাড় নেই।

ভারতে ক্রিকেটজীবন টেনে নিয়ে যাওয়ার উদাহরণ কম নেই। অনেক বড় বড় নাম রয়েছে এই তালিকায়। ধোনিও নিজেকে সেই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে ফেলছেন ক্রমশ। ক্রিকেটপ্রেমীরা মাহিকে মনে রাখতে চান ধোনি হিসাবে। ভারতীয় দল এবং চেন্নাই সুপার কিংসের সফলতম অধিনায়ক হিসাবে। বিশ্বের অন্যতম সেরা ফিনিশার, ক্ষিপ্র উইকেটরক্ষক এবং চতুর অধিনায়ক হিসাবে। ক্রিকেটজনতা ধোনির কাছে যা পেয়েছে, তার জন্য তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। এখনও সময় আছে। ধোনি ভাবুন। ক্রিকেট কফিন টানতে টানতে নিজের জনপ্রিয়তাকে কফিনবন্দি করে ফেলবেন না। ভক্তদের শ্রদ্ধার মনোভাবে ‘কিন্তু’ জুড়ে দেবেন না। নিজের ভাবমূর্তির কথা অন্তত ভাবুন। প্রশ্নটা কিন্তু বড় হচ্ছে, আর কবে?

MS Dhoni CSK BCCI retirement
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy