১৯৯৬ সালের এক দিনের বিশ্বকাপের পর ২০২৫ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। ২৯ বছর পর বিশ্বমানের ক্রিকেট প্রতিযোগিতা আয়োজনের দায়িত্ব পেয়েছিল পাকিস্তান। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিকে ভিত্তি করে আগামীর ক্রিকেটের ভিত গড়তে চেয়েছিলেন পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের (পিসিবি) কর্তারা। অথচ প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পিছনের পায়েই খেলতে হল পাকিস্তানকে। মহসিন নকভিদের মতো মহম্মদ রিজ়ওয়ানেরাও ঘরের মাঠে সামনের পায়ে আগ্রাসী ক্রিকেট খেলতে পারলেন না!
হানিফ মহম্মদ, ইমরান খান, জাভেদ মিয়াঁদাদ, ওয়াসিম আক্রম বা ইনজামাম উল হকদের ক্রিকেট অতীত। পাকিস্তানের ক্রিকেটে এখন সম্ভবত সেরা নাম বাবর আজ়ম। পিসিবি কর্তারা যেমন ২২ গজের বাইরের লড়াইয়ে পারেননি, তেমন বাবরেরাও ২২ গজের লড়াইয়ে ব্যর্থ। ২০০৯ সালের ৩ মার্চ লাহোরের গদ্দাফি স্টেডিয়ামের কাছে জঙ্গি হামলার শিকার হয় শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দল। তার পর কয়েক বছর পাকিস্তানে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট। নিরপত্তার প্রশ্নে কোন দেশ পাকিস্তানে ক্রিকেট দল পাঠাতে চাইত না। এক দশক পর ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটই প্রথম আবার পাকিস্তানে দল পাঠাতে রাজি হয়। দুবাই, শারজার প্রবাস থেকে ঘরে ফেরার সুযোগ পায় পাকিস্তানের ক্রিকেট। তার পর ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউ জ়িল্যান্ড, বাংলাদেশ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ় একে একে পাকিস্তান সফর করেছে। নতুন করে নিরাপত্তাজনিত সমস্যা হয়নি লাহোর, করাচি, মুলতান বা রাওয়ালপিন্ডিতে। রাষ্ট্রপ্রধানদের সমান নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা হয় বিদেশি দলগুলির জন্য। নির্বিঘ্নে হচ্ছে পাকিস্তান সুপার লিগও (পিএসএল)। তবু পাকিস্তানে ক্রিকেটের উন্নতি, উন্মাদনা আটকে ছিল একটা জায়গায়। ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) পাকিস্তানকে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি আয়োজনের দায়িত্ব দেওয়ায় নতুন আশার আলো দেখেন পিসিবি কর্তারা।
পিসিবির আশায় প্রথমেই জল ঢেলে দেয় ভারত-পাকিস্তানের রাজনৈতিক সম্পর্ক। ২০০৮ সালে মুম্বইয়ে জঙ্গি হামলার পর থেকে বন্ধ দু’দেশের দ্বিপাক্ষিক ক্রিকেট। বহুদলীয় প্রতিযোগিতা ছাড়া দু’দল পরস্পরের মুখোমুখি হয় না। ২০২৩ সালের এক দিনের বিশ্বকাপ খেলতে বাবরদের ভারতে পাঠিয়েছিল ইসলামাবাদ। কিন্তু রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলিদের পাকিস্তান সফরের উপর নিষেধাজ্ঞা বহাল রেখেছে নয়াদিল্লি। যে কারণে ২০২৩ সালে এশিয়া কাপের জন্য পাকিস্তানে যায়নি ভারতীয় দল। হাইব্রিড মডেলে হয় প্রতিযোগিতা। ভারতীয় দলের সব ম্যাচ হয়েছিল শ্রীলঙ্কায়। এ বারের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিও একই কারণে করতে হয়েছে হাইব্রিড মডেলে। ভারতীয় দল সব ম্যাচ খেলেছে দুবাইয়ে। একদা পাকিস্তানের ঘরের মাঠে। আইসিসি কর্তাদের উপর নানা ভাবে চাপ তৈরি করেও গোটা প্রতিযোগিতা পাকিস্তানের মাটিতে করাতে ব্যর্থ হন পিসিবি কর্তারা। তাঁদের কোনও প্রস্তাবেই সায় দেননি ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিসিআই) কর্তারা। বিসিসিআইয়ের অনড় মনোভাবের সামনে নতিস্বীকার করে পিছনের পায়ে যেতে বাধ্য হয় পিসিবি। সেই শুরু।
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির পরিকাঠামো তৈরি করতেও সমস্যা পড়ে পাকিস্তান। লাহোর, করাচি এবং রাওয়ালপিন্ডিকে বেছে নেওয়া হয় চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ম্যাচগুলি আয়োজনের জন্য। আইসিসির কাছ থেকে স্টেডিয়াম সংস্কারের জন্য পর্যাপ্ত টাকাও পায় পাকিস্তান। তবু ঢিমে তালে কাজে এক সময় পাকিস্তানে প্রতিযোগিতা হওয়া নিয়েই প্রশ্ন তৈরি হয়। প্রতিযোগিতা শুরুর তিন সপ্তাহ আগেও তিনটি স্টেডিয়ামের সংস্কারের কাজ শেষ করতে পারেনি পিসিবি। শেষবেলায় কোনও রকমে কাজ শেষ করে স্টেডিয়ামগুলি তুলে দেওয়া হয় আইসিসির হাতে। সময়ের মধ্যে তৈরি করা যায়নি দর্শকাসনের ছাদও। এক রকম অসম্পূর্ণই থাকে সংস্কারের কাজ। দিনরাত কাজ করিয়ে শুধু খেলার উপযুক্ত করে দেওয়া হয় স্টেডিয়ামগুলি। যা বড় মাপের প্রতিযোগিতা আয়োজন করার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের দক্ষতা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দেয়।
প্রতিযোগিতার মাঝেও মাঠ ঢাকার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় মুখ পুড়েছে পিসিবির। বৃষ্টির জন্য রাওয়ালপিন্ডিতে অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকা এবং পাকিস্তান-বাংলাদেশ ম্যাচে টস করাও সম্ভব হয়নি। শেষ করা যায়নি লাহোরে অস্ট্রেলিয়া-আফগানিস্তান ম্যাচ। বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও কোনও ক্ষেত্রেই পুরো মাঠ ঢাকার ব্যবস্থা করা হয়নি। শুধু পিচ এবং সংলগ্ন অংশ ঢাকার ব্যবস্থা ছিল। ফলে মাঠ ভিজে যায়। শুধু তাই নয়, নতুন করে গড়ে তোলা স্টেডিয়ামগুলির নিকাশি ব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে মাঠের বিভিন্ন অংশে জল জমে থাকায়। মাঠ শুকনোর করার যথেষ্ট ব্যবস্থাও করেননি পিসিবি কর্তারা। ফলে বৃষ্টি থামার পরও খেলা শুরু করা যায়নি। একাধিক ঘটনায় প্রশ্নের মুখে পড়ে পাকিস্তানের ক্রিকেট কর্তাদের সাংগঠনিক দক্ষতা। সমালোচনায় মুখর হন প্রাক্তন ক্রিকেটারদের একাংশ।
কর্তাদের পাশাপাশি হতাশ করেছেন ক্রিকেটারেরাও। প্রতিযোগিতার উদ্বোধনী ম্যাচেই নিউ জ়িল্যান্ডের কাছে করাচিতে ৬০ রানে হেরে যান রিজ়ওয়ানেরা। দ্বিতীয় ম্যাচে দুবাইয়ে ভারতের কাছে ৬ উইকেটে হেরে আয়োজকদের সেমিফাইনালে ওঠার আশা শেষ হয়ে যায়। বাংলাদেশের সঙ্গে ম্যাচ বৃষ্টিতে ভেস্তে যাওয়ায় জয় ছাড়াই প্রতিযোগিতা শেষ করে পাকিস্তান। ভারত এবং নিউ জ়িল্যান্ড ম্যাচে পাকিস্তানের কোনও ক্রিকেটারই প্রত্যাশা মতো পারফর্ম করতে পারেননি। রিজ়ওয়ান, বাবরদের মতোই হতাশ করেছেন শাহিন আফ্রিদি, হ্যারিস রউফেরা। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি নিয়ে দেশবাসীর সব আশা শেষ করে দেন ক্রিকেটারেরাই।
ক্রিকেটীয় বিতর্ক শুরু হয়েছিল প্রতিযোগিতার আগে থেকেই। ১৫ জনের দলে মাত্র এক জন বিশেষজ্ঞ স্পিনার আবরার আহমেদকে রাখেন পাকিস্তানের নির্বাচকেরা। দেশের মাটিতে আয়োজিত প্রতিযোগিতার জন্য এমন দল নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন সে দেশের প্রাক্তন ক্রিকেটারদেরই একাংশ। বাবর, রিজ়ওয়ানদের বিপর্যয়ের পর সেই প্রশ্ন আরও বড় হয়। ওয়াসিম আক্রম, ওয়াকার ইউনিসদের মতো প্রাক্তন ক্রিকেটারেরা জাতীয় নির্বাচকদের ক্রিকেটবোধ নিয়েই প্রশ্ন তুলে দেন।
পাকিস্তান সেমিফাইনালে উঠতে না পারার পরই আশঙ্কা তৈরি হয়, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালও হাতছাড়া হতে পারে পিসিবির। রোহিত শর্মারা ফাইনালে ওঠায় সেই আশঙ্কায় সিলমোহর পড়ে। আয়োজক দেশে থেকেই সরে যায় প্রতিযোগিতার খেতাবি লড়াই। এখানেই শেষ নয়।
আরও পড়ুন:
রবিবার দুবাইয়ে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে মুখোমুখি হয় ভারত এবং নিউ জ়িল্যান্ড। খেলার পর পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে তিন জন ভারতীয় ক্রিকেট কর্তা থাকলেও আয়োজক পাকিস্তানের কোনও কর্তা ছিলেন না। পিসিবি চেয়ারম্যান নকভি পূ্র্ব নির্ধারিত সরকারি সূচির জন্য রবিবার দুবাই যেতে পারেননি। তাঁর সমস্যার কথা আইসিসিকে আগেই জানিয়েছিল পিসিবি। প্রতিনিধি হিসাবে দুবাইয়ে পাঠানো হয় চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ডিরেক্টর এবং পিসিবির সিইও সুমাইর আহমেদকে। তিনি দুবাইয়ের স্টেডিয়ামে থাকলেও তাঁর উপস্থিতির কথা ঠিক মতো পৌঁছায়নি আইসিসির পক্ষে সমাপ্তি অনুষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্তদের কাছে। ফলে পুরস্কার দেওয়ার মঞ্চে ছিলেন না আয়োজক পিসিবির কোনও প্রতিনিধি। এ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হলেও আখেরে মুখ পুড়েছে সেই পাকিস্তানেরই।
২৯ বছর পর বিশ্বমানের প্রতিযোগিতা আয়োজনের দায়িত্ব পেয়েও প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পিছনের পায়ে খেলতেই বাধ্য হল পাকিস্তান। ২২ গজে এবং মাঠের বাইরেও। অথচ গত ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন হিসাবে কলার তুলেই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি উতরে দেওয়ার সুযোগ ছিল পাকিস্তানের। সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া একটি গানের কলি গুনগুন করতে পারেন রসিক সমালোচকেরা। সুযোগ করে দিল পাকিস্তানই!