E-Paper

কাপ জয়ের স্মৃতি ও সচিন-বন্দনা নিয়ে তৈরি ইতিহাসের ওয়াংখেড়ে

আগামী বৃহস্পতিবার ভারত-শ্রীলঙ্কা বিশ্বকাপের ম্যাচ। যার জন্য ধোনির ছক্কা-বেদি আরও বেশি করে চর্চায়। তবে শুধু ধোনি নন, মঙ্গলবার দেখা গেল, আরও এক কিংবদন্তির জন্যও মণ্ডপসজ্জা চলছে।

সুমিত ঘোষ

শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০২৩ ০৮:০৩
An image of Sachin Tendulkar

কিংবদন্তি: উন্মোচনের অপেক্ষায় সচিনের মূর্তি। মঙ্গলবার। ছবি: পিটিআই।

ওই তো সেই জায়গাটা! এখন মুম্বইয়ে এলে গেটওয়ে অব ইন্ডিয়া, হাজি আলি, সিদ্ধি বিনায়ক, বান্দ্রা-ওরলি সি লিঙ্ক বা ২০০৮-এর সেই অভিশপ্ত রাতে জঙ্গি হানা ঘটে যাওয়া তাজমহল হোটেলের মতো
দর্শনীয় স্থান।

মঙ্গলবার দুপুরে ওয়াংখেড়েতে গিয়ে খুব সহজেই ‘স্পট’ করা গেল। ঐতিহাসিক সেই রাতে যে ড্রেসিংরুম থেকে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটেছিলেন বিরাট কোহলি, সুরেশ রায়নারা, তার থেকে ত্রিশ গজ মতো ডানদিকে। আলাদা একটা ছাউনি করে তার মধ্যে দু’টো সুসজ্জিত চেয়ার বসিয়ে দিয়েছে মুম্বই ক্রিকেট সংস্থা। উপরে লেখা ‘আইসিসি ওয়ার্ল্ড কাপ ২০১১, ভিক্ট্রি মেমোরিয়াল স্ট্যান্ড’। ২ এপ্রিল, ২০১১ মহেন্দ্র সিংহ ধোনির কাপ জেতানো ছক্কা এখানেই এসে পড়েছিল। গ্যালারির সেই ছক্কার জায়গাকে সংরক্ষিত করেছে মুম্বই ক্রিকেট সংস্থা। আন্তর্জাতিক ম্যাচে ওই দুটি আসন নিলাম করা হয়। বিশ্বকাপ জয়ের ছক্কা যেখানে পড়েছিল, সেখানে বসে খেলা দেখতে চান? তা হলে নিলামে যোগ দিন। বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে পাঁচটি ম্যাচ পড়েছে ওয়াংখেড়েতে। জানা গেল, পাঁচটি ম্যাচের জন্য ওই দু’টি আসনের দাম উঠেছে ১০ লক্ষ টাকা। ভারতের সেমিফাইনাল পেয়েছে মুম্বই। সেই ম্যাচের নিলাম আলাদা করে হবে এবং ধরে নেওয়া যায় আরও চড়া দর উঠবে।

অভিনব ভাবনা! দুনিয়ার কত মাঠেই তো ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনাল হয়েছে। কোথাও এমন ছক্কা-বেদি করে দর্শক বা পর্যটক টানার উদ্যোগ দেখা যায়নি যে, এসে দেখে যাও। এখানেই আমাদের অধিনায়কের ছক্কাটা উড়ে এসে পড়েছিল।

আগামী বৃহস্পতিবার ভারত-শ্রীলঙ্কা বিশ্বকাপের ম্যাচ। যার জন্য ধোনির ছক্কা-বেদি আরও বেশি করে চর্চায়। তবে শুধু ধোনি নন, মঙ্গলবার দেখা গেল, আরও এক কিংবদন্তির জন্যও মণ্ডপসজ্জা চলছে। সচিন তেন্ডুলকর। তাঁর বিশাল মূর্তি তৈরি হয়ে গিয়েছে। ওয়াংখেড়েতে নিজের নামাঙ্কিত স্ট্যান্ডের পাশে বসছে। বুধবার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন। থাকবেন স্বয়ং সচিন। ভারতীয় দলের তারকাদেরও থাকার কথা।

এমনিতে বৃহস্পতিবারের ম্যাচকে বলা হচ্ছিল, ২০১১ ফাইনালের ‘রিমেক’। মানে অমিতাভ বচ্চনের ‘খাইকে পান বনারসওয়ালা’র পরে শাহরুখ খানের ‘ডন টু’ রিলিজ় হওয়ার মতো ব্যাপার। নতুন মোড়কে কী চমক নিয়ে উপস্থিত হয়, দেখতে চায় সকলে। প্রতিপক্ষ এক। মাঠ এক। যদিও সেটা ছিল বিশ্বকাপ ফাইনাল, এটা নিছকই গ্রুপ পর্বের ম্যাচ। তারিখেও হাল্কা মিল রয়েছে, যদিও মাসটা আলাদা। ২০১১-তে ছিল ২ এপ্রিল, ২০২৩-এ ২ নভেম্বর। তবে ওয়াংখেড়ের সামনে ট্যাক্সি থেকে নামামাত্র যে রকম গরমের হলকা মুখে ঝাপ্টা মারল, কে বলবে নভেম্বর! মনে হবে, এপ্রিলের গরমেই খেলা হচ্ছে।

সমস্যা হচ্ছে, গ্রুপ পর্বের মাঝপথেই দু’টি দলের মধ্যে এতটা তফাত তৈরি হয়ে গিয়েছে, ঠিক যতটা চোখে পড়ে কানাডা আর কাকদ্বীপের আবহাওয়ায়। ভারত ছয়ে ছয় জিতে পয়েন্ট টেবলের শীর্ষে। শ্রীলঙ্কা সাত নম্বরে পড়ে গোঙাচ্ছে। ছয় ম্যাচে মাত্র দু’টি জয়। আফগানিস্তানের কাছে হেরে ওয়াংখেড়েতে খেলতে আসছে। এমন ন্যাতানো প্রতিপক্ষকে দিয়ে কী করে সুপারহিট রিমেক হবে? শাহরুখ খান দূর অস্ত্‌, বাজিগরের শহরে বসে শ্রীলঙ্কাকে তো ফ্লপ নায়ক উদয় চোপড়াও ভাবা যাচ্ছে না। বরং কারও কারও মুখে চরম বিরক্তি-সহ শোনা গেল, আফগানিস্তানের ম্যাচটা অত আগে দিল্লিতে না হয়ে এখানে হলে বেশি জমত। রহমনুল্লা গুরবাজ়, রশিদ খান, মহম্মদ নবিরা মনে হয় এই শ্রীলঙ্কার চেয়ে অনেক ভাল দল।

এক-এক সময় আবার মনে হচ্ছে, ধুর, কীসের রিমেক? এ বারের অধিনায়কই তো ২০১১-র দলে ছিলেন না। নির্বাচকেরা তাঁকে দলে রাখেনইনি। বারো বছর পরে তিনিই ঘরের মাঠে হওয়া বিশ্বকাপে শুধু টস করতেই নামবেন না, ব্যাট হাতে দক্ষ নাবিকের মতো এগিয়ে নিয়ে চলেছেন জাহাজকে। ২০১১-তে ব্রাত্য থাকার ঝাল মেটানোর খিদে নিয়ে বৃহস্পতিবার নামলে অবাক হওয়ার নেই। সেই সঙ্গে রোহিত গুরুনাথ শর্মা নিশ্চয়ই দেখে গর্বিত হতে পারেন যে, এই বিশ্বকাপে এশীয় উপমহাদেশের একমাত্র উজ্জ্বল সূর্য হয়ে রোদ ঝলমলে দিন উপহার দিয়ে চলেছে শুধু তাঁর দল। পাকিস্তান ধুঁকছে। মঙ্গলবার ইডেনে ১০৫ বল বাকি থাকতে জিতলেও বাবর আজ়মদের সেমিফাইনাল যাওয়া অসম্ভব দেখাচ্ছে। বাংলাদেশ ছিটকে গিয়েছে, শ্রীলঙ্কারও আশা প্রায় নেই। বিশ্বমঞ্চে এশীয় ক্রিকেটের পতাকাবাহক হয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে শুধু ভারত।

ধোনির ছক্কা মারার জায়গাটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অবশ্য এশীয় ক্রিকেটের করুণ অবস্থার কথা মাথায় আসবে না। মন ছুটবে ফ্ল্যাশব্যাকে। মনে পড়ে যাবে সেই মায়াবী রাতে ঘটে যাওয়া পর-পর দুর্লভ ছবিগুলো। রুদ্ধশ্বাস থ্রিলারের মতো চিত্রনাট্য ছিল যেন। শ্রীলঙ্কা প্রথমে ব্যাট করে ২৭৪ তুলেছিল। মাঝ পর্বে অনেকের মনে হয়েছিল, বিশ্বকাপ ফাইনাল আন্দাজে স্কোরটা বেশ বড়। সহজ হবে না ভারতের পক্ষে। লাসিথ মালিঙ্গা সেই আশঙ্কাকে সত্যিতে পরিণত করার সব ব্যবস্থা করে ফেলেছিলেন। দ্বিতীয় বলে সহবাগকে তুলে নেন। ধাতস্থ হতে না হতেই উইকেটের পিছনে ক্যাচ দিয়ে ফিরে গেলেন সচিন তেন্ডুলকর। ওয়াংখেড়েতে সেই সময় যেন পিন পড়লেও শোনা যাবে। প্রতিযোগিতায় দুর্দান্ত ফর্মে থাকা যুবরাজ সিংহকে পিছিয়ে দিয়ে আগে ব্যাট করতে নামলেন মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। ড্রেসিংরুমে কোচ গ্যারি কার্স্টেনকে বলে এসেছেন, ‘‘গ্যারি, মুরলী বল করছে। আমার যাওয়া উচিত। তুমি যুবিকে বলে দাও, পরের উইকেটটা গেলে আমি যাব ব্যাট করতে।’’ কুচকাওয়াজের ভঙ্গিতে ড্রেসিংরুমের সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন। তার পরে গৌতম গম্ভীরের সঙ্গে দুর্ধর্ষ জুটি। ধোনির ব্যাটে সপাটে কুলশেখরকে মারা ছক্কায় মধুরেণ সমাপয়েৎ এবং কাপ জয়। রবি শাস্ত্রীর অমর ধারাভাষ্য, ‘‘ধোনি ফিনিশেস ইন স্টাইল, পার্টি বিগিন্‌স অ্যাট
মেরিন ড্রাইভ!’’

তখন কে ভেবেছিল, শাস্ত্রীর উচ্ছ্বাসকেও ছাপিয়ে গিয়ে অমর উক্তি পেশ করবেন বিরাট কোহলি। তখন তিনি তরুণ তুর্কি। সবে দলে এসেছেন। এখনকার মতো পরিপক্ক মহাতারকা নন। সচিনকে কাঁধে তুলে ওয়াংখেড়ে প্রদক্ষিণ করতে করতে কোহলি বলেন, ‘‘চব্বিশ বছর ধরে উনি আমাদের ক্রিকেটকে কাঁধে করে নিয়ে চলেছেন। আজ রাতে আমাদের পালা ওঁকে কাঁধে নিয়ে চলার।’’ কী সব অমর মুহূর্ত, কী সব অভাবনীয় ছবি!

২০১১ থেকে দু’জন ক্রিকেটার এই দলে আছেন। কোহলি ও অশ্বিন। মঙ্গলবার অনুশীলনে কোহলি এলেন না, অশ্বিন ছিলেন। বুধবার প্রাক-ম্যাচ প্রস্তুতিতে হয়তো দু’জনেই থাকবেন। তখন তাঁরা দু’জনে কি বাকি দলকে নিয়ে যাবেন ধোনির ওই ছক্কা-বেদির সামনে? শ্রীলঙ্কা হোক না দুর্বল প্রতিপক্ষ, অর্জুনরা তো পাখির চোখ দেখছেন— বিশ্বকাপ। সতীর্থদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য এর চেয়ে ভাল স্থান আর কোথায় পাবেন? হাড্‌ল করার সময় কোহলি যদি বলেন, ‘‘ওই যে দেখছ সিট দু’টো, ওখানে গিয়ে পড়ল অধিনায়কের ছক্কা। আমরা তির বেগে ছুটে এলাম মাঠের ভিতরে। গলা ধরে আসছিল সকলের। বিশ্বকাপ আমাদের। জীবনের সব চেয়ে বড় দিন। চলো, ফিরিয়ে আনি কাপ!’’ কার রক্ত না টগবগ করে ফুটবে!

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

ICC ODI World Cup 2023 India-Sri Lanka Wankhede Stadium 2011 ODI World Cup Final

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy