সকালেই প্রিয়াংশ আর্য বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, দিনটা কেমন যাবে। ব্যাট করতে নেমে প্রথম বলেই চেন্নাই সুপার কিংসের পেসার খলিল আহমেদকে পয়েন্টের উপর দিয়ে ছক্কা মেরেছিলেন তিনি। সেই শুরু। তার পরে আর থামল না তাঁর ব্যাট। অপর প্রান্তে একের পর উইকেট পড়লেও খেলার ধরন বদলাননি তিনি। শেষ পর্যন্ত ৩৯ বলে শতরান করলেন প্রিয়াংশ। ঘরোয়া ক্রিকেটার হিসাবে আইপিএলে দ্রুততম শতরান করলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত ৪২ বলে ১০৩ রান করে আউট হলেন প্রিয়াংশ। সাতটি চার ও ন’টি ছক্কার এই ইনিংসের দৌলতে ভারতীয় ক্রিকেটে আবির্ভাব হল আরও এক তরুণের।
প্রিয়াংশের ব্যাটে ভর করে ২০ ওভারে ৬ উইকেট হারিয়ে ২১৯ রান করল পঞ্জাব কিংস। তিনি বাদে প্রথম ছয় ব্যাটারের কেউ দু’অঙ্কের রান করতে পারেননি। ৮৩ রানে ৫ উইকেট পড়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে দলকে এত রানে নিয়ে যাওয়ায় প্রধান ভূমিকা প্রিয়াংশের। পাশাপাশি শশাঙ্ক সিংহ ৩৬ বলে ৫২ ও মার্কো জানসেন ১৯ বলে ৩৪ রান করেন।
চেন্নাইয়ের বোলারদের নিয়ে ছেলেখেলা করলেন প্রিয়াংশ। পেসার হোক বা স্পিনার, কাউকে রেয়াত করেননি তিনি। চেন্নাইয়ের পেসার মাথিশা পাথিরানা তাঁকে ক্রমাগত শর্ট বল করে সমস্যায় ফেলার চেষ্টা করলেন। তিনি একের পর এক বল বাউন্ডারির বাইরে পাঠালেন। তাঁর ইনিংস দেখে গ্যালারিতে পঞ্জাবের মালকিন প্রীতি জ়িন্টার উচ্ছ্বাস বুঝিয়ে দিচ্ছিল তিনি কতটা খুশি। প্রিয়াংশ যখন আউট হয়ে ফিরছেন তখন অধিনায়ক শ্রেয়স আয়ার তাঁর পিঠ চাপড়ে দিলেন। প্রিয়াংশের এই ইনিংস বুঝিয়ে দিল, তিনি লম্বা রেসের ঘোড়া।
দিল্লির ছেলে প্রিয়াংশ ভারতীয় ক্রিকেটে ততটা পরিচিত না হলেও নিলামে তাঁকে নিতে কাড়াকাড়ি হয়েছিল। ন্যূনতম মূল্য ছিল ৩০ লক্ষ টাকা। দিল্লি ক্যাপিটালস, মুম্বই ইন্ডিয়ান্স ও রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর বিরুদ্ধে লড়াই করে ৩ কোটি ৮০ লক্ষ টাকায় ২৩ বছরের প্রিয়াংশকে কেনে পঞ্জাব। কিন্তু কেন প্রিয়াংশকে কিনতে ঝাঁপিয়েছিল চারটি দল? নেপথ্যে ঘরোয়া ক্রিকেটে তাঁর পারফরম্যান্স।
গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে দিল্লি প্রিমিয়ার লিগে সর্বাধিক রান করেছিলেন প্রিয়াংশ। মাত্র ১০টি ম্যাচে ৬০০-র বেশি রান করেন এই বাঁহাতি ওপেনার। সাউথ দিল্লি সুপারস্টার্জ়ের হয়ে নর্থ দিল্লি স্ট্রাইকার্সের বিরুদ্ধে এক ওভারে ছ’টি ছক্কা মারেন প্রিয়াংশ। সেই ম্যাচে ২০ ওভারে তাঁর দল ৫ উইকেটে হারিয়ে ৩০৮ রান করেছিল। শুধু দিল্লি প্রিমিয়ার লিগ নয়, গত মুস্তাক আলিতেও দিল্লির হয়ে সর্বাধিক রান ছিল প্রিয়াংশের। সাতটি ম্যাচে ১৬৬.৯১ স্ট্রাইক রেটে ২২২ রান করেছিলেন তিনি। তার মধ্যে ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে উত্তরপ্রদেশের বিরুদ্ধে ৪৩ বলে ১০২ রান করেছিলেন তিনি। ভুবনেশ্বর কুমার, পীযূষ চাওলা, শিবম মাভিদের বিরুদ্ধে পাঁচটি চার ও ১০টি ছক্কা মেরেছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন:
সেই কারণেই নিলামে প্রিয়াংশকে নিয়ে কাড়াকাড়ি হয়েছিল। প্রথম ম্যাচ থেকেই পঞ্জাবের প্রথম একাদশে ছিলেন তিনি। ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসাবে খেলানো হচ্ছে তাঁকে। প্রথম ম্যাচে গুজরাত টাইটান্সের বিরুদ্ধে হাত খোলা শুরু করেছিলেনি প্রিয়াংশ। ২০ বলে ৪২ রান করে আউট হন। আগের ম্যাচে জফ্রা আর্চারের প্রথম বলেই অবশ্য বোল্ড হয়ে ফিরেছিলেন। মঙ্গলবার চেন্নাইয়ের বিরুদ্ধে জানিয়ে দিলেন, কেন তাঁকে এত গুরুত্ব দিচ্ছে পঞ্জাব।
ম্যাচের মাঝে প্রিয়াংশ জানিয়েছেন, নিজের স্বাভাবিক খেলা খেলেছেন তিনি। পঞ্জাবের ব্যাটার বলেন, “শ্রেয়স ভাই বলেছিল, ‘নিজের স্বাভাবিক খেলা খেল। যা মনে হচ্ছে সেটাই কর।’ আগের ম্যাচে প্রথম বলে আউট হয়েছিলাম। এই ম্যাচে ঠিক করেছিলাম, নিজের জায়গায় বল পড়লে ছক্কা মারার চেষ্টা করব। সেটাই করেছি। ব্যাটিং উপভোগ করেছি। পঞ্জাব আমার উপর ভরসা রেখেছে। সেই ভরসার দাম দিতে পেরে ভাল লাগছে।”

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
দিল্লির অশোক বিহারের বাসিন্দা প্রিয়াংশের বাবা পবন আর্য ও মা রাধাবালা আর্য দু’জনেই স্কুলে পড়ান। তাই তাঁদের নির্দেশ ছিল, ক্রিকেট খেললেও পড়াশোনা অবহেলা করলে চলবে না। পবন বলেন, “সাত বছর বয়সে প্রিয়াংশ আমাদের বলেছিল, ও ক্রিকেটার হতে চায়। তাতে আমাদের কোনও আপত্তি ছিল না। কিন্তু আমি ও আমার স্ত্রী দু’জনেই পড়াশোনার জগতের। তাই ওকে বলেছিলাম, খেলার পাশাপাশি পড়াশোনাও করতে হবে। সেটাও প্রিয়াংশ করেছে।”
আইপিএলে প্রিয়াংশের এই শতরানে রয়েছে গৌতম গম্ভীরের যোগও। ছোট থেকে প্রিয়াংশের কোচ সঞ্জয় ভরদ্বাজ। তিনি গম্ভীর, অমিত মিশ্রের মতো প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেটারদেরও কোচ। অর্থাৎ, প্রিয়াংশ ও গম্ভীর দু’জনেই একই গুরুর শিষ্য। ভারতীয় দলের বর্তমান কোচ গম্ভীরের নজর হয়তো এই ইনিংসের পর থেকেই পড়ে গেল প্রিয়াংশের উপর। সঞ্জয় জানিয়েছেন, প্রিয়াংশ যে বাকিদের থেকে আলাদ তা তিনি বুঝেছিলেন। তিনি বলেন, “আমি ছাত্রদের ‘ভি’ এর (মিড অফ থেকে মিড অনের মাঝের এলাকা) মধ্যে খেলতে বলি। কিন্তু প্রিয়াংশকে আমি কোনও দিন আটকায়নি। ও বরাবর বড় শট মারতে ভালবাসে। আমি বুঝেছিলাম ওটাই ওর শক্তি। তাই ওকে স্বাধীনতা দিয়েছি। সেটা কাজে লেগেছে।”