কম সমালোচনা শুনতে হয়নি তাঁকে। ‘কোটার’ অধিনায়ক বলা হয়েছে। এ-ও বলা হয়েছে যে দুর্বল দলকে হারিয়ে ভাগ্যের জোরে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে উঠেছেন। ফাইনালে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে সব সমালোচনার জবাব দিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক টেম্বা বাভুমা।
২৭ বছর পর দক্ষিণ আফ্রিকাকে আবার বড় প্রতিযোগিতা জিতিয়েছেন বাভুমা। এক কৃষ্ণাঙ্গ অধিনায়কের হাতেই হয়েছে শাপমুক্তি। ম্যাচ শেষে বাভুমা বলেন, “নিজেদের যোগ্যতায় ফাইনালে উঠেছিলাম। তার পরেও অনেকে সন্দেহ করেছিল। বলা হয়েছিল, দুর্বল দলকে হারিয়ে ফাইনালে উঠেছি। এই জয় তাদের জবাব।” টেস্টে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছেন, তা এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না বাভুমার। একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছেন তিনি। প্রোটিয়া অধিনায়ক বলেন, “মাঠে যা সমর্থন পেয়েছি, মনে হচ্ছিল নিজেদের দেশে খেলছি। আমাদের দেশের ক্রিকেটে এটা বিশেষ মুহূর্ত। টেস্ট বিশ্বকাপ জিতেছি, বিশ্বাস করতে কয়েক দিন সময় লাগবে।”
পর পর ১১টা আইসিসি প্রতিযোগিতায় ভাল খেলেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। সেমিফাইনালে উঠেছে। কিন্তু ফাইনালে ওঠা হয়নি। গত বার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেও ট্রফি জেতা হয়নি। বাভুমা জানিয়েছেন, প্রতি বার দরজা থেকে ফিরতে হয়েছে তাঁদের। সেই যন্ত্রণা এ বার মিটেছে। তিনি বলেন, “আমরা বার বার দরজায় ধাক্কা দিয়েছি। কিন্তু বার বার হতাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে। তাতে যন্ত্রণা বেড়েছে। প্রাক্তন ক্রিকেটারদের সেই হতাশা এত দিনে মিটল। সময় এ বার আমাদের সঙ্গে ছিল।” এই জয়ের কৃতিত্ব গোটা দলকে দিলেও বিশেষ দু’জনের কথা জানিয়েছেন বাভুমা। কাগিসো রাবাডা ও এডেন মার্করাম। দুই ইনিংস মিলিয়ে ৯ উইকেট নিয়েছেন রাবাডা। মার্করাম দ্বিতীয় ইনিংসে ম্যাচ জেতানো শতরান করেছেন। তাই তাঁদের কথা শোনা গিয়েছে অধিনায়কের মুখে।
বাভুমা নিজেও দুই ইনিংসেই রান করেছেন। কিন্তু এক বারও নিজের নাম করেননি তিনি। সামনে থেকে নেতৃত্ব দিলেও জয়ের কৃতিত্ব বাকিদের দিয়ে নিজে নেপথ্যে থেকেছেন অধিনায়ক। বাভুমা এমনই। দল জেতার পর যখন বাকিদের উচ্ছ্বাস বাঁধ মানছে না তখন বাভুমা ভাবলেশহীন চেয়ারে বসে। হাততালি দিচ্ছেন। তবে তাঁর মুখ বুঝিয়ে দিচ্ছিল, সব সমালোচনা, প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আনন্দ সেখানে। বাইরে তা প্রকাশ না করলেও ভিতরে ভিতরে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে দিচ্ছেন তিনি।
কেপ টাউনে লাঙ্গা এলাকা থেকে উঠে এসেছেন বাভুমা। লাঙ্গায় মূলত কৃষ্ণাঙ্গদেরই বসবাস। উনিশ শতকের শুরুর দিকে ব্রিটিশেরা লাঙ্গায় এসে থাকতে শুরু করে। অন্য অনেক জিনিসের পাশাপাশি লাঙ্গায় আমদানি হয় ক্রিকেটের। সেখানকার কৃষ্ণাঙ্গ জনজাতির মধ্যে দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে খেলাটি। তবে বেশির ভাগেরই পছন্দ ছিল বোলিং। ধীরে ধীরে লাঙ্গা থেকে একের পর এক বোলার উঠে আসতে থাকে। কিন্তু ব্যাটার উঠে আসছিল না। সেই অভাব মিটিয়েছেন বাভুমা।
আরও পড়ুন:
নেপথ্যে রয়েছেন তাঁর দুই কাকা। ছোট থেকেই বাভুমাকে ক্রিকেট শেখাতেন তাঁরা। মাত্র চার বছর বয়সেই ব্যাট হাতে ধরতে শিখে গিয়েছিলেন বাভুমা। ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর অভিষেক। প্রথম টেস্টে মাত্র ১০ এবং ১৫ রান করেছিলেন। পরের টেস্টে অর্ধশতরান করেন। ২০১৫-১৬ মরসুমে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে শতরান করে দলে নিজের জায়গা পাকা করে ফেলেন বাভুমা। তবে তখন থেকেই একটা তকমা তাঁর নামের পাশে সেঁটে গিয়েছে। তিনি ভাল খেলেন, কিন্তু তারকা হওয়ার জন্য যে মশলা দরকার সেটা তাঁর মধ্যে নেই। আজও এই তকমা বয়ে বেড়াতে হয়। বাভুমা ক্রিজ়ে নামবেন, ধরে খেলবেন, আস্তে আস্তে রান করবেন— এটাই যেন পরিচিত দৃশ্য। তিনি বিরাট কোহলির মতো কভার ড্রাইভ মারতে পারেন না, রোহিত শর্মার মতো পুল করতে পারেন না, জো রুটের মতো র্যাম্প শট মারতে পারেন না। কিন্তু দলের দরকার হলেই তিনি খেলে দেন।
অধিনায়ক হিসাবে ১০টা টেস্টের মধ্যে ৯টা জিতেছেন। সেই ১০টা টেস্টে তাঁর ব্যাটিং গড় প্রায় ৬০। বাইরের লোকেরা যতই সমালোচনা করুক না কেন, এই দলের বিশ্বাস রয়েছে বাভুমার উপর। এই দল তাঁকে অধিনায়ক মনে করেন। নইলে টেস্ট বিশ্বকাপের মেজ় (ট্রফি) তোলার পর যে ভাবে তাঁকে বাকিরা শ্যাম্পেনে স্নান করিয়ে দিলেন তা দেখে মনে হল, রাজার রাজ্যাভিষেক হল। টেস্টের সিংহাসনে বসলেন বাভুমা। সব সমালোচনার জবাব দিয়ে।