Advertisement
E-Paper

ঝড়ের পরেই দু’বলে ০! তবু বৈভবই ভবিষ্যতের সচিন-কোহলি, দরকার শুধু একজন রাহুল দ্রাবিড়

বৈভবের এখনও গোঁফের রেখা গজায়নি। ম্যাচের সেরা হওয়ার পর মাইক হাতে নিয়ে বলছিলেন, অনুশীলনের ফল পেয়েছেন। ১৪ বছর বয়সে কতটা অনুশীলন করেছেন তিনি যে এমন ইনিংস খেলা সম্ভব?

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০২ মে ২০২৫ ১৫:০৬
Vaibhab Suryavanshi

রাহুল দ্রাবিড়ের সঙ্গে বৈভব সূর্যবংশী। ছবি: পিটিআই।

বয়স মাত্র ১৪ বছর। ক্রিকেট শেখার সময়। কিন্তু মহম্মদ সিরাজ, ইশান্ত শর্মা, রশিদ খানদের অনায়াসে ছক্কা মেরেছে বৈভব সূর্যবংশী। ৩৫ বলে শতরান করা বৈভবই কি সুনীল গাওস্কর, সচিন তেন্ডুলকর, বিরাট কোহলির পর ভারতীয় ক্রিকেটে সেরা প্রতিভা? সোমবারের ঝড় আর বৃহস্পতিবারের ২ বলে শূন্য রানের ইনিংস দেখার পর বিচার করল আনন্দবাজার ডট কম।

সচিন প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছিলেন ১৬ বছর বয়সে। প্রথম ম্যাচে লাল বলের ক্রিকেটে তাঁর বিপক্ষে ছিলেন পাকিস্তানের ওয়াসিম আক্রম, ওয়াকার ইউনিস, ইমরান খানের মতো পেসার। ১৬ বছরের সচিনকে অবাক হয়ে দেখেছিল গোটা বিশ্ব।

একই ভাবে সকলকে অবাক করে দিয়েছে বৈভব। এ বারের আইপিএলে চারটি ম্যাচে ১৬টি ছক্কা মেরেছে। এটা শুধু স্কোরবোর্ড আর পরিসংখ্যান। আসল হল, বৈভবের খেলায় কোনও ভয়ডর নেই। রশিদের মতো স্পিনার ১০০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা গতিতে বল করছিলেন। তাঁকেও ছক্কা মেরেছে বৈভব। বুঝিয়ে দিয়েছে, কত দ্রুত ব্যাট ঘোরাতে পারে সে। ১৪ বছর বয়সে যা অবাক করে দেওয়ার মতোই। ছক্কাগুলো দেখার পর অনেকেই বৈভবের বয়স নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সন্দেহ তৈরি হয়েছে, এই বয়সে হাতের পেশি এত শক্তিশালী হওয়া সম্ভব? ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের পরীক্ষায় পাশ করেছে সে। ফলে বয়স নিয়ে সন্দেহ থাকার কোনও কারণ নেই।

বৈভবের এখনও গোঁফের রেখা গজায়নি। ম্যাচের সেরা হওয়ার পর মাইক হাতে নিয়ে বলছিল, অনুশীলনের ফল পেয়েছেন। ১৪ বছর বয়সে কতটা অনুশীলন করেছেন তিনি যে এমন ইনিংস খেলা সম্ভব? বৈভবের কোচ মণীশ ওঝা আনন্দবাজার ডট কম-কে বললেন, “আমার কাছে অনুশীলন করতে এসে দিনে ৫০০টা করে বল খেলত। প্রতি দিন অনুশীলনে আসা সম্ভব হত না ওর পক্ষে। কিন্তু যে দিন আসত, সে দিন ৫০০ বল খেলত। এটা সব বাচ্চার পক্ষে সম্ভব হয় না। বৈভব পারত। ওর সেই শারীরিক ক্ষমতা রয়েছে। সেই কারণেই ওকে ৫০০ বল খেলতে দিতাম।” মণীশ জানিয়েছেন, সাধারণত একজন ১৪ বছরের বাচ্চা দিনে ২০০-২৫০টা বল খেলে। অর্থাৎ, বৈভব অনুশীলনে দ্বিগুণ পরিশ্রম করত। সেই কারণেই কি সাফল্যও তাঁর কাছে দ্বিগুণ গতিতে ছুটে আসছে?

বৈভবের ছক্কা ৯০ মিটারেরও বেশি দূরে গিয়ে আছড়ে পড়ছে। এত বড় বড় ছক্কা মারার শক্তি ১৪ বছর বয়সে পাওয়া সম্ভব? রাজস্থান রয়্যালসের ব্যাটিং কোচ রাঠৌর বলেন, “বৈভব সাংঘাতিক প্রতিভাধর। টেকনিক্যালিও দুর্দান্ত। বল মারার সময় একটু বসে একটা বাড়তি শক্তি তৈরি করে। সোমবার ও সেটা দেখিয়ে দিয়েছে। বৈভবের এই ইনিংস নিয়ে অনেক কথা বলা যায়। ১৪ বছরের একটা ছেলে এই ভাবে খেললে অবাক তো হতেই হবে। চার মাস আগে ট্রায়ালে দেখেছিলাম ওকে। সেই সময় থেকেই জানি ও বাকিদের চেয়ে আলাদা। আমাদের উপর দায়িত্ব ছিল ওকে এই মঞ্চের জন্য তৈরি করা। কৃতিত্ব বৈভবের। ও চাপের মুখেও দারুণ মানসিক কাঠিন্য দেখিয়েছে। দুর্দান্ত ইনিংস খেলেছে।”

বৈভবের একের পর এক ছক্কা মারার নেপথ্যে রয়েছেন তাঁর কোচ মণীশও। তিনি বলেছেন, ‘‘এটা অসম্ভব কিছু নয়। পাওয়ার হিটিংয়ের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল আত্মবিশ্বাস। নিজের স্বাভাবিক ছন্দ অনুযায়ী খেলতে হয়। ছোট থেকে ওকে ফুলটস বলে অনুশীলন করাতাম। ছোটবেলায় বোলিং মেশিনের বল খেলতে পারত না। বলের গতি সামলাতে পারত না। তা ছাড়া বল পিচে পড়ে ওর মাথার উপর দিয়ে চলে যেত। তাই ফুলটস বলে অনুশীলন করাতাম। জোর দিতাম শটের টাইমিং এবং টেকনিকের উপর। সাধারণত ওকে ব্যাট একটু উঁচুতে তুলে ধরতে বলতাম। বলের লাইনে গিয়ে খেলতে বলতাম। যতটা জোরে সম্ভব বল মারার কথা বলতাম। ক্রিকেটের সব ধরনের শট ওকে শেখাতাম। কাট, পুল, ব্যাট-ফুট পাঞ্চ মারতে যেমন শিখিয়েছি, তেমনই বল ছাড়তেও শিখিয়েছি। হাত খুলে ব্যাট করতে বলতাম। লক্ষ করলে দেখবেন, ব্যাট করার সময় সূর্যবংশীর হাতের অবস্থান অনেকটা অভিষেক শর্মা বা যুবরাজ সিংহের মতো থাকে।’’

Vaibhav Suryavanshi

গুজরাত টাইটান্সের বিরুদ্ধে শতরানের পর বৈভব সূর্যবংশী। —ফাইল চিত্র।

সচিনও অবাক হয়ে গিয়েছেন বৈভবের ইনিংস দেখে। তিনি বলেছেন, “বৈভবের ইনিংসে কোনও ভয় ছিল না। দুর্দান্ত ব্যাট ঘোরানোর ক্ষমতা। খুব তাড়াতাড়ি বলের লেংথ বুঝতে পারছে। যে ভাবে শক্তি প্রয়োগ করছে বল মারার সময় তা অসাধারণ।”

১৪ বছর বয়সে তরুণ ক্রিকেটারেরা স্বপ্ন দেখেন, এক দিন যশস্বী জয়সওয়ালের সঙ্গে ব্যাট করবেন। বৈভব তা সত্যি করে ফেলেছে। শুধু তা-ই নয়, ১৪ বছরের কিশোরের খেলা দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল যশস্বী মন্থর ইনিংস খেলছেন। ২৩ বছরের যশস্বীকেও ম্লান করে দিয়েছিল ১৪ বছরের বৈভব।

বলিউডে একটি সিনেমা তৈরি হয়েছিল, ‘চ্যান কুলী কী ম্যায় কুলী’। যেখানে করণ (জৈন খান অভিনীত চরিত্র) তার জাদু-ব্যাট দিয়ে ক্রিকেট খেলত। সেই ব্যাটের জাদুতে বিপক্ষের তাবড় তাবড় বোলারকে ঠেঙিয়ে রান করত। ২০০৭ সালে সেই সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিল। বৈভবের জন্ম তার চার বছর পর। সিনেমার সেই গল্প সত্যি করে দিয়েছে সে।

গুজরাত টাইটান্সের বিরুদ্ধে যে ম্যাচে বৈভব শতরান করেছিল, সেই ম্যাচে তার বিরুদ্ধে বল করেছিলেন মহম্মদ সিরাজ, ইশান্ত শর্মা, প্রসিদ্ধ কৃষ্ণ, ওয়াশিংটন সুন্দর, রশিদ খান, করিম জনত এবং সাই কিশোর। তাঁরা প্রত্যেকেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছেন। এমন সাত জন বোলার মিলেও বৈভবকে আটকাতে পারেননি।

বাংলার অধিনায়ক অনুষ্টুপ মজুমদারের মতে বৈভব বিস্ময় প্রতিভা। ঘরোয়া ক্রিকেটে বৈভবের বিরুদ্ধে খেলেছেন তিনি। অনুষ্টুপ বললেন, “আমাদের বিরুদ্ধে ও মুকেশকে (কুমার) ছক্কা মেরেছিল। আগ্রাসী ক্রিকেট খেলতেই অভ্যস্ত বৈভব। আইপিএলে সেটাই জরুরি। বৈভবের খেলার ধরনের সঙ্গে আইপিএলে যে ভাবে খেলা হয়, তার মিল আছে। সেই কারণে ও এত বেশি সফল। সেই সঙ্গে রয়েছে ঈশ্বরপ্রদত্ত শক্তি এবং প্রতিভা।” তাঁর সংযোজন, “বৈভবের ক্রিকেট বোধ অনেকের চেয়ে বেশি। ও খুব তাড়াতাড়ি বুঝতে শিখেছে। এটা সকলের থাকে না। মানুষ হিসাবে পরিপক্বতা আসার আগে বৈভবের ক্রিকেটীয় পরিপক্বতা এসেছে। ক্রিকেটার হিসাবে যা বৈভবকে বাকিদের চেয়ে এগিয়ে দিয়েছে।”

Vaibhav Suryavanshi

অনূর্ধ্ব-১৯ ভারতীয় দলের হয়ে শতরান করেছিল বৈভব সূর্যবংশী। —ফাইল চিত্র।

বৈভবের ব্যাটিং দেখে অনেকেই মনে করছেন, সে প্রতিভা নিয়ে জন্মেছে। তবে শুধু প্রতিভা দিয়ে তো বড় ক্রিকেটার হওয়া যায় না। বিনোদ কাম্বলি বা পৃথ্বী শ-এর মতো ক্রিকেটারের প্রতিভা কম ছিল না। কিন্তু লাগামছাড়া জীবন তাঁদের কেরিয়ার শেষ করে দিয়েছিল। বিশ্ব ফুটবলে ব্রাজিলের রোবিনহো যেমন বহু ফুটবলারকে ছাপিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখতেন, ভারতে তেমন লালমপুঁইয়া। কিন্তু উচ্ছৃঙ্খল জীবনের বলি হন তাঁরা। কাম্বলি, লালমপুঁইয়ারা অনেক পরে নিজেদের ভুল বুঝতে পারেন। কিন্তু তত দিনে তাঁদের কেরিয়ার শেষ হয়ে গিয়েছে। তাঁদের সঙ্গে কেরিয়ার শুরু করা ক্রিকেটার, ফুটবলারেরা পৌঁছে গিয়েছেন সর্বোচ্চ শৃঙ্গে। সেই জায়গায় পৌঁছোতে হলে বৈভবকেও অনেক কিছু ত্যাগ করতে হবে।

বৈভবের এখন প্রয়োজন রাহুল দ্রাবিড়কে। যিনি ১৪ বছরের কিশোরের জীবনে আনবেন শৃঙ্খলা। ক্রিকেট থেকে মন যাতে সরে না যায়, সেই দিকে নজর রাখেবন। সেই কাজ যদিও শুরু হয়ে গিয়েছে। দ্রাবিড় মানেই তরুণ ক্রিকেটারদের তুলে আনার কাহিনি। জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে থাকার সময় দ্রাবিড়ের হাত ধরেই তৈরি হয়েছিলেন যশস্বী জয়সওয়াল, শুভমন গিলের মতো ক্রিকেটার। ভারতীয় দলের কোচ থাকার সময়ও তরুণ ক্রিকেটারদের সুযোগ দিয়েছেন। রাজস্থান রয়্যালস ইতিমধ্যেই বৈভবকে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে নিষেধ করেছে। দ্রাবিড় হয়তো চাইছেন না বৈভবের মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটুক। তার যত্ন নেওয়া শুরু করে দিয়েছে রাজস্থান। নিলামে বৈভবকে দলে নেওয়ার পর তার কোচ সৌরভ কুমার বলেছিলেন, “দুর্দান্ত সুযোগ। দেশের অন্যতম সেরা কোচ দ্রাবিড়। তার সঙ্গে সাজঘর ভাগ করে নেওয়ার সুযোগ পাবে বৈভব। অনেক কিছু শিখতে পারবে। এত কম বয়সে দ্রাবিড়ের মতো কোচের সান্নিধ্য পাওয়াটা বিরাট ব্যাপার।” একই মত কোচ মণীশেরও।

গুজরাতের বিরুদ্ধে শতরানের পর গাওস্করও বলেছিলেন দ্রাবিড়ের কথা। ভারতের প্রাক্তন অধিনায়ক বলেছিলেন, “নিলামে ডাক পাওয়ার আগেই অস্ট্রেলিয়ার অনূর্ধ্ব-১৯ দলের বিরুদ্ধে শতরান করেছিল বৈভব। মানছি ওটা সিনিয়র দল নয়, কিন্তু একটা আন্তর্জাতিক দলের বিরুদ্ধে ১৩ বছর বয়সে শতরান করা সহজ নয়। ওর খেলায় এখনও অনেক উন্নতি প্রয়োজন। দ্রাবিড়ের সঙ্গে বসতে হবে। তা হলে শিখতে পারবে কী ভাবে ইনিংস গড়তে হয়। আগামী দিনে আরও উন্নতি করবে বৈভব। এখনই ওকে আকাশছোঁয়া শুভেচ্ছায় ভরিয়ে দেওয়া উচিত হবে না।”

আইপিএলে কোচ হিসাবে বৈভব পেয়ে গিয়েছে দ্রাবিড়কে। ভারতকে বিশ্বকাপ জেতানো কোচ অবশ্যই সঠিক পথ দেখাবেন বৈভবকে। সেই পথে এগোতেও হবে তাকে। কোচের পরে আসে পরিবারের ভূমিকা। ২০০৮ সালে ভারতীয় ক্রিকেটে উত্থান তরুণ বিরাট কোহলির। কিন্তু সেই সময় তাঁর জীবনে শৃঙ্খলা ছিল না। নৈশপার্টিতে মেতে থাকতেন। অনিয়ন্ত্রিত খাওয়াদাওয়া তাঁকে ক্রিকেট থেকে লক্ষ্যচ্যুত করেছিল। ধীরে ধীরে নিজেকে বদলান। সেই বদলের নেপথ্যে ছিলেন তৎকালীন প্রেমিকা (এখন স্ত্রী) অনুষ্কা শর্মা। তাঁর হাত ধরেই খাওয়াদাওয়ায় বদল করেন কোহলি। নৈশপার্টি, মদ্যপান ছেড়ে তাঁর ধ্যানজ্ঞান হয়ে যায় শুধুই ক্রিকেট। তাতেই বিশ্বসেরা ক্রিকেটার হয়ে ওঠেন। নিজের অভিনয়ের কেরিয়ার ত্যাগ করে কোহলিকে তৈরি করেছিলেন অনুষ্কা। সচিন পাশে পেয়েছিলেন স্ত্রী অঞ্জলিকে। অঞ্জলিও নিজের ডাক্তারি পেশা ছেড়ে ভারতের সেরা ব্যাটারের সংসার সামলেছিলেন। দুই ছেলেমেয়েকে বড় করেছিলেন। বিদায়ী টেস্টের পর সচিন জানিয়েছিলেন, অঞ্জলি সংসার না সামলালে তাঁর পক্ষে সারা বিশ্ব ঘুরে খেলাই সম্ভব হত না।

১৪ বছরের বৈভব সদ্য জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেছে। একটা ম্যাচে আকাশ ছোঁয়ার পর পরের ম্যাচেই মাটিতে নেমে এসেছে। আগামী দিনে ক্রিকেট থেকে তার লক্ষ্য সরে গেলে কাম্বলির মতো অবস্থা হতে পারে। কিন্তু কোহলির মতো লক্ষ্যে স্থির থাকতে পারলে বৈভব যে ভারতীয় ক্রিকেটের পরবর্তী পতাকাবাহক হবেন, তা নিয়ে সন্দেহ নেই।

Vaibhav Suryavanshi Rajasthan Royals Team India
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy