২০২৪ সালের আইপিএলে ১৩ ম্যাচে ১৯ উইকেটই তাঁকে লটারির ‘জ্যাকপট’ পাইয়ে দিয়েছিল? যে টিকিটে একমাত্র তাঁরই নাম লেখা থাকবে? কেরিয়ারে প্রথম শ্রেণির ম্যাচের সংখ্যা মাত্র ১৩! কিন্তু ভারতের হয়ে তিন ফরম্যাটেই খেলে ফেলেছেন ২৩ বছরের হর্ষিত রানা।
২০২৪ সালের আগে সর্বভারতীয় স্তরে তাঁর নাম খুব একটা শোনা যায়নি। ২০২২ সালে আইপিএলে কলকাতা নাইট রাইডার্সে পরিবর্ত ক্রিকেটার হিসাবে এসেছিলেন হর্ষিত। ২০২২ এবং ২০২৩ সাল মিলিয়ে খেলেছিলেন মোট ৬টি ম্যাচ। উইকেটের সংখ্যাও ৬। কিন্তু ২০২৪ সাল হর্ষিতের কেরিয়ারের ‘টার্নিং পয়েন্ট’। কেকেআরের ‘মেন্টর’ হয়ে আসেন গৌতম গম্ভীর। সেই আইপিএলে হর্ষিত ছিলেন চতুর্থ সর্বাধিক উইকেটশিকারি। আর কেকেআর চ্যাম্পিয়ন।
সেই শুরু গম্ভীর-হর্ষিত রসায়নের। এমনিতে দু’জনেই দিল্লির বাসিন্দা। দু’জনেই খানিকটা রগচটা। বিভিন্ন ম্যাচে প্রতিপক্ষের সঙ্গে গোলমালে জড়িয়েছেন। কিন্তু সে তো অনেকেই এমন করে থাকেন। সকলের সঙ্গে সকলের রসায়ন তো তৈরি হয় না। এ ক্ষেত্রে হয়েছে। ভারতীয় ক্রিকেট এবং আইপিএলের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল লোকজন মনে করেন, ২০২৪ সালের আইপিএল-ই গম্ভীর-হর্ষিতের ‘ম্যাচ’ শুরু করেছিল। গম্ভীর আগে কেকেআরের অধিনায়ক ছিলেন। মনে রাখতে হবে, তাঁর অধিনায়কত্বেই নাইট রাইডার্স দু’বার আইপিএল চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। ঘরের ছেলে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ও যা পারেননি। সেই গম্ভীর যখন সেই দলেরই মেন্টর হয়ে এলেন, তখন তাঁর উপর বাড়তি চাপ ছিল পারফর্ম করার। কারণ, তার আগের বছর ঘরোয়া ক্রিকেটে সফল কোচ চন্দ্রকান্ত পণ্ডিতের পাঠশালায় পড়ে ডাহা ফেল করেছে কেকেআর। পণ্ডিতকে বহাল রেখেই গম্ভীরকে তাঁর মাথায় বসিয়ে দিয়েছিলেন শাহরুখ খান। ভারতীয় ক্রিকেট প্রশাসনের সঙ্গে জড়িত এক আঞ্চলিক কর্তার কথায়, ‘‘গম্ভীরের উপর দুটো চাপ ছিল। প্রথমত, ক্যাপ্টেন হয়ে কেকেআরকে চ্যাম্পিয়ন করার পাশাপাশি মেন্টর হিসাবেও সফল হওয়ার চাপ। দ্বিতীয়ত, টেবিলের একেবারে তলায় থাকা একটা দলের মনোবল বাড়িয়ে তাদের সফল করা। হর্ষিতের পারফরম্যান্স মেন্টর গম্ভীরের দুটো চাপই সামলে দিয়েছিল। কেউ ভাবেনি, কেকেআর ওই ভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে আইপিএল ট্রফি নিয়ে যাবে।’’ ওই কর্তার ব্যাখ্যায়, ‘‘যে কোনও সম্পর্কের একটা ‘ইট মোমেন্ট’ থাকে। ২০২৪ সালের আইপিএল গম্ভীর-হর্ষিতের সম্পর্কের সেই ‘ইট মোমেন্ট’ ছিল। তার পর থেকে গুরু-শিষ্যের সেই সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে।’’ বস্তুত, ওই ক্রিকেটকর্তা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘হর্ষিত কিন্তু খারাপ বোলার নয়। হয়তো বুমরাহ বা সিরাজ নয়। কিন্তু জোরে বোলার হিসাবে একেবারে ফেলে দেওয়ার মতোও নয়।’’
কেকেআরের অনুশীলনে গৌতম গম্ভীর ও হর্ষিত রানা। —ফাইল চিত্র
যে কোনও ক্রিকেটপোষ্যই জানবেন, কেকেআরের মেন্টর হিসাবে তুঙ্গ সাফল্যই গম্ভীরের সামনে ভারতীয় ক্রিকেট দলের হেড কোচ হওয়ার দরজা খুলে দিয়েছিল। ফলে ২০২৫ সালের আইপিএলে গম্ভীর আর কেকেআরের সঙ্গে যুক্ত থাকেননি। কেকেআর-ও ফিরে গিয়েছে তাদের গম্ভীর-পূর্ব যুগে। চলতি বছরের আইপিএলে তারা আবার তলানিতে।
প্রসঙ্গত, গম্ভীর কেকেআর ছেড়ে চলে গেলেও হর্ষিত কোথাও যাননি। এ বার ১৩ ম্যাচে তিনি নিয়েছেন ১৫টি উইকেট। তবে তাঁকে গম্ভীর-ছাড়া হয়ে থাকতে হয়নি। তাঁর কোচিংয়েই ভারতীয় দলে অভিষেক হয়েছে হর্ষিতের। গত বছর নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি, চার মাসের ব্যবধানে তিন ফরম্যাটেই হর্ষিত খেলেছেন ভারতীয় দলে। এখনও পর্যন্ত দু’টি টেস্ট, পাঁচটি এক দিনের ম্যাচ এবং তিনটি টি-টোয়েন্টি খেলেছেন তিনি। প্রাক্তন ক্রিকেটারদের একাংশ হর্ষিতকে নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। অনেকের বক্তব্য, বিরাট কোহলি-রোহিত শর্মাদের যখন বলা হচ্ছে, ঘরোয়া ক্রিকেট খেলে নিজেদের যোগ্যতা করতে, তখন হর্ষিতের উপর এমন কোনও ‘শর্ত’ আরোপ করা হচ্ছে না কেন?
প্রত্যাশিত ভাবেই কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন কোচ গম্ভীর। বলেছেন, ইউটিউব চ্যানেল চালানোর জন্য একটি ২৩ বছরের বাচ্চার সমালোচনা করা হচ্ছে। তাঁর কথায়, ‘‘এটা খুব লজ্জাজনক। আপনার ইউটিউব চ্যানেল চালাতে একটা ২৩ বছরের বাচ্চার সমালোচনা করলে সেটা অন্যায়। এরা ২৩ বছরের বাচ্চাকেও ছাড়ছে না!’’ হর্ষিত সম্পর্কে গম্ভীরের বক্তব্য, ‘‘ওর বাবা বোর্ডের প্রাক্তন চেয়ারম্যান নন। প্রাক্তন ক্রিকেটার বা এনআরআই-ও নন। ও যতদূর ক্রিকেট খেলেছে নিজের যোগ্যতা, নিজের দমে খেলেছে। সেটাই ও করবে। একজনকে এ ভাবে নিশানা করা উচিত নয়। সমালোচনা করতে হলে ওর পারফরম্যান্স নিয়ে করুন। নির্বাচকদের বলুন! ২৩ বছরের একটা বাচ্চাকে নিয়ে সমাজমাধ্যমে এত খারাপ কথা বললে ওর মানসিকতা কী রকম হবে?”
ভারতের হয়ে টেস্ট ম্যাচে হর্ষিত রানা। —ফাইল চিত্র
চুয়াল্লিশ বছরের গম্ভীর অবশ্য ভারতীয় দলের তরুণ প্রজন্মের প্রায় সমস্ত ক্রিকেটারকেই ‘বাচ্চা’ বলেই সম্বোধন করেন। ব্যতিক্রম কোহলি, রোহিত, জাডেজারা। যাঁরা তাঁর সঙ্গে ক্রিকেট খেলেছেন। সম্ভবত সেই কারণেই তিনি সিনিয়রদের নিয়ে খানিকটা ‘অস্বস্তি’তে থাকেন। তবে ম্যানেজমেন্ট মন্ত্র শেখায়, যখনই যিনি কোথাও কোনও দায়িত্বে যান, তিনি নিজস্ব ‘টিম’ তৈরি করেন। সে যে কোনও দলগত বিষয়েই হোক। রাজনীতি, খেলা-সহ আরও বিভিন্ন পেশায় এ জিনিস সনাতন। গম্ভীর কেন ব্যতিক্রম হতে যাবেন?
তবে এ কথা ভারতীয় ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িতদের প্রায় সকলেই জানেন যে, হর্ষিত গম্ভীরের ‘ঘরের ছেলে’। ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় টেস্টের আগে দিল্লিতে নিজের বাড়িতে ভারতীয় ক্রিকেটারদের নৈশভোজে ডেকেছিলেন গম্ভীর। সেখানে ক্রিকেটারেরা পৌঁছোনোর আগেই চলে গিয়েছিলেন হর্ষিত। যিনি দিল্লি টেস্টের ১৫ জনের দলে ছিলেন না। যা থেকে স্পষ্ট যে, হর্ষিত গম্ভীরের কাছে পরিবারের সদস্যের মতোই।
অনেকেই বলেন, গম্ভীরের প্রতি হর্ষিতের ‘আনুগত্য’ তুলনাহীন। তবে তাকে ‘দোষ’ বলতে নারাজ তাঁরা। তাঁদের বক্তব্য, বিভিন্ন সময়েই ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ মানুষের মধ্যে কাজ করে। তার প্রভাব পেশাদার সিদ্ধান্তে পড়া উচিত নয়, এটা যেমন কাম্য, তেমনই এটাও সত্য যে, প্রায় কেউই সেই প্রভাব কাটিয়ে বেরোতে পারেন না। মহেন্দ্র সিংহ ধোনি বা কোহলিও পারেননি। প্রথমজন জোর করে রোহিত শর্মাকে খেলাতেন। দ্বিতীয়জন ঋদ্ধিমান সাহাকে। তবে রোহিত-ঋদ্ধি সেই পছন্দের প্রতিদান দিয়েছিলেন নিজেদের পারফরম্যান্সে।
২০২২ সাল থেকে দিল্লির হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলেন হর্ষিত। জাতীয় দলে সুযোগ পান ২০২৪ সালে। মাঝের দু’বছরে যে ১৩টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছেন, তা-ও মূলত সাদা বলের ক্রিকেটে। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে যে টেস্ট সিরিজ়ে লাল বলের ক্রিকেটে হর্ষিতের অভিষেক হয়, সেখানেও প্রথম দলে ছিলেন না তিনি। অতিরিক্ত ক্রিকেটার হিসাবে গিয়েই সরাসরি টেস্ট অভিষেক। চলতি বছরে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির দলে মহম্মদ সিরাজ জায়গা না পেলেও হর্ষিত পেয়েছিলেন। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজ়ের দলেও ছিলেন না। তার পরেও স্রেফ গম্ভীরের ‘সুপারিশে’ দলের সঙ্গে গিয়েছিলেন হর্ষিত। ছিলেন এশিয়া কাপের দলেও। অর্থাৎ, দু’বছরে দেশের হয়ে দু’টি আইসিসি ট্রফিজয়ী দলের সদস্য থেকেছেন তিনি। তবে পাশাপাশিই দিল্লি প্রিমিয়ার লিগে অনামী ব্যাটাররদের কাছে ঠ্যাঙানি খেয়েছেন। কেকেআরের হয়ে উইকেট নিলেও প্রতি ম্যাচে তাঁর ইকোনমি ১০ রানের বেশিই থাকে।
যাকে ‘ম্যাচ উইনার’ বলে, হর্ষিত তা নন। তাঁর প্রধান শক্তি বলের গতি। ঘণ্টায় ১৪৫ কিলোমিটার গতিতে বল করতে পারেন। মূলত গুডলেংথেই বল করেন। বাউন্সারের উপর জোর দেন। যেমন ওই ক্রিকেটকর্তা বলেছিলেন, ‘‘একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো বোলার নয়।’’
ম্যাচ জেতাতে পারেননি এখনও। তবে গম্ভীরের মন জিতেছেন। হর্ষিত রানা হওয়ার ‘উপকারিতা’।