Advertisement
০৭ মে ২০২৪

ভুলবেন না, কেন আপনি রাজনীতিতে এসেছিলেন

সব সময়ে নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে ইমরানের সম্পর্ক ভাল ছিল না। ১৯৯২ বিশ্বকাপের সময়ে বরং খুবই তিক্ত হয়ে উঠেছিল আমাদের সম্পর্ক। কিন্তু কাছ থেকে ওঁকে দেখে দু’টো জিনিস মনে হয়েছে। ইমরান সব সময়ে শিরোনামে থাকতে চান। পার্শ্বচরিত্র হয়ে থাকাটা ওঁর পছন্দ নয়। অবসর নেওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই যে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন, সেটা প্রচারের আলো থেকে সরতে চান না বলেই।

নেতা: ভোটে জিতে টিভিতে বক্তৃতা ইমরান খানের। টুইটার

নেতা: ভোটে জিতে টিভিতে বক্তৃতা ইমরান খানের। টুইটার

কামার আমেদ
শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০১৮ ০৩:১২
Share: Save:

ওয়ান ডে ক্রিকেটে যে রকম রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি দেখা যায়, আমাদের ক্যাপ্টেনের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচনকে ঘিরেও যেন সে রকমই নাটকীয়তা চলল।

১৯৪৭-এ জন্মলগ্ন থেকে পাকিস্তানের রাজনীতি অনেক বিতর্ক, অনেক সমস্যার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। ইমরানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার লগ্নটা ঐতিহাসিক দু’টো কারণে। একে তো জনতার প্রিয় ক্রিকেট তারকা, দেশের ইতিহাসে অন্যতম সেরা অধিনায়ক, পাকিস্তানকে বিশ্বকাপ জেতানো অধিনায়ক দেশের নেতৃত্ব ভার তুলে নিচ্ছেন। যে-হেতু ইমরান, গোটা দুনিয়া পাকিস্তানের এই নির্বাচনকে ঘিরে আগ্রহী হয়ে পড়েছিল। দ্বিতীয়ত, গত সত্তর বছরে পাকিস্তানের ইতিহাসে মাত্র দ্বিতীয়বার অসামরিক সরকারের হাত থেকে আর একটি অসামরিক সরকার দায়িত্ব নিচ্ছে।

যদিও বলা যাবে না যে, বিতর্কহীন নির্বাচন হয়েছে। নওয়াজ শরিফ তৃতীয় বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিতাড়িত হলেন। এবং, তিন বারই তাঁর মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। এ বারের নির্বাচনের সময়ে জেলে কাটাতে হয়েছে তাঁকে। দুর্নীতির অভিযোগকে নস্যাৎ করার মতো যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি নওয়াজের দিক থেকে। দেশ-বিদেশে জমা করা ঐশ্বর্যের হিসেব দিতে পারেননি।

ইমরানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উদয় হওয়াটা এই কারণেই ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। ক্রিকেটার হিসেবে মহাতারকা ছিলেন তিনি। আমি খুব কাছ থেকে দীর্ঘ দিন ধরে ওঁকে দেখেছি, ওঁর প্রচুর খেলা কভার করেছি। সব সময়ে নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে ইমরানের সম্পর্ক ভাল ছিল না। ১৯৯২ বিশ্বকাপের সময়ে বরং খুবই তিক্ত হয়ে উঠেছিল আমাদের সম্পর্ক। কিন্তু কাছ থেকে ওঁকে দেখে দু’টো জিনিস মনে হয়েছে। ইমরান সব সময়ে শিরোনামে থাকতে চান। পার্শ্বচরিত্র হয়ে থাকাটা ওঁর পছন্দ নয়। অবসর নেওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই যে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন, সেটা প্রচারের আলো থেকে সরতে চান না বলেই।

একটা সময়ে যিনি বিশ্ব ক্রিকেটে সেরা অলরাউন্ডার হওয়ার লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন স্যর ইয়ান বোথাম, কপিল দেব, স্যর রিচার্ড হ্যাডলির সঙ্গে, যিনি ছিলেন ক্রিকেটের সর্বসেরা ‘সেক্স সিম্বল’, তাঁর পক্ষে প্রচারের আড়ালে চলে যাওয়াটা সহজ হত না। দ্বিতীয়ত, ইমরানের রাজনীতিতে আসার আর একটা বড় কারণ পাকিস্তানে দুর্নীতি বন্ধ করা। পঞ্জাবে বড় হওয়ার সময় তিনি চোখের সামনে দেখেছেন বৈষম্য, আর্থিক কেলেঙ্কারি আর দুর্নীতিতে ভরা রাজনীতি। নিজের শিক্ষা আর সংস্কৃতি দিয়ে পাকিস্তানের ‘কমন ম্যান’-এর প্রতি অন্যায় অবিচার বন্ধ করার শপথ নিয়েই তাঁর রাজনীতিতে আসা।

প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে ইমরানের সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হতে যাচ্ছে এটাই। পাকিস্তানকে দুর্নীতিমুক্ত করা। কারণ, আমাদের দেশের অনেক মানুষ কিন্তু ইমরান খান বলতে দুর্নীতিমুক্ত, পরিষ্কার ভাবমূর্তির এক নেতাকে দেখতে চাইবে। সেই নেতা যিনি ক্রিকেট মাঠে পাকিস্তানকে বিজয়ী করে তুলেছিলেন। সেই নেতা যিনি পাক আম্পায়ারদের নিয়ে বিতর্কের কথা জেনেও বিশ্ব ক্রিকেটে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ক্রমাগত নিরপেক্ষ আম্পায়ারের জন্য সওয়াল করে গিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরান নিজে কতটা নিরপেক্ষ আম্পায়ারের ভূমিকা গ্রহণ করতে পারেন, সেটা অনেকে দেখতে চাইবে।

জাভেদ বার্কি আর মজিদ খানের মতো অধিনায়কের পরিবার থেকে এসেছেন ইমরান। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির নেতৃত্ব দেওয়া দিয়ে ক্যাপ্টেন্সি শুরু। তার পর পাক অধিনায়ক হিসেবে অনেক শৃঙ্গই জয় করেছেন। প্রথম পাক অধিনায়ক হিসেবে ভারতে টেস্ট সিরিজ জয়। প্রথম বার পাকিস্তানকে বিশ্বকাপ জেতানো। তা-ও আবার সেই বিশ্বকাপ জয় এসেছিল অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে। অস্ট্রেলিয়ায় পাকিস্তানকে দ্বিপাক্ষিক সিরিজে জেতানো। খেলার মাঠে ক্যাপ্টেন হিসেবে ইমরান অনেক পুরনো সংস্কার ভেঙে পাকিস্তানকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। ক্রিকেট মাঠে দাঁড়িয়ে ক্যাপ্টেন্সি করা আর দেশকে নেতৃত্ব দেওয়া নিশ্চয়ই এক ব্যাপার নয়। বিশ্বের মানুষ আশা করবে, পাকিস্তানে স্বৈরাচারী শাসনের ইতিহাসকে উপড়ে ফেলে নতুন যুগের সূচনা হোক ইমরানের হাত ধরে।

মাঝেমধ্যে খুব কৌতূহল হচ্ছে, ইমরানের এত সব গার্লফ্রেণ্ডরা আজ কী করছেন? ক্রিকেটের সেরা প্লে-বয় ক্যাপ্টেন যে আজ দেশের নেতা। ইংল্যান্ডের চিত্রশিল্পী এমা সার্জেন্ট। সুসানা কনস্টান্টাইন। লর্ড হোয়াইটের মেয়ে সিতা হোয়াইট, যাঁর সঙ্গে ইমরানের একটি কন্যাসন্তানও আছে বলে শোনা যায়। এবং, অবশ্যই বলিউডের জিনাত আমন। এই নামগুলো সকলের মুখে মুখে ঘুরেছে কত দিন ধরে। এর বাইরে আরও কত নাম ছিল! সেগুলো সব গোপনই থেকে গিয়েছে। পাকিস্তানে ইমরানের এই ‘লেডিকিলার’ ভাবমূর্তিকে কিন্তু প্রতিপক্ষ পার্টি অনেক সময়েই হাতিয়ার করতে চেয়েছে। কখনওসখনও সফলও হয়েছে। এ বারে যদিও সেটা কাজ দিচ্ছে না।

ইমরানের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ওঠা-নামা করতে পারে ক্রিকেট ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে যাওয়ার মতোই। সেটা আমার চেয়ে ভাল কেউ জানে না। লন্ডনের শেফার্ডস বুশে আমার ফ্ল্যাট আছে। সেখানে অনেক সময়েই অনেক পাক ক্রিকেটার অতিথি হিসেবে কাটিয়ে গিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন কোনও এক ইমরান খানও। ফ্ল্যাটের চাবি থাকত আমার বন্ধুদের কাছেও। এক বার হল্যান্ড থেকে লন্ডনে আমার ফ্ল্যাটে ফিরে বসে আছি। হঠাৎ শুনি, বাইরে থেকে ফ্ল্যাটের দরজা খোলার শব্দ। কে ঢুকল? রান্নাঘরে গিয়ে দেখি, ইমরান। দিব্যি চা বানিয়ে খাচ্ছেন। আমাকে দেখে তক্ষুনি বললেন, সরি। তোমার বন্ধুর থেকে চাবি পেয়েছি।

ইমরান তখন কাউন্টি খেলছেন। খুব ভাল বন্ধুত্বও হয়ে গেল আমার সঙ্গে। এর পর প্রায়ই আমার ফ্ল্যাটে বসেছে দারুণ সব আড্ডা। কাউন্টি ম্যাচ না থাকলে জাভেদ মিয়াঁদাদ, ইমরান, সরফরাজ নওয়াজরা এক সঙ্গে এসেছেন। ইমরানকে পছন্দ করতেন না মিয়াঁদাদ আর সরফরাজ। সেটা ইমরানের সামনেই ধরা পড়ত। কয়েক দিন পরে দেখলাম, ইমরান আমার ফ্ল্যাটে আসা বন্ধ করে দিলেন। ওঁকে নাকি কে বলেছে, ওঁর আসাটা আমার পছন্দ হচ্ছে না।

প্রধানমন্ত্রী ইমরানকে নিয়ে এই একটা ব্যাপার ভেবে একটু আশঙ্কাই হচ্ছে আমার। আগের মতো অন্যের কথা বিশ্বাস করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন না তো উনি? আমার যে সেই অভিজ্ঞতা রয়েছে। দিল্লি নিবাসী এক ভারতীয় সাংবাদিক এক বার আমার সম্পর্কে ওঁর কাছে মিথ্যে কথা বানিয়ে বললেন। আর সেটাকে বিশ্বাস করে আমার সঙ্গে শত্রুতা শুরু করে দিয়েছিলেন ইমরান। ১৯৯২ বিশ্বকাপের সময় অ্যাডিলেডে ফ্লাইটের মধ্যে আমাদের প্রায় ঘুষোঘুষি হওয়ার উপক্রম হয়। গোটা বিশ্বকাপ আমরা কেউ কারও সঙ্গে কথা বলিনি। বিমানের মধ্যে আমার দিকে তেড়ে আসতেও ছাড়েননি। মিয়াঁদাদ এসে ঠেকিয়েছিলেন। প্রায় দশ বছর কথা বন্ধ ছিল আমাদের। কে বলবে, এই ইমরানের সঙ্গেই এক সময়ে খোলা মনে কত গল্প হয়েছে লন্ডনের ফ্ল্যাটে বসে!

পরে অবশ্য ইমরানের সঙ্গে আবার কথা হয়েছে আমার। পুরনো সেই ঘটনা ভুলে দু’জনেই এগিয়ে গিয়েছি। আমার মনে হয়, ক্রিকেটের দিনের মতোই ইমরান যে রাজনীতির মাঠে পড়ে থেকেছে, সেটা তাঁর পক্ষে গিয়েছে। মানুষ দেখেছে যে, এই লোকটা সখের রাজনীতি করতে আসেনি। লড়াই করতেই এসেছে। কেমন নেতা ইমরান? ক্রিকেট মাঠে তাঁর যোগ্যতা নিয়ে কোনও সংশয়ের জায়গা নেই। আমি বলব, সেবক হিসেবেও মন জয় করে নেওয়ার মতো। যে ভাবে নিজের মায়ের নামে লাহৌরে ক্যানসার হাসপাতাল গড়ে তুলেছেন, সেটা একটা মিনার হয়ে থাকবে। যে যা-ই বলুক, যতই বিতর্ক হোক, অনগ্রসর মানুষকে জীবন দেওয়ার সততা এবং অভিপ্রায় সেই হাসপাতাল গড়ে তোলার মধ্যে ছিল।

এই সততাটাই হয়তো প্রাক্তন স্ত্রী জেমাইমাকে দিয়ে বলায়, আমার সন্তানদের বাবার দীর্ঘ লড়াইয়ের জয় হচ্ছে! জেমাইমার সঙ্গে গলা মিলিয়েই বলতে চাই, ইমরান মনে রাখবেন কেন রাজনীতিতে এসেছিলেন!

(লেখক পাকিস্তানের খ্যাতনামা ক্রিকেট সাংবাদিক। ইমরানের সময়ে দেশ-বিদেশে ঘুরে ম্যাচ কভার করেছেন। ১৯৯২-এ বিশ্বকাপ জয়ের সময়েও অস্ট্রেলিয়ায় ছিলেন)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE