ইস্টবেঙ্গলের জার্সিতে আসলাম (ডান দিকে)। —নিজস্ব চিত্র।
বাংলাদেশের কিংবদন্তি ফুটবলার তিনি। এ পার বাংলায় লাল-হলুদ জার্সি পিঠে চাপিয়ে ঘাম, রক্ত ঝরিয়েছেন। তাঁর শ্বাস প্রশ্বাসে এখনও জড়িয়ে ইস্টবেঙ্গল। অথচ তাঁকেই এখন ভুলে গিয়েছে ক্লাব। অভিমানী গলায় শেখ মহম্মদ আসলাম আনন্দবাজার ডিজিটাল-কে বললেন, ‘‘ইস্টবেঙ্গল শতবর্ষে পা রাখল। তার জন্য ক্লাবকে শুভেচ্ছা জানাই। ইস্টবেঙ্গলের প্রতিষ্ঠাতাদের প্রতি আমার দারুণ শ্রদ্ধা রয়েছে। কিন্তু একটা ব্যাপার খুব খারাপ লাগে। সেই যে ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে চলে এসেছি, তার পর থেকে ক্লাবের সঙ্গে আর সে ভাবে কোনও যোগাযোগই নেই। এ সব অনুষ্ঠানে একটা ফোন-ও তো করা যেতে পারে। ক্লাব ছাড়ার পরে কোনও অনুষ্ঠানেই ওরা আর ডাকে না। অথচ এই ক্লাবের হয়েই তো ঘাম-রক্ত ঝরিয়েছি। আমি তো আশা করতেই পারি যে, আমার ভালবাসার ক্লাবের থেকে ডাক পাব।’’
ইস্টবেঙ্গলে খেলার সময়ে জর্জ টেলিগ্রাফের বিরুদ্ধে ম্যাচে মারাত্মক চোট পেয়েছিলেন আসলাম। সেই ম্যাচে ফ্লাইং হেডে গোল করেছিলেন তিনি। জর্জের গোলকিপার তাঁর থুতনিতে হাঁটু দিয়ে মেরে বসেন। সঙ্গে সঙ্গে সংজ্ঞা হারান তিনি। মাঠ থেকেই তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। সেই সময়ে ‘গোলমেশিন’ বলে পরিচিত আসলাম বলেন, ‘‘জর্জ টেলিগ্রাফের বিরুদ্ধে গোল করে ফেলার পরে ওদের গোলকিপার আমাকে এমন মারল যে, আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। রক্তারক্তি কাণ্ড। আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এই সব স্মৃতি হাতড়ালে খুব খারাপ লাগে জানেন। যে ক্লাবের জন্য জীবন সংশয় হতে পারত, সেই ক্লাবের কাছ থেকেই আর কোনও ডাক পাই না। পরিবারের কাছ থেকেও গঞ্জনা শুনতে হয়। অনেকেই বলেন, তোমরা যে ক্লাবের হয়ে খেললে. সেই ক্লাব থেকে ডাক পাও না কেন? উত্তর দিতে পারি না।’’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলছিলেন বাংলাদেশের প্রাক্তন এই স্ট্রাইকার।
কলকাতা ফুটবলের উত্তেজনা-উন্মাদনা নিজেই শরীরে মেখেছেন। এখনও সেই স্মৃতি তাঁর রক্তের গতি বাড়িয়ে দেয়। ও পার বাংলা থেকে ‘ফুটবলের মক্কা’য় কী ভাবে এসে পড়লেন আসলাম? স্মৃতিচারণ করে তিনি বলছেন, ‘‘চ্যাম্পিয়ন্স কাপ (১৯৮৯) খেলতে সেই সময়ে বাংলাদেশে এসেছিল ইস্টবেঙ্গল। আমি তখন আবাহনী ক্রীড়াচক্রের হয়ে খেলছি। ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে ফাইনালে আমার দেওয়া একমাত্র গোলেই চ্যাম্পিয়ন হয় আবাহনী। তার পরেই ইস্টবেঙ্গল কর্তা পল্টু দাস আমাকে ডেকে পাঠান হোটেলে। রাতে হোটেলে গিয়ে দেখি পল্টুদার স্ত্রী কাঁদছেন। পল্টুদা আমাকে বলে উঠলেন, তুমি না এলে তো তোমার বৌদিকে থামাতে পারছি না। পল্টুদা আমাকে বললেন, আসলাম, তোমাকে খেলতে হবে ইস্টবেঙ্গলে। আমার ক্লাব আবাহনীও সেই সময়ে বাধা দেয়নি। আমি ইস্টবেঙ্গলের হয়ে দিল্লিতে ডুরান্ড কাপ খেলতে যাই। তার পরে মুন্না-রুমিও ইস্টবেঙ্গলে সই করে।’’
আরও পড়ুন: ‘আর কত পরীক্ষা দিতে হবে? সেরা হয়েও কেন বার বার দলের বাইরে থাকবে ঋদ্ধি?’
ইস্টবেঙ্গলে সে বার সফল হতে পারেননি আসলাম (১৯৯১)। সেই মরসুমে একটাই গোল করেছিলেন। লাল-হলুদ জার্সি পরে একবছরই খেলেছিলেন। বাংলাদেশে অনেক গোল করলেও এ দেশের সবুজ গালচেয় আসলাম সফল হননি। তিনি বলছিলেন, ‘‘এখানে আমাকে কড়া পাহাড়ার রাখা হত। তার উপরে জর্জ টেলিগ্রাফের বিরুদ্ধে ম্যাচটায় চোট পাওয়ার পরে আমি একটু গুটিয়ে গিয়েছিলাম।’’ তাঁর সমসাময়িকরা বলেন, শূন্যের বলে খুবই শক্তিশালী ছিলেন আসলাম। তিনি বলছেন, ‘‘আমি ছোটবেলায় অ্যাথলিট ছিলাম। ভলিবলও খেলতাম। ভলিবলে আমি স্ম্যাশার ছিলাম। স্ম্যাশ করার সময়ে স্পট জাম্প দিতে হয়। আর সেই সঙ্গে শূন্যে শরীরটা ভাসিয়ে রেখে একটু বেন্ড হতে হয়। এটাই পরবর্তীকালে ফুটবলে আমাকে সাহায্য করে। হেডে আমি অনেক গোল করেছি।’’
ইস্টবেঙ্গল ক্লাব লনে রুমি, মুন্না ও আসলাম।
কলকাতার ফুটবল নিয়ে অসম্ভব শ্রদ্ধাশীল আসলাম। কৃশানু দে-র ফুটবল এখনও তাঁর চোখে ভাসে। ডার্বি ম্যাচে কৃশানুর বাঁ পায়ের একটা থ্রু তাঁর মনে দাগ কেটে রেখেছে। আসলাম বলছিলেন, ‘‘সে বারের লিগ ডিসাইডার ছিল ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচটা। দুই দলের সমর্থকদের দেখে আমার মানসপটে ভেসে উঠছিল আবাহনী-মহামেডান ম্যাচের ছবিটা। মোহনবাগানের বিরুদ্ধে সেই ম্যাচে কৃশানু দুর্দান্ত খেলেছিল। আমাকে একটা থ্রু বাড়িয়েছিল। আমি সেই বল ধরে মোহনবাগানের গোল লক্ষ্য করে শট করি। পোস্ট ছুঁয়ে বেরিয়ে যায় সেই বল।’’ আগের মতো ভাল ফুটবলার কলকাতা থেকে উঠে আসছেন না, এটাও ভাবাচ্ছে আসলামকে।
এখন আসলাম।
কলকাতায় খেলতে এসে কোনও সময়েই তাঁর মনে হয়নি ঘর ছেড়ে বিদেশের মাটিতে খেলতে এসেছেন। আসলাম বলছেন, ‘‘ক্লাবকর্তা থেকে শুরু করে সমথর্করা আমাদের আপন করে নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের বাইরে খেলতে এসেছি, এমন অনুভূতি কোনওদিনই হয়নি। কোচ নইমউদ্দিন আমাদের ভীষণ ভালবাসতেন। আমাদের আগলে রাখতেন নইমদা। ফুটবল-পাগল মানুষ ছিলেন নইমউদ্দিন। আমাদের অভিভাবক হয়ে গিয়েছিলেন। সুখ-দুঃখ সবই আমাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতেন নইমদা। কলকাতায় থাকার সময়ে কত পুজোর উদ্বোধন করেছি। কর্তারা নিমন্ত্রণ করে ওঁদের বাড়িতে আমাদের নিয়ে যেতেন। দারুণ দিনগুলো কাটিয়েছি।’’
আরও পড়ুন: দর্শক রেখে ম্যাচ করার পরিকল্পনা মরুদেশের কর্তাদের
ইস্টবেঙ্গল ছাড়ার পরে ক্লাবের সঙ্গে সেই সম্পর্কের বন্ধন শিথিল হয়ে গিয়েছে। গত বছর ইস্টবেঙ্গলের এক শীর্ষকর্তার সঙ্গে দেখা কথা হয়েছিল আসলামের। তাঁকেও অভিমানের কথা জানিয়েছিলেন। আসলাম বলছিলেন, ‘‘শুধু আমি কেন, ক্লাবের প্রাক্তন ফুটবলারদের তো সম্মান জানানোই উচিত। অর্থের জন্য যে ইস্টবেঙ্গলে খেলতে এসেছিলাম তা কিন্তু একেবারেই নয়। ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে দারুণ একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সেই সম্পর্কের টানেই চলে এসেছিলাম খেলতে।’’ সেই সম্পর্কের কথা কী ভাবে ভুলে গেল প্রিয় ক্লাব? উত্তর খোঁজেন বিষণ্ণ আসলাম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy