Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

রক্তপাত দিয়ে ইউরো শুরু ‘দ্বিখণ্ডিত’ ফ্রান্সে

থিয়েরি অঁরি ভাল রকম তর্জন-গর্জন শুরু করে দিয়েছেন। প্রাক্তন ফরাসি স্ট্রাইকারের বিচার খুব চাঁচাছোলা এবং পরিষ্কার। জোয়াকিম লো-র জার্মানিকে যতই কাপ ফেভারিটের তাজ আগাম পরিয়ে দেওয়া হোক, পরপর দু’বার ইউরো জয়ী দেল বস্কির স্পেন নিয়ে যতই রক্তচক্ষু দেখানো হোক, থিয়েরি অঁরির ফুটবল-মগজ নানাবিধ বিশ্লেষণের পর সম্ভাব্য চ্যাম্পিয়ন হিসেবে একটা নামই পাচ্ছে— ফ্রান্স।

বিক্ষোভ সামলাতে কাঁদানে গ্যাস। পালাচ্ছেন ব্রিটিশ সমর্থকেরা। ছবি: রয়টার্স।

বিক্ষোভ সামলাতে কাঁদানে গ্যাস। পালাচ্ছেন ব্রিটিশ সমর্থকেরা। ছবি: রয়টার্স।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১১ জুন ২০১৬ ০৯:২২
Share: Save:

থিয়েরি অঁরি ভাল রকম তর্জন-গর্জন শুরু করে দিয়েছেন। প্রাক্তন ফরাসি স্ট্রাইকারের বিচার খুব চাঁচাছোলা এবং পরিষ্কার। জোয়াকিম লো-র জার্মানিকে যতই কাপ ফেভারিটের তাজ আগাম পরিয়ে দেওয়া হোক, পরপর দু’বার ইউরো জয়ী দেল বস্কির স্পেন নিয়ে যতই রক্তচক্ষু দেখানো হোক, থিয়েরি অঁরির ফুটবল-মগজ নানাবিধ বিশ্লেষণের পর সম্ভাব্য চ্যাম্পিয়ন হিসেবে একটা নামই পাচ্ছে— ফ্রান্স। ‘‘ভাল শুধু নয়, আমরা খুব ভাল টিম। বহু দিন এ রকম টিম আমরা পাইনি। আবার বলছি, ফ্রান্সের এ রকম টিম বহু দিন আসেনি!’’

ইউরোয় লিওনেল মেসি? তা-ও এক নয়, এক জোড়া! না, না এঁরা কেউ আর্জেন্তিনার মেসি নন, বার্সেলোনাতেও খেলেন না। একজন ক্রোয়েশিয়ান মেসি। নাম আন্তে করিচ, বয়স উনিশ। বর্তমানে ডায়নামো জাগরেবের প্লেয়ার। কিন্তু ইতিমধ্যে নাকি ম্যা়ঞ্চেস্টার সিটি-বায়ার্ন মিউনিখের মতো ক্লাব তাঁকে নিয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে। দ্বিতীয় ‘মেসি’ তুরস্কের, এমের মর। বয়স? ক্রোয়েশিয়ার মেসির চেয়ে এক বছর কম। কিন্তু তাতে কী? ডাক তো পেয়ে গিয়েছেন বরুসিয়া ডর্টমুন্ডে। ফুটবলমহল বলাবলি করছে, ইউরোয় রোনাল্ডো-ইব্রাহিমোভিচরা তো থাকছেনই। কিন্তু পাকেচক্রে এঁরা যদি কেউ নায়ক হয়ে যান, অবাক হওয়ার থাকবে না। ওহ্, বলা হয়নি। জোড়া ‘মেসি’ ছাড়া একজন রোনাল্ডোরও আবির্ভাব ঘটেছে! রুশ রোনাল্ডো। নাম? আলেকজান্ডার গলোভিন।

ফ্রান্সে যাচ্ছেন ইউরো দেখতে? ফরাসি সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় আছে? না থাকলে জেনে নিতে পারেন। যেমন, লাগেজে অতি অবশ্যই ভাল ফুটবল জার্সি থাকতে হবে। ক্যাজুয়াল আউটফিট এড়িয়ে চলাই ভাল। স্থানীয়দের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হলে, ‘বঁজুর’ বা ‘বঁসোয়া’ বলতে হবে। কারণ ওটা ও দেশের স্বাভাবিক ভদ্রতা। ঠিক যেমন ইংরেজি বলার আগে জেনে নেওয়া ভাল যে, উল্টো দিকের ভদ্রলোক ভাষাটা জানেন কি না। গুগল সার্চে ফেললে এ রকম ‘টু ডু লিস্ট’ কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে এখন বেরিয়ে আসছে। যেখানে খাদ্যরসিকের রসনা তৃপ্তির ঠিকানা থেকে রাস্তায় প্রেমিকাকে ক’টা চুম্বন করা যাবে— সব হাতেগরম আছে!

ইউরো কাপের মতো একটা মেগা টুর্নামেন্টের মহাযজ্ঞ যে যে উপাদান দাবি করে, গোটা পৃথিবীর ফুটবলপ্রেমীদের ধমনীর রক্ত চলাচল স্বাভাবিক থেকে অস্বাভাবিকে পাল্টে ফেলতে উত্তেজনার যা যা মশলা দরকার হয়, নেপোলিয়ন বোনাপার্টের দেশে আজ থেকে সব পাবেন। ইউরো কাপ নামক ফুটবল-বসন্তে ফুটবল তো থাকবেই। ওয়েন রুনিদের নিয়ে ব্রিটিশ মিডিয়ার চিরন্তন বাড়াবাড়ির একশো আটাত্তরতম সংস্করণের প্রকাশ ঘটবে! দেশের মাটিতে ইউরোকে ঘিরে ফ্রান্স ফুটবলের পুনর্গঠন সম্ভাবনা নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠবে। এক ঝাঁক প্লেয়ারের চোট-আঘাতে বিশ্বজয়ী জার্মান কোচের কপালে ক’টা ভাঁজ, তা নিয়ে গবেষণা হবে। সব তো হচ্ছেও। সাহিত্যের স্বর্গরাজ্যে এখন সবই হচ্ছে। সবই পাওয়া যাচ্ছে। ফুটবল। ফুটবলকে ঘিরে থাকা পৃথিবী। ফুটবলের বাইরের পৃথিবী। সব।

আন্তর্জাতিক স্তরের সাংবাদিকদেরও এখন প্রায় উন্মত্ত দশা! একে তো গোটা ফ্রান্স এখন পল পোগবার মধ্যে ষোলো বছর আগের জিনেদিন জিদানকে খুঁজছে। ফেরত চাইছে বত্রিশ বছর আগের মায়াময় ইতিহাস। দেশের মাটিতে ’৮৪ সালে মিশেল প্লাতিনির হাত ধরে যা এসেছিল, এসেছিল স্বপ্নের ইউরোপ সেরার শিরোপা। তার উপর নিত্যনতুন খবর। স্কাই স্পোর্টস ইউরোর সেরা কুড়ি ফুটবলারের তালিকায় ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর আগে জ্লাটান ইব্রাহিমোভিচকে রেখেছে। মুচমুচে খবর। ইউরো উদ্বোধনে ‘স্তাদ দ্য ফ্রঁস’-এ কৃত্রিম আইফেল টাওয়ার হাজির করা হল। ধোঁয়া দিয়ে জাতীয় পতাকার অবয়ব তৈরি করে উড়ে গেল জেট। মনে রাখার মতো খবর। স্পেনের গোলকিপার দাভিদ দে হিয়ার মধুচক্রের সম্পর্কের কথা ইউরো শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে ফাঁস। আগুনে খবর।

দুঃখের হল, এটা একটা ফ্রান্স। যে ফ্রান্স এখন দেশের ফুটবল-আকাশে পোগবা-গ্রিজম্যানদের নিয়ে স্বপ্নের ছবি আঁকছে। আগামী একমাস যে ফ্রান্স ফুটবল-সাহিত্যের যথাপোযোগী লাইন খুঁজে চলবে। কিন্তু বর্তমানে দেশটার তো একটা নয়, দ্বৈত সত্তা।

একটা ফ্রান্স ফুটবল, ফুটবলের পারিপার্শ্বিক ঘিরে ছবির মতো সুন্দর। আর একটা ফ্রান্স ক্লেদাক্ত। ধর্মঘট, বিক্ষোভ, হানাহানিতে ডুবে। যে ফ্রান্সের রাজপথে আবর্জনা পড়ে থাকে, পরিষ্কার হয় না। যে ফ্রান্সে ট্রেন চলাচল থেকে উড়ান পরিষেবা, সবই আক্রান্ত হয় ধর্মঘটে। যে ফ্রান্সে মাথা ফাটিয়ে মৃতপ্রায় করে ছেড়ে দেওয়া হয় ইংরেজ সমর্থককে। ফুটবল দেখতে এসে তাঁকে লড়তে হয় মৃত্যুর সঙ্গে।

ইউরোপের বিশেষজ্ঞরা বরাবর আশঙ্কা করে এসেছেন যে, অভ্যন্তরীণ এত ঝামেলা সামলে ফ্রান্স শেষ পর্যন্ত মেগা টুর্নামেন্ট করে উঠতে পারবে কি না। দেশের নেতা-মন্ত্রীদের তো দিশেহারা অবস্থা। ধর্মঘটীদের পাল্লায় পড়ে কেউ বলছেন, ফ্রান্সের গর্বই আক্রান্ত। কেউ অনুনয় করছেন, ইউরোপ দেখছে। ইউরোপের সামনে ফ্রান্সকে ছোট কোরো না। কারও ক্ষোভ গিয়ে পড়ছে ইউনিয়নগুলোর উপর। বলা হচ্ছে, ওগুলোই সব নষ্টের গোড়া। ফ্রান্সের ভাবমূর্তিকে যা এ ফোঁড়-ও ফোঁড় করে ছাড়ছে। আসলে গত ১৩ নভেম্বরের প্যারিসে আইএস হানা এবং তার পরিণতি স্বরূপ একশো তিরিশ জনের মৃত্যুর ‘শক’ থেকে দেশটা পুরো সামলে উঠতে পারেনি। পারেনি যে, তার প্রমাণ আইফেল টাওয়ারের সামনে প্রত্যেককে কড়া চেকিংয়ে ফেলে দেওয়ায়, ফ্যান জোন তুলে দেওয়ার পুলিশি ভাবনায়। তার উপর একটার পর একটা ধর্মঘট ঘিরে সমস্যা। তবু মনে করা হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত হয়তো পারবে ফ্রান্স। কিন্তু শুক্রবারের মার্সেই সব আবার ওলট-পালট করে দিল।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ সত্যি হলে, শুরুটা ইংরেজ সমর্থকরাই করেছিলেন। মার্সেইয়ের কুইন ভিক্টোরিয়া পাবে যাঁরা জড়ো হয়েছিলেন ইংল্যান্ড বনাম রাশিয়া ম্যাচ উপলক্ষে। সেখানেই নাকি আচমকা এক ইংরেজ সমর্থক, ‘‘আইএস, আইএস তোমরা কোথায়’’ বলে চেঁচাতে শুরু করে দেন। কেউ আবার সঙ্গে জুড়ে দেন, ‘‘আইএস, আমরা তোমাদের ভালবাসি।’’ গত নভেম্বরে আইএস হানায় ছিন্নভিন্ন ফরাসি মনন তা মেনে নিতে পারেনি। স্থানীয়দের সঙ্গে ইংরেজ সমর্থকদের প্রবল ঝামেলা বেধে যায়। শুধু তাই নয়, অবস্থা এতটা চরমে ওঠে যে, ইংরেজদের শিক্ষা দিতে উপস্থিত ফরাসিরা ওখানে অস্ত্রের ব্যবহার করার কথা বলেছেন বলেও কেউ কেউ জানিয়েছেন। এক ইংরেজ সমর্থককে চেয়ার দিয়ে মাথায় এমন মারা হয় যে, হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। ফরাসি পুলিশ— অভিযোগ সত্যি হলে—তারা নাকি প্রথমে হতভম্ব দাঁড়িয়ে ছিল। পরে চেতনা ফিরতে কাঁদানে গ্যাস ছোড়া শুরু করে দেয়।

দোষারোপের পালা— সেটাও শুরু হতে বেশি সময় লাগেনি। ফরাসিদের বক্তব্য, ইংরেজ সমর্থকরা আদতে ‘হুলিগান।’ অপমানজনক কথা বলে ঝামেলার শুরু ইংরেজরাই করেছে। আর ইংরেজদের বক্তব্য, দোষটা ফরাসিদের। তাঁরা আনন্দ করছিলেন। নিজেরা একটু বেশি মদ্যপান করেছিলেন মাত্র। কিন্তু উত্যক্ত করা শুরু করে ফরাসিরা। ‘গেট দ্য ইংলিশ’ বলে তেড়ে আসা হয়। জিনিসপত্র ছুড়ে মারা হয়।

সত্যি যা-ই হোক, যে পক্ষই ঠিক হোক, প্রেক্ষাপট দেখে একটা কথা বোধহয় লিখে ফেলা যায়।

ফ্রান্সে ইউরোর শুরুই হল রক্ত দিয়ে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Euro 2016 France
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE