Advertisement
E-Paper

‘ক্রিকেটের স্টাইল-ভাই নামে আপত্তি নেই’

ভারতীয় ক্রিকেটের নতুন পোস্টার বয়। জীবনসংগ্রামে জয়ী এক যুবকের অসাধারণ যাত্রার কাহিনি। হার্দিক পাণ্ড্য-র দীর্ঘ, একান্ত সাক্ষাৎকারে সেই সব অজানা দিক তুলে আনার চেষ্টা হল। খোলামেলা সাক্ষাৎকারের শেষ পর্ব। ভারতীয় ক্রিকেটের নতুন পোস্টার বয়। জীবনসংগ্রামে জয়ী এক যুবকের অসাধারণ যাত্রার কাহিনি। হার্দিক পাণ্ড্য-র দীর্ঘ, একান্ত সাক্ষাৎকারে সেই সব অজানা দিক তুলে আনার চেষ্টা হল।

সুমিত ঘোষ

শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০১৭ ০৪:২৩
উদীয়মান: ভারতীয় ক্রিকেটের আকাশে নতুন তারা তিনি। হয়ে উঠছেন জনতার হার্টথ্রবও। ফাইল চিত্র

উদীয়মান: ভারতীয় ক্রিকেটের আকাশে নতুন তারা তিনি। হয়ে উঠছেন জনতার হার্টথ্রবও। ফাইল চিত্র

প্রশ্ন: টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সময় মুম্বইয়ে দেখেছিলাম, আপনি দিব্যি টিমের হোটেল থেকে বেরিয়ে মেরিন ড্রাইভ ধরে হাঁটছেন। কয়েক দিন আগে শ্রীলঙ্কায় দেখলাম, সে দেশের ক্রিকেট ভক্তদের সঙ্গেও দারুণ মিশে গিয়েছেন। জনতার সঙ্গে মেশাটা কি সচেনতন ভাবেই করা?

হার্দিক: দেখুন, ক্রিকেটে তো কোনও আইন নেই যে, ভক্তদের সঙ্গে মেশা যাবে না বা তাঁদের সঙ্গে কথা বলা যাবে না। ওঁরা মাঠে আসেন ক্রিকেটকে উপভোগ করতে। আমি ওঁদের ভালবাসি। মনে করি, ওঁরাই আমাদের প্রেরণা। আমি তো মনে করি, আমাকে সবচেয়ে বেশি আত্মবিশ্বাস দেন এই ক্রিকেট ভক্তরাই। ভারতের যে কোনও স্টেডিয়ামে যে আওয়াজ ওঁরা তৈরি করেন, সেটা অবিশ্বাস্য! কী দুর্ধর্ষ এনার্জি! সারাক্ষণ আমাদের উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছেন। এই পরিবেশ অন্য কোনও ক্রিকেট দেশে পাবেন? আমার তো মনে হয় না। আর মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমার কাজ হচ্ছে, ওঁরা যাতে একঘেয়েমিতে না ভোগেন। আমার একটা সামান্য হাত নাড়া দেখে বা একটা ছবি তোলাতেই যদি ভক্তরা খুশি হন, সেটা করব না কেন?

প্র: দর্শকদের দিক থেকে মনে রাখার মতো কিছু ঘটনা বলুন।

হার্দিক: কয়েক দিন আগেই একটা ওয়ান ডে ম্যাচের সময় পরিচিত এক ক্যামেরাম্যান এসে বললেন, একটা নতুন জিনিস দেখেছি আমরা। জিজ্ঞেস করলাম, কী নতুন জিনিস? উনি বললেন, আমার ৩৩ নম্বর জার্সি নাকি এক ক্রিকেট ভক্ত পরে স্টেডিয়ামে ঢুকছিলেন। আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। যেখানেই যাই দু’টো জার্সিই তো সকলকে পরতে দেখি। নম্বর ৭ (মহেন্দ্র সিংহ ধোনির জার্সি নম্বর) এবং নম্বর ১৮ (বিরাট কোহালির জার্সি নম্বর)। সেই ক্যামেরাম্যানকে জিজ্ঞেস করলাম, নম্বর ৩৩ কোথায় দেখলেন? তার পরে আমি খেয়াল করে দেখলাম, দু’একজন ভক্ত হার্দিক লেখা ৩৩ নম্বর জার্সি পরছে। আমার কাছে এটা খুব বড় একটা প্রাপ্তি।

প্র: ভক্তদের এই ভালবাসাটা পেয়ে কী প্রতিক্রিয়া হয় আপনার মনে?

হার্দিক: দারুণ লাগে। আর ভিতরে ভিতরে আরও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে উঠি যে, ভক্তরা আমাকে এত বড় সম্মান দিচ্ছেন। ওঁদের যেন আরও আনন্দ দিতে পারি। ভাল করার জেদটা আরও বেড়ে যায় আর নিজেকে বলি, কোনও ভাবেই যেন আত্মতুষ্ট হয়ে না পড়ি। যেন উন্নতি করার তাগিদ আর খিদেটা ধরে রাখতে পারি। দিনের শেষে ক্রিকেট একটা খেলা। সেটাকে উপভোগ করতে লোকে মাঠে আসেন। তাঁদের আনন্দ দেওয়াটাই আমাদের কাজ। দেখা দরকার, দীর্ঘমেয়াদি ভাবে কী করে সেই আনন্দটা দিয়ে যেতে পারি।

প্র: ফিরোজ শা কোটলায় আশিস নেহরার বিদায়ী ম্যাচে যে ক্যাচটা নিয়েছিলেন, সেটার কথা বলুন। যেটা দেখে সকলে ডাকছিল কুং ফু পাণ্ডা!

হার্দিক: আমার সব সময়ই মনে হয়েছে, ফিল্ডিং এমন একটা দিক, যেটার উপর আমার নিয়ন্ত্রণ বেশি থাকতে পারে। ব্যাটিংয়ে কী হতে যাচ্ছে, কেউ জানে না। বোলিংয়ে পরের বলটাতেই কী হবে, কে বলতে পারে! কিন্তু ফিল্ডিংয়ে একটা আন্দাজ রাখা যায় যে, কোথা থেকে কী আসতে পারে বা কী হতে যাচ্ছে। যদি ফিল্ডিং নিয়ে পরিশ্রম করা যায়, তাহলে নিজের মনে নিশ্চিত থাকা যায়, এই বলটা থামিয়ে দেব। বা এই ক্যাচটা ধরে ফেলব। আমি খেলার মধ্যে থাকতে চাই সব সময়। যদি ব্যাটে কিছু করতে না পারি, বলে খারাপ দিন যায়, ফিল্ডিংয়ে অবদান রাখা যায়। আর এখন ক্রিকেট এমন বদলে গিয়েছে যে, ফিল্ডিংয়ে ভাল করাটা বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর আমি নিজে এমন একটা অনুভূতি নিয়ে কোনও ম্যাচ থেকেই ফিরতে চাই না যে, কিছুই করতে পারিনি। কোটলায় টি-টোয়েন্টি ম্যাচটাতে আমি শূন্য রানে আউট হয়ে গিয়েছিলাম। সে দিন আমরা পাঁচ বোলারে খেলছিলাম বলে জানতাম, বেশি বোলিং পাব না। ওই ক্যাচটা আমাকে হতাশা থেকে বাঁচিয়েছিল। হোটেলের ঘরে মন খারাপ নিয়ে ফিরিনি যে, কিছুই করা হল না!

দুর্লভ: সচিনের সঙ্গে দুই ভাই, হার্দিক ও ক্রুনাল। আইপিএল জিতে।

প্র: ক্যাচটা ধরার আগে বা ক্যাচটা সম্পূর্ণ করে কী চলছিল মনের মধ্যে?

হার্দিক: ক্যাচটা ধরে ওঠার পরে মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল— ওয়াও! অনেকটা দৌড়ে যে ক্যাচটা নিয়েছি, সেটা আমার মাথায় ছিল। পরে রিপ্লেতে দেখলাম, দৌড়তে দৌড়তে প্রায় সাইটস্ক্রিনের কাছে গিয়ে ক্যাচটা ধরেছি। আমার কেন জানি না মনে হচ্ছিল, মার্টিন গাপ্টিল বড় শট মারার চেষ্টা করবে। গাপ্টিলকে আমি লেগস্পিনারের বিরুদ্ধে একই ভাবে আউট হতে দেখেছি আইপিএলে। ও কিংগস ইলেভেনের হয়ে খেলছিল। আমাদের মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের বিরুদ্ধে লেগস্পিনার কর্ণ শর্মার বলে আউট হয়েছিল। পাওয়ার প্লে-তে গাপ্টিল মিড-অনের উপর দিয়ে মেরেছিল। আমি খুব উঁচু একটা ক্যাচ নিয়েছিলাম। আইপিএলে বোলার ছিল কর্ণ। এখানে চহাল। দু’জনেই লেগস্পিনার। তাই ভাবছিলাম, গাপ্টিল এ বারও সহজ একটা ক্যাচ দিতে পারে। এ বারেরটা যদিও একেবারেই সহজ ছিল না।

প্র: মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের ডাগআউট মানেই তো তারকাদের মেলা ছিল। মেন্টর সচিন তেন্ডুলকর। কোচ রিকি পন্টিং। ফিল্ডিং কোচ জন্টি রোডস। ওঁদের প্রভাব সম্পর্কে বলুন।

হার্দিক: অপরীসিম প্রভাব। অসাধারণ সব অভিজ্ঞতা হয়েছে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের শিবিরে গিয়ে। সচিন তেন্ডুলকর এসে পিঠে হাত রেখে বলছেন, এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে তুমি ভারতের হয়ে খেলবে। আমি তো শুনে বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না! আমার যে সেদিন কী অবস্থা হয়েছিল, বলে বোঝাতে পারব না। সচিন তেন্ডুলকর মানে ভারতের কত প্রজন্মের ক্রিকেটারদের কাছেই ঈশ্বর। তিনি বলছেন, তুমি ইন্ডিয়া খেলবে খুব তাড়াতাড়িই। তার সাত মাসের মধ্যেই আমি ভারতীয় দলে নির্বাচিত হই। এখনও ভাবলে কেমন ফিল্মের মতোই মনে হয়। তেমনই ছিলেন রিকি পন্টিং। আমাকে পুল আর হুক শট মারা নিয়ে বিশেষ করে পরামর্শ দিয়েছিলেন পন্টিং। এখনও ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখি। আমি খুবই ভাগ্যবান যে, এরকম দু’জন কিংবদন্তিকে পাশে পেয়েছি। ক্রিকেটার হিসেবে বেড়ে ওঠার সময় এমন দুই ব্যক্তিত্বকে পাওয়া আর তাঁদের ক্রমাগত উৎসাহ আমার মধ্যে বিশ্বাসটা এনে দিয়েছিল যে, পারব।

আরও পড়ুন: শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজে বিশ্রাম দেওয়া হল হার্দিককে

প্র: কী ভাবে বাড়তে থাকা প্রত্যাশার চাপ নিচ্ছেন?

হার্দিক: নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করি যে, আমার কাজ হচ্ছে, ভাল খেলা। আর সেটা করতে গেলে ঠাণ্ডা মাথা দরকার। প্রত্যাশার চাপও থাকবে। ভারতে ক্রিকেট এত জনপ্রিয়। সকলে জয় দেখতে চায়। তাই এই চাপকে সামলেই এগিয়ে যেতে হবে। এমনিতে আমার ভঙ্গিটা হচ্ছে, যা করব অলআউট গিয়ে করব। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং— আমি সব সময় অলআউট ঝাঁপাতে চাই। আমার মনে হয় সেই কারণেই সে দিন কোটলায় ক্যাচটা নিতে পেরেছিলাম। আমি দৌড়নোর সময় ভাবিনি যে, হবে না। বিশ্বাস রেখেই দৌড়চ্ছিলাম যে, ঠিক ধরে ফেলতে পারব।

প্র: চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনাল। খুব ভাল ব্যাট করতে করতে রান আউট। ক্ষোভ প্রকাশ করতে ছাড়েননি। সেদিন জেতাতে পারেননি কিন্তু অনেকে মনে করেন, পাকিস্তান বোলিংকে যেভাবে পাল্টা আক্রমণ করেছিলেন, সেটাই জন্ম দিয়ে গেল এক তারকার। আপনি কী বলবেন?

হার্দিক: আমি সম্পূর্ণ একমত। আমার মধ্যে বিশ্বাস তৈরি করে দিয়ে গেল ওই ম্যাচটা। সেদিন হয়তো জিততে পারিনি। ফাইনালটা আমরা হেরে যাই। কিন্তু বিশ্বাসটা এনে দেয় ওভালের ফাইনাল যে, আইপিএল বা ঘরোয়া ক্রিকেটের মতো আন্তর্জাতিক মঞ্চেও ম্যাচ জেতাতে পারি আমি। আউট হয়ে হতাশ হওয়াটা খেলার অঙ্গ। সেটা হয়েই থাকে। সেই হতাশাটা চলেও যায়। থেকে গিয়েছে ম্যাচ থেকে পাওয়া আত্মবিশ্বাসটা।

প্র: হার্দিক, এর পর কী? কোনও লক্ষ্য স্থির করেছেন নিজের সামনে?

হার্দিক: আমি সত্যিই জানি না। খুব সচেতন ভাবে যে নিজের জন্য কোনও লক্ষ্য স্থির করেছি, এমন নয়। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেট রয়েছে সামনে। তাতে যদি টিমের জন্য অবদান রাখতে পারি, যদি টিমের দেওয়া ভূমিকা ঠিকঠাক পালন করতে পারি, তাহলে খুশি হব। দিনের শেষে আসল ব্যাপার হচ্ছে, সঠিক জিনিসটাকে সঠিক ভাবে করা।

প্র: আর এই যে লোকে আপনার নামকরণ করেছে ‘ভারতীয় ক্রিকেটের স্টাইল-ভাই’ সেটা নিয়ে কী বলবেন?

হার্দিক (হাসি): আমার আপত্তি নেই। লোকে বললে বলতেই পারে।

প্র: কিন্তু কিছু দিন আগে পর্যন্তও মাঠে যতই ভাল পারফরম্যান্স করুন, লোকে আপনার স্টাইল নিয়েই বেশি কথা বলত।

হার্দিক (থামিয়ে দিয়ে): বলত না, এখনও সেটা বলে।

প্র: আপনার উপর এই সব মন্তব্যগুলো কোনও প্রভাব ফেলে?

হার্দিক: না, একেবারেই না। স্টাইলের ব্যাপারে আমি যা করি, নিজের জন্য করি। অন্যদের জন্য তো করি না। যদি কারও ভাল লাগে তো ভাল, না ভাল লাগলে কী করা যাবে! যদি কেউ আমার ক্রিকেট ছেড়ে স্টাইল নিয়েই কথা বলতে চায়, বলুক না। আমি তাদের থামাতেও যাচ্ছি না।

প্র: সমালোচনাকে কী ভাবে নেন?

হার্দিক: কে কী বলছে না বলছে, সেটা আমাকে খুব একটা প্রভাবিত করে না। সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব বেশি আমাকে দেখবেন না। টুইটারে আছি ঠিকই। কিন্তু দেখবেন, খুব বেশি ব্যবহার করি না। আমি তাই সমালোচকদের দুনিয়া থেকে দূরে বসে আছি। যেখানে আছে শুধুই ক্রিকেট আর ক্রিকেট!

(শেষ)

Hardik Pandya Sachin Tendulkar Cricket Interview Celebrity Interview
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy