E-Paper

মেসি সংসর্গে ক্ষমতা জাহিরেই কি লজ্জা শহরের

গুটিকয়েক ভাগ‍্যবান ভিভিআইপি-ই মহাতারকা মেসির বলয়ের কাছে ঘেঁষতে পেরেছিলেন। সল্টলেকের মাঠে মেসিকে নেতা-মন্ত্রীরা জড়িয়ে ধরে কার্যত টানাটানি করেন বলেও অভিযোগ।

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৮:৩২
শহরের মাঠে পেলে, ১৯৭৭ সালে।

শহরের মাঠে পেলে, ১৯৭৭ সালে। — ফাইল চিত্র।

‘হেলে ধরতি পারে না, কেউটে ধরতি যায়!’

অন‍্য প্রসঙ্গে বলা রাজ‍্যের এক প্রাক্তন মন্ত্রীর এই কথাটি প্রবাদবাক‍্যে পরিণত হয়েছে। শনিবার সল্টলেক স্টেডিয়ামে মেসি-বিভ্রাটে তা অন‍্য মাত্রা পেল বলা যায়। কলকাতার অতীত ইতিহাস খুঁড়ে খেলার মাঠ বা অন‍্য অনুষ্ঠানে দুর্যোগ, দুর্ঘটনার নজির আরও মিলবে। ইডেনে দর্শকের ক্ষোভে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সেমিফাইনাল বন্ধ হয়েছে। অভিযোগ, নজরুল মঞ্চে মাত্রাছাড়া দর্শক ঢুকিয়ে দমবন্ধ পরিবেশে অনুষ্ঠানের পরে কেকে-র মর্মান্তিক মৃত‍্যু ঘটেছে। তবে, স্মরণাতীতকালে এমন ফ্লপ বা ব‍্যর্থ মেগা-ইভেন্ট কলকাতার টাইমলাইনে খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

গুটিকয়েক ভাগ‍্যবান ভিভিআইপি-ই মহাতারকা মেসির বলয়ের কাছে ঘেঁষতে পেরেছিলেন। সল্টলেকের মাঠে মেসিকে নেতা-মন্ত্রীরা জড়িয়ে ধরে কার্যত টানাটানি করেন বলেও অভিযোগ। এর পরে আচমকাই ঘটে অ‍্যান্টি-ক্লাইম‍্যাক্স বা মহা ছন্দপতন। নির্ধারিত ঘণ্টা দেড়-দুইয়ের বদলে মাঠে মিনিট ২০ কাটিয়েই বেরিয়ে যান ফুটবল বিশ্বের ‘গোট’ (গ্রেটেস্ট অব অল টাইম)! অথচ, কলকাতায় মেসি এক দশক আগেও ফিফা ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলেছেন। থেকেওছেন। দিয়েগো মারাদোনা এ শহরে দু’বার মাঠের অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। আর ১৯৭৭-এ ইন্টারনেট যুগের বহু আগে ইডেনে ৯০ মিনিট ম‍্যাচ খেলেছিলেন তিন বারের বিশ্বকাপজয়ী ফুটবল-সম্রাট পেলে। বিমানবন্দর থেকে ইডেন, মাঠের বাইরে তাঁকে দেখতে যে উন্মাদনা সৃষ্টি হয়েছিল, তা এ দিনের মেসি-আবেগের থেকে উঁচুতেই থাকবে।

মেসিকে দেখতে মাঠে গেলেন না? প্রশ্ন শুনে থমকালেন ইডেনে পেলের সেই ঐতিহাসিক ম‍্যাচে প্রতিপক্ষ, সে দিনের মোহনবাগানের গৌতম সরকার! “আমাদের তো ডাকা হয় না! জানি না, কারা মেসির পাশে ছিল! এত দিন ফুটবল খেলে যদি আমাকে হর্তাকর্তাদের গিয়ে টিকিটের জন‍্য ধরতে হয়, তা হলে না যাওয়াই ভাল।” মোহনবাগানের তখনকার সর্বেসর্বা ধীরেন দে-র ব‍্যবস্থায় পেলে কিন্তু মেসির মতো আধবেলার ঝটিকা সফরে নয়, দিন দু’-তিন কলকাতায় কাটিয়েছিলেন।

রাজ‍্যের প্রাক্তন স্বাস্থ্যসচিব দিলীপ ঘোষের মনে পড়ছে, ১৯৮৪-র জানুয়ারিতে নেহরু কাপে এই সল্টলেক স্টেডিয়ামের উদ্বোধনী ম‍্যাচের কথা। দিলীপ তখন অবিভক্ত ২৪ পরগনার তরুণ এসডিও। স্টেডিয়ামে ম‍্যাচের আয়োজনের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। সমাজমাধ্যমে তিনি লিখেছেন, সেই ম‍্যাচ শুরুর আগে ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপজয়ী তারকা ববি মুরের দৌড়ের কথা। প্রাক্তন সরকারি আমলার কথায়, “তখনও সবার মধ‍্যে একটা পরিমিতি বোধ ছিল। চুনী, পিকে-র মতো প্রাক্তন ফুটবলারেরাও ববি মুরের থেকে সসম্ভ্রম দূরত্ব রাখেন। ববি একাই মাঠ জুড়ে দৌড়ন।”

বরণীয় নায়কদের বীরপুজোয় কলকাতার আবেগের কথা ক্রীড়া থেকে বিনোদন জগতের বহু নক্ষত্রই আজও ভালবেসে স্মরণ করেন। কিন্তু এ দিনের মেসির ঘটনাটির পরে অনেকেরই মনে হচ্ছে, তারকার সঙ্গে গা-ঘষাঘষিটাও ক্ষমতা জাহির করার অশ্লীলতা হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক অতীতে চলচ্চিত্র উৎসবেও দেখা গিয়েছে, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ছবি দেখা নয়, তারকা-দর্শনটাই মুখ‍্য। অমিতাভ, শাহরুখ খানেরা আসেন। চোখা চোখা সংলাপ ছোড়েন। মুখ‍্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁদের অন্তরঙ্গতা প্রকট হয়ে ওঠে। এর পরে ইউটিউবে চাইলেই দেখা যায়, এমন একটি বহুল পরিচিত ছবি কার্যত ফাঁকা হলে দেখানো হয়। লক্ষ‍্য ছাপিয়ে উপলক্ষটাই হয়ে ওঠে প্রধান। মেসির অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে বলে অনেকের অভিমত।

মেসি আসবেন। খেলবেন না। শুধু হাত নাড়বেন। হয়তো একটু পেনাল্টি মারবেন। শাহরুখ থাকবেন। আর তারকাদের প্রতিফলিত আলোয় জ্বলজ্বল করবেন রাজনীতির কুশীলবেরা। মেসি-বিভ্রাটের পরে মুখ‍্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে শাসক-শিবির ক্ষমা চেয়ে মূল সংগঠকের দিকে আঙুল তুলেছেন। তাঁকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। কিন্তু নিছকই সাংগঠনিক ত্রুটি বলে এই বিপর্যয়ের ব‍্যাখ‍্যা অনেকেরই ঠিক লাগছে না। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক উপল চক্রবর্তী বলেন, “এক ধরনের অসুস্থ বীরপুজো বা গণ হিস্টিরিয়ার আবেগ এখন প্রাতিষ্ঠানিক প্রশ্রয় পাচ্ছে। চার দিকে বিস্তর আর্থিক অসাম্য। শুনছি, ২০ হাজার টাকা আয়ের কেউও ১০ হাজারের টিকিট কাটছেন। এটা কেন হবে? নেশার মতো লোভের টোপে তাঁরা কাবু হচ্ছেন।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Pele football

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy