টোকিয়ো প্যারালিম্পিক্সে ভারতীয় ক্রীড়াবিদেরা পাল্লা দিয়ে পদক শিকারে মেতেছেন। রবিবার প্রথম ভারতীয় মহিলা প্যারা-টেবল টেনিস খেলোয়াড় হিসেবে রুপো জিতে ইতিহাস গড়েছিলেন গুজরাতের ভাবিনাবেন পটেল। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাঁকেও ছাপিয়ে গেলেন রাজস্থানের ২০ বছরের মহিলা শুটার অবনী লেখারা। মহিলাদের ১০ মিটার এয়ার রাইফেল বিভাগে তিনি এ বার ইতিহাস গড়লেন সোনা জিতে। ২৪৯.৬ স্কোর করে প্যারালিম্পিক্স রেকর্ড গড়ার পাশাপাশি প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে শুটিং থেকে সোনা আনলেন তিনি। গেমস ভিলেজে ফেরার আগে আনন্দবাজারের সঙ্গে কথা বলে গেলেন অবনী।
প্রশ্ন: রবিবার ভাবিনাবেনের রুপোর পদকের পরে সোমবার গেমস ভিলেজে প্রথম সোনাটাও এল এক মহিলা ক্রীড়াবিদের হাত ধরে। কেমন লাগছে?
অবনী: দারুণ লাগছে। ভাবিনাবেন রুপো পাওয়ার পরে রবিবার দারুণ আনন্দ করেছি আমরা সবাই। আজ ইভেন্ট থাকায় আমি অবশ্য বেশি সময় দিতে পারিনি।
প্র: তখনই কি ঠিক করে নিয়েছিলেন, আজ নতুন কীর্তি গড়তে হবে?
অবনী: এটা কী কখনও সম্ভব? জীবনে আপনি যা চাইছেন, তা সব সময় সে রকমই হবে না, তা আমি জীবন দিয়ে বুঝেছি। তাই নিজের সেরাটা দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েই আজ ভোর চারটে নাগাদ গেমস ভিলেজ থেকে বেরিয়েছিলাম। পদক পেতেই হবে— এ রকম কোনও চিন্তাভাবনা মনে রাখিনি। কারণ, এতে চাপ অহেতুক নিজের দিকে টেনে আনা হয়।
প্র: শুটিং রেঞ্জে গিয়ে তো অতিমানবিক ছন্দে দেখা গেল আপনাকে। রিয়োর সোনাজয়ী চিনের কুইপিং ঝ্যাং (রুপো) এবং বিশ্বের এক নম্বর এবং বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ইউক্রেনের ইরিনা শেতনিককে (ব্রোঞ্জ) পিছনে ফেলে ঐতিহাসিক সোনা জয়!
অবনী: সত্যিই তাই! প্রথম দিকে বিশ্বাস হচ্ছিল না। ধাতস্থ হতে সময় লেগেছে। ওই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। প্যারালিম্পিক্সে বিশ্বের সেরাদের হারিয়ে আমি সবার উপরে! ভাবলেই কেমন লাগছে।
প্র: এই ঐতিহাসিক সাফল্য উৎসর্গ করলেন কাকে?
অবনী: এই সোনা আমার নয়। এই পদকটা ভারতের। তাই আমার দেশের ১৩০ কোটি মানুষকেই এই পদকটা উৎসর্গ করছি। কত মানুষের ভালবাসা, সহায়তার জন্যই তো আজ এই জায়গাতে পৌঁছলাম। গাড়ি দুঘর্টনার পরে আমাকে সুস্থ করে এই জায়গায় পাঠাতে দেশের অনেক মানুষের অবদান রয়েছে। সে কারণেই এই পদক ভারতবাসীকে উৎসর্গ করছি।
প্র: অলিম্পিক্সে শুটিং থেকে ভারতের একমাত্র সোনাজয়ী অভিনব বিন্দ্রা আপনাকে চিঠি টুইট করে লিখেছেন, আপনার এই ঐতিহাসিক কীর্তির জন্য তিনি গর্বিত। আপনার প্রতিক্রিয়া জানতে চাই।
অবনী: আপনার আদর্শ ক্রীড়াবিদ যদি পরিশ্রম, ত্যাগ, কষ্টের কথা উল্লেখ করে প্রশংসা করেন, তা হলে আপনার কেমন লাগবে? ওই মানুষটাকে সামনে রেখেই তো আমার প্যারা-শুটার হিসেবে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু। এই ইভেন্টের আগেই অভিনব ভাইয়া শুভেচ্ছা জানিয়ে বার্তা পাঠিয়েছিলেন। সুতরাং মন শান্ত রেখে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা পেতে অসুবিধা হয়নি। টোকিয়ো প্যারালিম্পিক্সে আরও কতগুলো ইভেন্টে নামব। অভিনব ভাইয়ার অভিনন্দনবার্তা আমার ভাল কিছু করার ইচ্ছা আরও অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে। ।
প্র: আপনি নাকি এক সময়ে তিরন্দাজ হতে চেয়েছিলেন?
অবনী: ঠিকই শুনেছেন। ২০১২ সালে গাড়ি দুর্ঘটনার পরে আমি তিরন্দাজ হতে চেয়েছিলাম। বাবার উৎসাহেই তার পরে আমি শুটিংয়ে চলে আসি। প্রথম প্রথম মজার জন্য হুইলচেয়ারে বসে ক্লাবে শুটিং অনুশীলন করতাম। তার পরে এটাই একদিন ধ্যানজ্ঞান হয়ে দাঁড়াল।
প্র: প্রধানমন্ত্রী আজ আপনাকে ফোন করেছিলেন?
অবনী: হ্যাঁ। এটা সারা জীবনের প্রাপ্তি। আমার মতো একজন ক্ষুদ্র প্যারা-শুটারকে প্রধানমন্ত্রী ফোন করছেন টোকিয়োতে! ভাবা যায়! এতেই বুঝলাম যে নিষ্ঠা, সংকল্প রেখে গত পাঁচ বছর অনুশীলন করে গিয়েছি, তা সফল হয়েছে।
প্র: এ বার এই টোকিয়ো থেকে ভারতের অলিম্পিক্স ইতিহাসে অ্যাথলেটিক্স থেকে প্রথম সোনা পেয়েছেন নীরজ চোপড়া। তিনি আপনার জন্য আজ ফের টোকিয়োর পুরস্কার মঞ্চে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত শুনে আপনাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
অবনী: তাই নাকি! এটাও তো একটা প্রাপ্তি। এ বার অলিম্পিক্সে নীরজ ভাইয়া একাই ভারতের সব খেলোয়াড়কে লড়াই করে সফল হওয়ার নতুন প্রেরণা দিয়েছেন। ওঁর দেখানো পথ ধরেই আমরা এগোচ্ছি।
প্র: আজ ফাইনাল পর্বে বিড়বিড় করে কী বলছিলেন?
অবনী: হুইলচেয়ারে বসে আমাকে একবারে একটা শুট করতে হচ্ছিল। তা নিখুঁত হতেই হবে। পয়েন্টের দিকে চোখ রেখে চাপ বাড়তে দিইনি। নিজেকে বলছিলাম—তুমি পারবেই অবনী। চলো, আজ কিছু করে দেখাই।
প্র: ২০১২ সালের দুঘর্টনার সেই দিনটা আজ মনে পড়ে?
অবনী: আজও চোখ বুঝলে সেই দিনটা দেখতে পাই। গাড়ি করে নাচের স্কুলে যাচ্ছিলাম জোধপুরে। আমার বয়স তখন ১১ বছর। চোখটা লেগে এসেছিল। তখনই দুর্ঘটনা ঘটে। গাড়িটা তিনটে পাক খেয়ে রাস্তার পাশে গিয়ে পড়েছিল। রক্তে ভেসে যাচ্ছিলাম। চারদিকটা কেমন ঘোলাটে লাগছিল। অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যেই জ্ঞান হারাই। হাসপাতালে চেতনা ফেরার পরে দেখেছিলাম আমার পা নেই। বাদ গিয়েছে। আমি কিন্তু সে দিনও ভয় পাইনি। বুঝেছিলাম, এ ভাবেই আমাকে জীবনে এগোতে হবে।
প্র: তার পরে?
অবনী: প্রায় ছ’মাস শয্যাশায়ী ছিলাম। তার পরে কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করত না। ধীরে ধীরে ফের স্বাভাবিক হই। আমি বসতে পর্যন্ত পারতাম না। সব কিছুই আবার নতুন করে শিখতে হয়েছিল। বসাটাও। স্কুলে যাওয়া শুরু করার পরে অবসাদটা কমে গিয়েছিল। হুইলচেয়ারে বসে তিরন্দাজি শুরু করেছিলাম স্কুলে। তার পরে ২০১৬ সালে গরমের ছুটিতে কেবল মজার জন্যই জয়পুরে স্থানীয় ক্লাবে গিয়ে শুটিং শুরু করি। প্রথম দিন মনে আছে, ভারি বন্দুকটা ধরতে খুব কষ্ট হয়েছিল। ধীরে ধীরে সব শিখে নিয়েছি। স্কুলেই প্রথম প্রতিযোগিতা। তার পরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় নেমে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়েছে প্রচুর। সেগুলোই আজ কাজে দিয়েছে। ।
প্র: সাফল্যের জন্য আপনার মন্ত্র কী?
অবনী: সাফল্য অর্জনের কোনও সোজা রাস্তা নেই। পরিশ্রম করে যেতেই হবে নিরলস ভাবে। আত্মতুষ্ট হওয়া চলবে না। আমি এ বার প্যারালিম্পিক্সে আরও তিন ইভেন্টে নামব। তাই এই সোনায় আত্মতুষ্ট হয়ে থেমে গেলে চলবে না। আরও পদক চাই।