Advertisement
E-Paper

ভিভ-সচিনদের ছাপিয়ে ক্রিকেটে বিরাট বিপ্লব

ক্রিকেটে বরাবরই ধরে নেওয়া হয় যে, প্রথম ইনিংসে ব্যাট করা অপেক্ষাকৃত সহজ। তখন পিচ ভাল থাকে, পরিস্থিতি অনুকূল থাকে। কোনও নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছনোর চাপ থাকে না।

সুমিত ঘোষ

শেষ আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৩:৪৬
যুগলবন্দি: প্রথম ম্যাচে জয়ের দুই কারিগর বিরাট-অজিঙ্ক। —ফাইল চিত্র।

যুগলবন্দি: প্রথম ম্যাচে জয়ের দুই কারিগর বিরাট-অজিঙ্ক। —ফাইল চিত্র।

মাইকেল ভন বৃহস্পতিবারের ম্যাচ দেখার পরে টুইট করেছেন, ক্রিকেটের ইতিহাসে কোহালিই সেরা ‘চেজমাস্টার’। এত সফল ভাবে আর কেউ কখনও রান তাড়া করতে পারেননি। যতই ভারত-পাক ক্রিকেট বন্ধ থাকুক, ওয়াঘার ও পারে থেমে নেই বিরাট-বন্দনা। শোয়েব আখতার টুইটারে লিখেছেন, তাড়া করার ক্ষেত্রে মনে আসে শুধু দু’টো নাম। কোহালি এবং চিতা!

ক্রিকেটে বরাবরই ধরে নেওয়া হয় যে, প্রথম ইনিংসে ব্যাট করা অপেক্ষাকৃত সহজ। তখন পিচ ভাল থাকে, পরিস্থিতি অনুকূল থাকে। কোনও নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছনোর চাপ থাকে না। ম্যাচ জেতানোর প্রশ্ন অনেক বেশি করে আসে শেষ ইনিংসে। টেস্টের ক্ষেত্রে সেটা চতুর্থ ইনিংস, ওয়ান ডে-র ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ইনিংস অর্থাৎ রান তাড়া করার সময়।

শেষ ইনিংসে কার ব্যাটিং গড় কত? কেরিয়ারে কটা সেঞ্চুরি এসেছে ম্যাচ জেতানো মুহূর্তে? কে কত সফল ভাবে রান তাড়া করেছে? চিরকাল এই ফর্মুলা মেনেই ব্যাটসম্যানের শ্রেষ্ঠত্ব বিচার করা হয়েছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে ওয়ান ডে ব্যাটিংয়ের ভাষাই পাল্টে দিয়ে যাচ্ছেন কোহালি। ওয়ান ডে-তে এমনিতেই তাঁর ব্যাটিং গড় ঈর্ষণীয়— ৫৬.০৮। রান তাড়া করার সময় তাঁর গড়— ৬৫.৮৪।

কিন্তু ক্রিকেট গবেষকদের চোখ কপালে উঠছে রান তাড়া করে ম্যাচ জেতার ক্ষেত্রে কোহালির অবিশ্বাস্য পরিসংখ্যান দেখে। রান তাড়া করে জেতা ম্যাচে কোহালির ব্যাটিং গড় ৯৪.০৪। টেস্টের ব্র্যাডম্যানীয় গড়কে মনে করানোর মতো। এখানেই শেষ নয়। বৃহস্পতিবারের ডারবানে তিনি করে ফেললেন ৩৩তম সেঞ্চুরি। এর মধ্যে ২০টি এসেছে রান তাড়া করার সময়। আরও চমকপ্রদ হচ্ছে, এই ২০টি সেঞ্চুরির মধ্যে ১৮টি সেঞ্চুরির ম্যাচে ভারত জিতেছে। এ রকম ম্যাচ জেতানোর হার ক্রিকেট ইতিহাসে আর কারও নেই। এখনও পর্যন্ত তিন বার ওয়ান ডে-তে সাড়ে তিনশোর উপর রান তাড়া করে জিতেছে ভারত। তিন বারই কোহালি সেঞ্চুরি করেছেন।

মহম্মদ আজহারউদ্দিনের চোখে এত কাল রান তাড়া করার সময় সেরা ম্যাচউইনার ছিলেন মাইকেল বিভান। যিনি এ বার বাংলাদেশের ব্যাটিং কোচ হিসেবে যোগ দিচ্ছেন বলে খবর। কিন্তু আজহার শুক্রবার ফোনে বললেন, ‘‘বিভান দারুণ ছিল। পরে ব্যাট করে কী ভাবে যে সব হিসেব উল্টে দিয়ে ম্যাচ জিতিয়ে দিত! কিন্তু বিরাট সেই শিল্পকে আরও অনেক এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। ও আরও মজবুত। বিরাট-ই এক নম্বর।’’

রান তাড়া করে জেতা ম্যাচে বিভানের ব্যাটিং গড় ৮৬.২৫। কিন্তু কোহালি তাঁকেও ছাপিয়ে যাচ্ছেন। রান তাড়া করে বিভান যেখানে ৬৭.৬০ স্ট্রাইক রেটে ৭৫টি ম্যাচ জিতেছেন, কোহালি সেখানে ইতিমধ্যেই ৭৪টি ম্যাচ জিতেছেন নব্বইয়ের উপর স্ট্রাইক রেট রেখে। আজহার মনে করছেন, কোহালির ধারাবাহিকতার সঙ্গে স্ট্রাইক রেটের দিকে চোখ রাখাটাও জরুরি। ‘‘সেরা ব্যাটসম্যান মানে সে বোলারদের শাসন করে রান করতে পারবে। এই ব্যাপারে বিরাট সবাইকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। সব সময় রান করার চেষ্টা করে যাচ্ছে ও।’’

কোহালির ব্যাটিংয়ে সব চেয়ে বেশি করে চোখে পড়ার মতো ব্যাপার হচ্ছে, টি-টোয়েন্টি প্রজন্মের পাওয়ার হিটিং তাঁর অস্ত্র নয়। হাত ভর্তি ট্যাটু নিয়েও তিনি ক্লাসিকাল ঘরানার। মাটিতে খেলতে বেশি পছন্দ করেন। ফিল্ডারদের মধ্যে ফাঁক খুঁজে বাউন্ডারি আদায় করে নেওয়ার লুপ্তপ্রায় শিল্প সীমিত ওভারের ক্রিকেটে বাঁচিয়ে রেখেছেন তিনি। ছক্কার রাজা না হয়েও তিনি ওয়ান ডে ক্রিকেটের বাজি জেতানো বাজিগর। আইপিএলে এক মরসুমে চারটি সেঞ্চুরি করে ফেলতে পারেন ধ্রুপদী ভঙ্গিতেই।

ক্রিকেট জীবনে ফিটনেস এবং ফিল্ডিংয়ে খুব জোর দিতেন আজহার। সেই কারণে কোহালির স্টাইলের প্রতি অন্য রকম একটা টান রয়েছে। কব্জির মোচড়ে দু’জনেই ক্রিকেট মাঠে মায়াজাল সৃষ্টি করতে পারেন। প্রাক্তন ভারত অধিনায়কের বিশ্লেষণ, ‘‘বিরাট দারুণ ফিট এবং সজাগ। ওর ইনিংসে সব চেয়ে বেশি দেখা যায় দুই রানের প্রভাব। হি ইজ আ মাস্টার অব টু রান্‌স। দ্রুত রান করে অথচ, ঝুঁকি নেয় না। অসাধারণ!’’

সুনীল গাওস্কর আবার আচ্ছন্ন অন্য বিরাট-গুণে। যিনি ক্রিকেট জীবনে পঞ্চাশকে একশোয় পরিণত করার ‘মাস্টার’ ছিলেন, সেই সানি দক্ষিণ আফ্রিকায় টেস্ট সিরিজের সময় বলছিলেন, ‘‘বিরাটের বড় রানের খিদেটা দেখার মতো। কনভার্শন রেট অসাধারণ। দেখা যাবে ২০বার পঞ্চাশ পেরিয়ে থাকলে অন্তত ১৬-১৮বার সেঞ্চুরি করেছে। সেট হয়ে গেল মানে সেঞ্চুরি বা আরও বড় রান করে ফিরবে। এ যুগের প্রত্যেক ব্যাটসম্যানের এটা শেখা উচিত বিরাটের থেকে।’’

ভিভিয়ান রিচার্ডস এবং সচিন তেন্ডুলকর। তাঁর ভীষণ প্রিয় দুই নায়ক। সচিনের শারজার সেই বিখ্যাত মরুঝড়ের ইনিংস দেখে বালিশে মাথা গুঁজে তাঁর ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু। সচিনের সঙ্গে তুলনা উঠলেই তাই আঁতকে উঠে বলে ফেলেন, ‘‘প্লিজ, ওঁর আশেপাশেও আসার যোগ্য নই।’’ আর ভিভের কথা উঠলে তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘হেলমেট ছাড়া একটা লোক দুনিয়ার সেরা ফাস্ট বোলারদের শাসন করেছে। আমাকে এখন কেউ মোটা পুরস্কার দিলেও খালি মাথায় নামতে পারব না।’’ তবু ঘটনা হচ্ছে, কিংগ রিচার্ডসদেরও এখন রান তাড়া করে জেতার সাফল্যে অনেক পিছনে ফেলে দিচ্ছেন কিংগ কোহালি।

তুলনায় কাছাকাছি আসতে পারেন শুধু তাঁর প্রাক্তন অধিনায়ক মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। রান তাড়া করে জেতা ম্যাচে ধোনির ব্যাটিং গড় ১০২.৮৮। তবে গত দু’বছরে এমন অনেক ইনিংস রয়েছে, যেখানে কোহালি জয়ের মঞ্চ গড়ে দিয়ে গিয়েছেন। তার পরে এসে ধোনি জয়ের স্ট্রোক নিয়ে নট আউট থেকেছেন। যেমন ঘটল বৃহস্পতিবারের ডারবানে। সেই কারণে তাঁর গড় বেশি দেখাতে পারে। আবার এটাও ভুললে চলবে না যে, নিজের সেরা সময়ে মাইকেল জর্ডানের মতোই ম্যাচের শেষ মুহূর্তে গিয়ে বহুবার জিতিয়ে দিয়েছেন ‘ক্যাপ্টেন কুল’।

ভারতীয় ওয়ান ডে ব্যাটিংয়ের ইতিহাসে বাকি সব জুটিকে ছাপিয়ে গিয়ে জয়-বীরু হিসেবেই হয়তো থেকে যাবেন তাঁরা। এক জন ‘চেজমাস্টার’। অন্য জন ‘ফিনিশার’! গব্বরের ডেরায় গিয়ে তাঁর বাহিনীকে কুপোকাত করতেও বুক কাঁপে না যুগলবন্দির।

Cricket Virat Kohli
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy