পল দ্য অক্টোপাসের মতো ক্রিকেট সংখ্যাতত্ত্ববিদ বা জ্যোতিষীরা তাই আইপিএল বাজারে জাঁকিয়ে বসেছেন সেই প্রথম বছর থেকে। জার্সির রং থেকে শুরু করে কার পিঠে কী নম্বর থাকবে। কোনটা ভাল, কোনটা শুভ— বারবার তাঁদের কথা শোনা হয়। রাইজিং পুণে সুপারজায়ান্টসের মালিক সঞ্জীব গোয়েন্কা এ সবে বিশ্বাস করেন কি না জানি না। তবে তাঁর ঘনিষ্ঠরা কেউ কেউ বলছিলেন, পুণে শহরটা আমাদের টিমের পক্ষে মোটেও শুভ নয়। আইএসএলে এটিকে এখানেই চেন্নাইয়ের কাছে সেমিফাইনাল হেরেছিল। মাঠটা এমনই অপয়া যে এখানে কি না আমরা চারটে পরপর হারলাম।
বিষ্যুদবার কোটলায় পুণে সুপারজায়ান্টসের দুই বদলি বিদেশি উসমান খোয়াজা আর জর্জ বেইলি যতই প্র্যাকটিসে নেমে পড়ুন, তাঁদের সঙ্গে দিল্লির যুদ্ধ নিয়ে দেশের নিরপেক্ষ ক্রিকেট জনমানসে বিশেষ সাড়া থাকার কথা নয়। আইপিএল নিয়ে এমনিতেই উত্তেজনা তাপপ্রবাহ অনেক কম। তার ওপর এটা কি না টেবলের দু’নম্বরের সঙ্গে ছয় নম্বরে থাকা টিমের ম্যাচ।
একটা টিম জাহির খানের নেতৃত্বে টগবগ করে যৌবনের সরণিতে দৃপ্ত কুচকাওয়াজ করছে। দূর থেকে সেটা নিরীক্ষণ করছেন মেন্টর রাহুল দ্রাবিড়। আর এরা কি না প্রৌঢ়ত্বের সরু গলিতে অসংলগ্ন ফিসফাসে জীর্ণ। রাতে পুণে টিমের কথাবার্তা শুনে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। দু’জন সিনিয়র ক্রিকেটার বললেন গুজরাত লায়ন্স এখন যা-ই খেলুক, কাপ ফেভারিট দিল্লি।
শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, দিল্লি টিম যত ঝলমলে হচ্ছে , পুণেকে তত ম্যাচ টেনশনের চাপে আগুনে পোড়া দেখাচ্ছে। গত ক’দিন ধরে চলা ৪২ ডিগ্রি গরমের অসহ্য দিল্লি আজ কোথায়! নেমে ৩৬ ডিগ্রিতে চলে এসেছে। আর্দ্রতার হারও অনেক কম! অথচ ধোনিদের হারের উনুন জ্বলেই চলেছে। গোটা টিমে কেউ জানে না কাল কম্বিনেশন কী হবে। ধোনি টস জিতলে ব্যাট করবেন, না ফিল্ড।
সকালে টিম হোটেলে ঢোকার সময় স্টিভন ফ্লেমিংয়ের মুখোমুখি পড়ে গিয়েছিলাম। কোচের এত সুন্দর চেহারাটা যেন দুর্ভাবনায় কুঁকড়ে থাকা। ফ্র্যা়ঞ্চাইজি ক্রিকেটে হার খুব খারাপ। নিয়মিত হার তো আরও অসহনীয়। দক্ষিণ ভারতের এক ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকের কথা শোনা যায়, যিনি টিম টানা দু’ম্যাচ হারলে টয়লেটের বাইরে থেকে চিৎকার করে গালাগাল করতেন।
সঞ্জীব গোয়েন্কা সেই তুলনায় শিশু সাহিত্য। হস্তক্ষেপ করেন না। খুব প্রয়োজন না হলে ধোনির ওপরেই এখানে পুরোটা ছেড়ে দেওয়া। কিন্তু টিম যদি ক্রমশ এতগুলো ম্যাচ হারতে থাকে, যে কোনও মালিকই তার সংগঠনের ভাবমূর্তি নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়বে।
ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে ধোনির এ বারের পুণে যেন তাঁকে কোথাও পাঁচ বছর আগের পুণের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছে। দু’টো মুখের জোড় আচমকা পুণেতে মিশে গিয়েছে। ধোনি আর সৌরভ! সে বার সৌরভের পুণেও টানা ম্যাচ হারতে হারতে এমন হয়েছিল যে, লন্ডনে বসে থাকা কর্তারা ইডেন ম্যাচের ব্যাটিং অর্ডার বাছতে থাকেন।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং তারও আগে প্রগাঢ় ধোনি-ভক্ত বাবুল সুপ্রিয় বুধবার রাতে বলছিলেন, ‘‘আইপিএলে ধোনি কী উইকেটকিপিং করছে দেখছেন? জাস্ট ফাটিয়ে দিচ্ছে।’’
সমস্যা হল, কথাটা সত্যি হয়েও ধোনি রান পাচ্ছেন না। তাঁর মার্কশিটে প্রথম সাবজেক্ট অধিনায়কত্ব। সেকেন্ড পেপার ব্যাটিং। আর অপশনাল সাবজেক্ট হল কিপিং। একে তো ম্যাচ জিতছেন না। তা-ও আবার ৮ ম্যাচে রান করেছেন মাত্র ১৪৬। গড় ৩৬। এটা সিএসকের হয়ে হলে এত চোখে পড়ত না। কিন্তু এদের তো ব্যাটিং ভরসাও তিনি। টিমের মধ্যে প্রশ্ন উঠছে এত কম বল খেলছেন কেন ধোনি?
তাঁর বোলিং পরিবর্তন নিয়েও সমালোচনা এবং তারও আগে সন্দেহের ঝড় উঠছে। মুম্বইয়ে সিসিআইয়ের কাউন্টারে থাকা ছেলেটি থেকে বাংলা অধিনায়ক মনোজ তিওয়ারি সবাই এক কথা বলছেন, অশ্বিনের সঙ্গে কি ধোনির কিছু হয়েছে? ৮ ম্যাচে যেখানে টিমের এক নম্বর বোলারের ৩২ ওভার পাওয়ার কথা সেখানে তাঁকে করানো হয়েছে ২৫ ওভার। গ্রিনস্টোন লোবো বলছিলেন, ‘‘ধোনির খারাপ ভাগ্যে অশ্বিনও ঢেকে যাচ্ছে। এখুনি আরসিবির হয়ে খেললে দেখবেন ও বেস্ট বোলার হবে।’’ অশ্বিন সমর্থকেরা জ্যোতিষ-ট্যোতিষ শুনছেন না। তাঁদের অভিযোগ আরও বড়। বুধবার রাতে সঞ্জীব গোয়েন্কার দেওয়া নৈশভোজে এক ধোনি-ঘনিষ্ঠের দেখা পেলাম। তিনি বললেন, ‘‘গোটা বিতর্কটা অহেতুক। অশ্বিন ভাল বল করছে না তাই কম সুযোগ পাচ্ছে। মাহির বরাবরের স্টাইলই তাই। ও ইতিহাসের অ্যালবামে বিশ্বাস করে না। এখনকার ফর্মে বিশ্বাস করে। ও অশ্বিনকে দেখাতে চায়, ভাল বল করে আবার আমার সুনজরে ফেরত এসো। তার আগে ইতিহাসের জন্য আমি কোনও রেয়াত করব না।’’
ছ’ম্যাচে অন্তত পাঁচটা জিততে হবে এমন দলের পক্ষে এই জাতীয় স্পিরিট মোটেই ভাল নয়। কেউ কেউ বলছিলেন, আটটা ম্যাচ হয়ে গেল। আমাদের প্রথম এগারোই তো ঠিক হল না। আঙুল উঠছে সেই ধোনির দিকে। মেঘে আপাত ঢেকে যাওয়া ধোনি অবশ্য অপ্রত্যাশিত এক সমব্যথীকে পাশে পাচ্ছেন। তিনি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। সৌরভ বলছেন, ‘‘টিমে এত চোট আঘাত। শুধু কয়েকটা ম্যাচ হারা দিয়ে ধোনিকে কাঠগড়ায় তুলে দেওয়া উচিত নয়। বোলিং এত খারাপ হলে, এত নিয়মিত বিদেশি প্লেয়ারগুলো চোট পেয়ে গেলে ক্যাপ্টেন কী করবে?’’
জিজ্ঞেস করলাম ইন্টারভিউটা কার নিচ্ছি বলে লিখব? চির নির্বিরোধী ভিভিএস লক্ষ্মণের?
সৌরভ হাসেন, ‘‘হ্যাঁ, লক্ষ্মণ লিখতে পারেন!’’
আজ আইপিএলে
দিল্লি ডেয়ারডেভিলস বনাম রাইজিং পুণে সুপারজায়ান্টস, কোটলা, রাত ৮-০০