Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
East Bengal

ইস্টবেঙ্গল খেললে আইএসএলেরই গুরুত্ব বাড়বে, মনে করছেন প্রাক্তনীরা

আইএসএলের তালা খুলতে চলেছে লাল-হলুদ ক্লাবের কাছে। বাংলার ফুটবলমহল যদিও মনে করছে, এতে ইস্টবেঙ্গলের নয়, মর্যাদা বৃদ্ধি ঘটল ইন্ডিয়ান সুপার লিগেরই।

ইস্টবেঙ্গল আইএসএলে খেললে তা ভারতীয় ফুটবলের পক্ষেই ভাল খবর বলে মনে করছেন প্রাক্তনরা।

ইস্টবেঙ্গল আইএসএলে খেললে তা ভারতীয় ফুটবলের পক্ষেই ভাল খবর বলে মনে করছেন প্রাক্তনরা।

সৌরাংশু দেবনাথ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৬:২৪
Share: Save:

নিছক লাল-হলুদ নয়, বাংলা তথা ভারতের ফুটবল ঘিরে আবেগেরই যেন গণবিস্ফোরণ!

শতবর্ষ পেরিয়ে যাওয়া ইস্টবেঙ্গল পেয়ে গিয়েছে নতুন ক্রেতা শ্রী সিমেন্ট। যার ফলে আইএসএলের তালা খুলতে চলেছে লাল-হলুদ ক্লাবের কাছে। বাংলার ফুটবলমহল যদিও মনে করছে, এতে ইস্টবেঙ্গলের নয়, মর্যাদা বৃদ্ধি ঘটল ইন্ডিয়ান সুপার লিগ (আইএসএল)-এরই। আর সেই সুরের অনুরণন শোনা গেল প্রাক্তনীদের গলায়।

মোহনবাগানের ‘ঘরের ছেলে’ সুব্রত ভট্টাচার্য কোচিং করিয়েছেন ইস্টবেঙ্গলেও। জানেন সমর্থকদের উৎসাহ-উদ্দীপনার কথা। সেই কারণেই আনন্দবাজার ডিজিটালকে বললেন, “ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান ছাড়া ভারতবর্ষের ফুটবল হয় না। আগে হয়নি, আজও হয় না, আগামী দিনেও হবে না। আবার বলছি, মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মহামেডান স্পোর্টিং— এই তিনটে টিম ছাড়া ভারতের ফুটবল ভাবা যায় না। যতই ক্লাব পর্যায়ে খেলুক, ক্লাব পর্যায়ে গত ৫০-৬০-৭০ বছর ধরে এরা যা সাড়া জাগিয়েছে, তা এ দেশের আর কোনও টিম পারেনি। এখনও এই দলগুলোর খেলায় মাঠে দর্শক হয়, লোকে ফুটবল দেখতে আসে। এই টিমগুলোর দলীয় সমর্থন আছে। ইস্টবেঙ্গল ছাড়া মোহনবাগান-মহামেডানের গুরুত্ব কম। আবার মোহনবাগান ছাড়া ইস্টবেঙ্গল-মহামেডানের গুরুত্ব কম। ইস্টবেঙ্গল স্পনসর পেয়েছে, এটা তাই খুব খুশির খবর।”

আরও পড়ুন: ৭০ কোটি ইউরোয় ম্যান সিটিতে মেসি!​

ইস্টবেঙ্গলের আসিয়ান জয়ী কোচ সুভাষ ভৌমিক বললেন, “বিষয়টা বাংলা ফুটবলের স্বার্থে নয়, ভারতীয় ফুটবলের স্বার্থে দেখছি। ভারতীয় ফুটবলের শুরুর সময় ধরে মোহনবাগান, মহামেডান স্পোর্টিং ও ইস্টবেঙ্গল, এই তিনটে দল লিগ্যাসি বহন করছে। একটা ক্লাব আগেই আইএসএলে খেলার ছাড়পত্র পেয়ে গিয়েছিল। আর একটা দল পেতে চলেছে। আমি ৩২ দিন আগে ইস্টবেঙ্গল তাঁবুতে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম যে, আশা করছি আইএসএলে খেলবে দল। আর সেটাই ঘটেছে। কারণ, ডার্বির মাহাত্ম্যটা আইএসএলের মাথায় যাঁরা আসেন, তাঁরা বোঝেন না বলে বিশ্বাস করি না। আর এই বছর যেখানে দর্শকশূন্য স্টেডিয়ামে খেলা হবে, সেখানে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু থাকবে টিভির পর্দা। সেই টিভির পর্দায় ডার্বি হওয়া আর না-হওয়া যে কত বড় তফাত, টিআরপি ওঠানামায় যে কত বিশাল ফারাক, এটা তাঁরা জানেন না বলে মনে করি না। ঈশ্বরের অশেষ দয়া যে আমার কথা সঠিক প্রমাণিত হল।”

ফাঁকা গ্যালারিতে হচ্ছে আইএসএল। —ফাইল চিত্র।

সত্তরের দশকে ফুটবলপ্রেমীদের মন জয় করা সুরজিৎ সেনগুপ্ত বললেন, “ইস্টবেঙ্গলের প্রাক্তনী হিসেবে খুব চাইছিলাম আইএসএলে ক্লাব খেলুক। কারণ, মোহনবাগান আগেই আইএসএলে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। ইস্টবেঙ্গলের সামনে তা অনিশ্চিত ছিল। আমরা, বিশেষ করে যাঁরা ইস্টবেঙ্গলে খেলেছি, তাঁরা সকলেই চাইছিলাম যে আইএসএলে ক্লাবের নামটা ঢুকুক। ইস্টবেঙ্গল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমার যা কথাবার্তা হয়েছিল, তাতে মনে হয়েছিল একটা পথ বের করতে তাঁরাও মরিয়া। শেষ পর্যন্ত দেখার আশ্বাস দিয়েছিলেন কর্তারা। ওঁরা যে লগ্নিকারী পেয়েছেন, আইএসএল খেলার ব্যাপারে মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছে, তাতে খুবই আনন্দিত। ডার্বির কথায় আসি। ডার্বি ম্যাচটা না থাকলে কোনও ফুটবল টুর্নামেন্টই পুরোপুরি জমে না। সম্পূর্ণ হয় না। সেই জন্য ইস্টবেঙ্গলের আইএসএলে অংশ নেওয়া ডার্বির পরিপ্রেক্ষিতে খুব জরুরি ছিল। কোনও সন্দেহ নেই এটা আইএসএলেরই মান বাড়াবে।”

ফুটবলজীবন শেষ করে প্রশাসক হিসেবে মোহনবাগানের সঙ্গে জড়িত সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কাছে এই খবর কী বার্তা আনছে? সত্যজিৎ বললেন, “ভাল খবর। মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গল না থাকলে ভারতবর্ষের ফুটবলে তা মস্ত ক্ষতি। আমি এক জন ফুটবলপ্রেমী হিসেবে বলতে পারি যে, এগোতে গেলে এই দুটো ক্লাবের গুরুত্ব অপরিসীম। এই দুটো ক্লাবের প্রায় এক কোটি সমর্থক রয়েছে। বিগত ১০০ বছর ধরে এই দুটো ক্লাবের ঐতিহ্যই আলাদা। দুটো দল খেললে তাই প্রতিযোগিতার মানই বাড়বে। আইএসএলে কোনও একটা দল খেললে যা হত না।”

আরও পড়ুন: ক্রেতা পেয়ে গেল ইস্টবেঙ্গলও, খোলার অপেক্ষায় আইএসএলের দরজা

যা শোনা যাচ্ছে, তাতে ইস্টবেঙ্গলের লোগো মশাল, জার্সির লাল-হলুদ রং বদলাচ্ছে না। ৮০ শতাংশ শেয়ার থাকবে শ্রী সিমেন্টের। বাকি ২০ শতাংশ থাকবে ক্লাবের হাতে। ইস্টবেঙ্গলের সহকারী সচিব শান্তিরঞ্জন দাশগুপ্ত বললেন, “এখনও এক-দুই শতাংশ কথা বাকি রয়েছে চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে। তাই এগুলো নিয়ে কিছু বলব না। তবে আমাদের তরফে মরিয়া চেষ্টা ছিল শুরু থেকে। এখন যে ভাবে ফিফা বা এএফসি ফুটবল এনডোর্স করছে, তাতে লগ্নিকারী ছাড়া পৃথিবীতে কোথাও চলছে না। নতুন প্রজন্মের ফুটবল যে ভাবে খেলা হচ্ছে, তাতে এই টাকাটা প্রয়োজন। পরিকাঠামোর জন্য বড় হাত ধরতেই হত। সেটাই সময়ের দাবি। যা মানতে না পারলে টিকে থাকা যাবে না। আর আমাদের তো টিকে থাকতেই হবে। সেই কারণেই লগ্নিকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারছি।”

লগ্নিকারী আনতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই ক্লাবের উপর নিয়ন্ত্রণ কমে যায় কর্তাদের। যা অতীতে দেখাও গিয়েছে। বেধেছে সংঘাত। বেড়েছে সমস্যা। তার পরও এটিকের সঙ্গে জোট বেঁধেছে মোহনবাগান। ইস্টবেঙ্গলও কোয়েসের পর আরও এক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হতে চলেছে। মোহনবাগানের প্রশাসনে থাকা সত্যজিৎ এখানে বৃহত্তর স্বার্থের কথা তুলে ধরছেন। তাঁর মতে, “দেখুন, কোনও লগ্নিকারী সংস্থা আসা মানে ক্ষতি শুধু কর্তাদেরই হয়। অবশ্য সেটাকে যদি ক্ষতি বলা হয় তবেই। আমরা যাঁরা নির্বাচনে জিতে এসেছি, তাঁদের অনেক ত্যাগ করতে হয়েছে। আমাদেরই ক্ষমতা থাকে না কোনও সংস্থা এলে। কিন্তু, গুরুত্বপূর্ণ হল, মোহনবাগান বা ইস্টবেঙ্গল ক্লাবগুলো থাকবে। আরও ৫০ বছর যদি ক্লাবগুলো স্থায়িত্ব পায়, সেটা ভাল, নাকি আমাদের ক্ষমতা? সেই লোভের জন্য আঁকড়ে বসে থাকব? এখানে বৃহত্তর স্বার্থ দেখতে হবেই। সবার আগে ভাবতে হবে সদস্য-সমর্থকদের কথা। তাঁরাই তো প্রাণ। পরিচালন কমিটিতে থাকা ৩০টা লোকের জন্য যদি না যুক্ত হই, তবে পরবর্তীকালে জবাবদিহি করতে হবে। আঙুল তুলে বলা হবে, এই লোকগুলো নিজেদের স্বার্থের জন্য এটা করতে দেয়নি। এবং অন্যান্য ক্লাবের মতো আমার নিজের ক্লাব যদি ফিকে হতে থাকে, তবে সেই দায় কে নেবে? নিজেদের স্বার্থ ভুলে গিয়ে তাই আমরা মোহনবাগানের স্বার্থ সবার আগে দেখেছি।”

ডার্বির ভর্তি গ্যালারি। —ফাইল চিত্র।

ইস্টবেঙ্গলের কর্তা শান্তিরঞ্জন দাশগুপ্তের কথাতেও উঠে আসছে সমর্থকদের আবেগ। বললেন, “ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের মূলধন তাদের সমর্থকরা। পরিকাঠামো বা বাইরের চাকচিক্যটা কিছু নয়। সমর্থকদের জন্যই এগিয়ে আসছে সংস্থা। এই সমর্থনটাই সবাই চাই। আমরা চেয়ারে বসেছি চেষ্টা করার জন্যই। দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলেই চেয়ারে বসেছি। তাই যা কিছু ক্রেডিট, তা সমর্থকদেরই প্রাপ্য। এটা ঘটনা, যে সংস্থাই আসুক, তারাই সব কিছু করে। সংস্থার টাকাতেই ক্লাব চলে। তবে আমাদের শক্তি হল সমর্থকরা। সেটা বার বার বলছি।”

প্রাক্তন ফুটবলার তথা সাংসদ প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলাতেও আবেগ। তিনি বললেন, “ভারতবর্ষের ফুটবল এই দুটো টিমকে বাদ দিয়ে হয় না। আইএসএলে সব বানানো টিম। শুনতে খারাপ লাগলেও কথাটা সত্যি। আমি তো চাইব, আইএসএলে ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগানের সঙ্গে মহামেডানকেও নেওয়া হোক। ভারতের ফুটবলের উন্নতির জন্য, মানুষের মনে প্রভাব ফেলতে এটা দরকার। শেষ ডার্বিতেও গিয়েছিলাম। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, এখনও লক্ষ লোক খেলা দেখতে আসে। সবাই ভিতরে ঢুকতে পারেনি, কিন্তু বাইরে ভিড় করে থেকেছে। এই ক্লাবগুলো হল পীঠস্থান। এদের রাখতেই হবে। মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গল দেখিয়ে দেবে আইএসএল কোথায় উঠতে পারে। কারণ, বাকি দলগুলো সাপোর্টার কিনে এনেছে। কিন্তু আসল খেলাটা এ বার শুরু হবে। আমার ভীষণ ভাল লাগছে। আমি নিশ্চয়ই মোহনবাগানের লোক, কিন্তু ফুটবল বাঁচাতে গেলে আবার বলছি মহমেডানকেও দরকার।”

আরও পড়ুন: একই খেলার চারটি জাতীয় দল! অদ্ভুত গোলোকধাঁধার নাম ভারতীয় ডিজেবেলড ক্রিকেট​

ইস্টবেঙ্গলের অন্তর্ভুক্তি মান বাড়াবে আইএসএলের, আগেই বলেছেন সুভাষ-সুরজিৎ। সেই মেজাজেই সুব্রত বললেন, “আইএসএলের উজ্জ্বল দিকটা মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল না খেললে হত না। বাজি ধরে বলতে পারি, যে কোনও রাজ্যে খেলা হোক, মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল না খেললে ফাঁকা থাকবে মাঠ। এই দুটো দল বড় টুর্নামেন্টে সব সময় খেলে এসেছে। সুতরাং, এরা যে আইএসএলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী, সেটা খেলার সময়েই প্রমাণিত হবে।”

প্রসূন আবার আরও আক্রমণাত্মক। তাঁর মতে, “আইএসএলের খেলা যতই লোকে দেখুক, এই টিমগুলোকে লোকে জানে না। এ বার এমন দল খেলবে, যাদের গোটা পৃথিবী চেনে। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের ডার্বি ম্যাচ না হলে মজাটা কোথায়? বাঙাল-ঘটির লড়াই, চিৎকার, লক্ষ লক্ষ লোক দেখে এই ম্যাচ। স্কটল্যান্ড থেকে নিউজার্সি পর্যন্ত আলোচনা চলে এদের নিয়ে। আমি তো বলব, আইএসএল কর্তারা সৌভাগ্যবান। ওদের মাথায় বুদ্ধি এসেছে। এই দুটো দল হল প্রাইম। এদের খেলা দরকার।”

কী দাঁড়াল? ইস্টবেঙ্গল নয়, যেন আইএসএলেই যুক্ত হচ্ছে ‘শ্রী’!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE