দীর্ঘ ১৩৭ বছর আগের কথা। ১৮৮৮ সালে স্কটিশ কাপের বিজয়ী রেন্টন ফুটবল ক্লাবকে বিশ্বের সেরা ক্লাব হতে গেলে জিততে হত স্রেফ একটি ম্যাচ, ইংল্যান্ডের ওয়েস্ট ব্রমউইচ অ্যালবিয়নের বিরুদ্ধে। রেন্টনের ফুটবলারেরা পেশাদার ছিলেন না। কাজ করতেন স্থানীয় ছাপাখানায়। তবু কোনও মতে সেই ম্যাচ তাঁরা জিতে নেন। সেরা ক্লাবের দ্বৈরথে মাত্র দু’টি দল লড়াই করলেও, রেন্টনের ‘বিশ্ব’খেতাব মোটেই হেলাফেলার ছিল না। সেই সময়ে ব্রিটেনের বাইরে কোনও দেশেই গুরুত্ব দিয়ে ফুটবল খেলত না।
সময় বদলে গিয়েছে। এখন বিশ্বের সেরা ক্লাব হওয়ার লড়াই অনেক কঠিন হয়েছে। ১৪ জুন যে প্রতিযোগিতার সূচনা হল আমেরিকায়, সেটাই ক্লাব বিশ্বকাপের আধুনিকতম সংস্করণ। ছয় মহাদেশ থেকে ৩২টি ক্লাব লড়াই করবে। প্রতিযোগিতার আয়োজক ফিফা প্রচণ্ড উত্তেজিত। ফুটবলে ‘বৈপ্লবিক বদল’ হবে বলে আশাবাদী তারা। পকেটও ভরবে। সে কারণেই ক্লাব বিশ্বকাপের পুরস্কারমূল্য রাখা হয়েছে ৮৬০৬ কোটি টাকা।
এত দিন পর্যন্ত এই প্রতিযোগিতা আয়োজিত হত প্রতি বছর ফুটবল মরসুম শেষ হওয়ার পর। মাত্র সাতটি দল খেলত। তবে নতুন ক্লাব বিশ্বকাপকে সাজানো হয়েছে ফুটবল বিশ্বকাপের ধাঁচে, যা এখন থেকে হবে চার বছর অন্তর। ফুটবল বিশ্বকাপের ধাঁচেই ক্লাব বিশ্বকাপের দলগুলিকে ভাগ করা হবে চার দলের আটটি গ্রুপে। সেখান থেকে প্রি-কোয়ার্টার ফাইনাল, কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল এবং ফাইনাল আয়োজিত হবে। স্রষ্টাদের অনুমান, ক্রমশ জনপ্রিয় হবে এই প্রতিযোগিতা। আরও বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়বে। ফিফার আশা, ৯০টি দেশের বেশি খেলোয়াড় ক্লাব বিশ্বকাপে খেলবেন, যা ফুটবল বিশ্বকাপের থেকেও বেশি। অভিবাসীদের দেশে ঢুকতে দেওয়ার ব্যাপারে বেশির ভাগ দেশেরই কঠোর অবস্থান রয়েছে। তবে ফুটবলে এই চিত্রটা সম্পূর্ণ আলাদা। এশিয়ার সেরা লিগগুলিতে প্রায় ১০০০ ব্রাজিলীয়, ২০০ স্পেনীয় এবং ১০০ নাইজেরীয় খেলেন। ব্রাজিল থেকে সবচেয়ে বেশি ফুটবলার বিদেশে খেলতে যান। সেই ব্রাজিলের স্থানীয় লিগেও ১০০ জনের বেশি বিদেশি খেলেন, যাঁদের কেউ অ্যাঙ্গোলার, কেউ আবার দক্ষিণ কোরিয়ার।
শুধু ফুটবলারেরাই সীমান্ত পেরোন না, ফুটবল সংস্কৃতিরও সীমানা বদল হয়। ফুটবলের সঙ্গে যুক্ত যা যা রয়েছে, তা অনুসরণ করার একটা প্রবণতা রয়েছে গোটা বিশ্বেই। ধরা যাক ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তার ক্লাব পার্সিয়ার কথা। দলের খেলা থাকলেই সমর্থকেরা স্থানীয় বাহাসা ইন্দোনেশিয়া ভাষায় গান গাইতে থাকেন। তবে সেই সুরের ধরন ইউরোপীয়। খেলার খারাপ দিকগুলিও অনুকরণ করতে ছাড়েন না কেউ। ইউরোপের প্রতিটি ক্লাবেই গোঁড়া সমর্থক রয়েছেন, যাঁরা পরিচিত ‘আল্ট্রা’ নামে। এখন বিশ্বের প্রতিটি দেশেই সেই ‘আল্ট্রা’ গ্রুপ রয়েছে। ইন্দোনেশিয়ায় দুই শত্রু দল পার্সিয়া এবং পার্সিব বান্দুং মুখোমুখি হলে মাঠ এবং মাঠের বাইরে মারপিট হবেই।

ক্লাব বিশ্বকাপের ম্যাচে মেসি। ছবি: রয়টার্স।
অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেড ইউনাইটেড থেকে জ়াম্বিয়ার জ়ানাকো, গোটা বিশ্বে চার হাজারেরও বেশি পেশাদার ক্লাব রয়েছে। তবে ইউরোপের ক্লাব ফুটবলের জনপ্রিয়তা বাকি বিশ্বের থেকে অনেক বেশি। ফুটবলের প্রাণকেন্দ্র এখনও ইউরোপ। বাকি বিশ্বের থেকে ইউরোপের ক্লাবগুলির মান ভাল এবং তারা ধনী। ১৫ জুন ক্লাব বিশ্বকাপের একটি ম্যাচেই সেটা বোঝা গিয়েছে। নিউ জ়িল্যান্ডের অকল্যান্ড সিটিকে ১০-০ গোলে হারিয়েছে বায়ার্ন মিউনিখ। জার্মানির চ্যাম্পিয়ন বায়ার্নের গত মরসুমে লাভ ৭৫৫৫ কোটি। প্রতি সপ্তাহে তাদের স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে যান ৭৫ হাজার দর্শক। তারকা ফরোয়ার্ড হ্যারি কেনকে বিশ্বের সেরা স্ট্রাইকারদের মধ্যে ধরা হয়। উল্টো দিকে, অকল্যান্ডের লাভ হয়েছে ৫.৫৯ কোটি টাকা। প্রতি ম্যাচে গড়ে ৪০০ জন হাজির থেকেছেন। দলের ফরোয়ার্ড অ্যাঙ্গাস কিলকোলি কাজ করেন একটি রংয়ের কারখানায়।
এই বৈপরীত্য এখানেই শেষ নয়। আমেরিকার এক কনসালটেন্সি ফার্মের দাবি, বিশ্বের ধনীতম ক্লাব, স্পেনের রিয়াল মাদ্রিদ ২০২৩-২৪ মরসুমে আয় করেছিল ৯৯৬০ কোটি টাকা। ব্রাজিলের ধনীতম ক্লাব ফ্ল্যামেঙ্গোর থেকে যা পাঁচ গুণ বেশি। বিশ্বের ধনীতম ৩০টি ক্লাবের তালিকায় ফ্ল্যামেঙ্গো বাদে বাকি সব ক’টিই ইউরোপীয়। যে কারণে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের উঠতি ফুটবলারেরা অন্তত এক বার ইউরোপে খেলতে চান। পেলে কোনও দিন ইউরোপে খেলেননি। তবে দিয়েগো মারাদোনাকে ২১ বছর বয়সে সই করায় বার্সেলোনা। লিয়োনেল মেসি ১৩ বছর বয়সে বার্সেলোনায় চলে যান।

মারাদোনার ছবি নিয়ে হাজির বোকা জুনিয়র্সের সমর্থকেরা। ছবি: রয়টার্স।
আশ্চর্যের ব্যাপার হল, সেই বার্সেলোনাই নবরূপে সজ্জিত ক্লাব বিশ্বকাপে খেলতে পারছে না। শুধু তারা নয়, ইংল্যান্ডের চ্যাম্পিয়ন দল লিভারপুল এবং ইটালির বিজয়ী নাপোলিও খেলছে না। আসলে, ইউরোপের ১২টি ক্লাবকে বেছে নেওয়া হয়েছে র্যাঙ্কিংয়ের ভিত্তিতে। এই র্যাঙ্কিং তৈরি হয়েছে গত চার বছর তাদের পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে। সে কারণে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতায় চেলসি, ম্যাঞ্চেস্টার সিটি এবং রিয়াল মাদ্রিদ ক্লাব বিশ্বকাপে খেলছে। র্যাঙ্কিং অনুযায়ী বাকি ক্লাবগুলি হল বায়ার্ন মিউনিখ, প্যারিস সঁ জরমঁ, ইন্টার মিলান, পোর্তো, বেনফিকা, বরুসিয়া ডর্টমুন্ড, জুভেন্টাস, আতলেতিকো মাদ্রিদ এবং আরবি সালজ়বুর্গ। বার্সেলোনা গত ১০ বছরে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতেনি। লিভারপুল ২০২২ সালে ফাইনালে উঠলেও হেরে যায়। গত চার বছরের ভিত্তিতে যে র্যাঙ্কিং তৈরি হয়েছে, সেখানেও তাদের অবস্থান প্রথম ১২-র মধ্যে ছিল না। পাশাপাশি, একটি দেশ থেকে দু’টির বেশি ক্লাব খেলতে পারবে না। চেলসি এবং ম্যান সিটি সুযোগ পাওয়ায় লিভারপুলের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়।
আগের ক্লাব বিশ্বকাপগুলিতে ইউরোপীয়দের দাপট দেখা গিয়েছে। শেষ ১৭টা ট্রফির ১৬টিই জিতেছে ইউরোপের কোনও ক্লাব। এ বারও ট্রফি দাবিদার সেরা ন’টি ক্লাবের মধ্যে সব ক’টিই ইউরোপীয়। সমর্থকদের আশঙ্কা, ইউরোপীয়দের এই দাপটের কারণে প্রতিযোগিতার যে আকর্ষণ, সেটাই কমে গিয়েছে।
তবে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হচ্ছে অন্য বিষয় নিয়ে। অনেকেরই ধারণা, নতুন ভাবে সাজানো ক্লাব বিশ্বকাপ আদতে ফিফার অর্থ উপার্জনের একটি পন্থা। আদতে তারা উয়েফার আয়োজিত চ্যাম্পিয়ন্স লিগকে টেক্কা দিতে চাইছে। ফিফা চার বছর অন্তর ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজন করে, যার জনপ্রিয়তা রয়েছে। কিন্তু ক্লাব বিশ্বকাপ এখনও সেই জনপ্রিয়তা পেতে পারেনি। আমেরিকায় প্রথম বার এত বড় মাপের ফুটবল প্রতিযোগিতা হলেও প্রত্যাশামাফিক টিকিট বিক্রি হচ্ছে না। সম্প্রচার নিয়ে শেষ মুহূর্তেও দোলাচলে ছিল ফিফা। শেষ পর্যন্ত ‘ডিএজ়েডএন’ বিশ্বব্যপী সম্প্রচারস্বত্ব কিনে নেয়। তবে ফিফা যা ভেবেছিল (আনুমানিক ৩৪,৪০৮ কোটি টাকা), তার থেকে অনেক কম দামে (৮৬০৬ কোটি টাকা)। এই প্রতিযোগিতার মূল স্পনসর সৌদি আরবের ‘পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড’। অনেকের ধারণা, ২০৩৪ বিশ্বকাপের আয়োজক সৌদিরা নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার জন্যই ক্লাব বিশ্বকাপ স্পনসর করতে রাজি হয়েছে।

বোতাফোগো বনাম সিয়াটল ম্যাচে ফাঁকা দর্শকাসন। ছবি: রয়টার্স।
ইউরোপীয়দের কাছে এই প্রতিযোগিতা নিয়ে একটা ছুৎমার্গ থাকলেও, বাকি মহাদেশের ক্লাবগুলি বেশ উত্তেজিত। আসলে তাদের কাছে সুযোগ রয়েছে এটা প্রমাণ করার, যে চাইলে ইউরোপীয় ক্লাবগুলিকে তারাও হারাতে পারে। আর্জেন্টিনা এবং ব্রাজিলের স্থানীয় লিগগুলি নিজেদের মতো করে সূচি বদলে নিয়েছে, যাতে সে দেশের ক্লাবগুলি বিশ্বকাপে সাফল্য পায়। ট্রফির দাবিদার ইউরোপীয় ক্লাব হলেও, ২০ শতাংশ সুযোগ রয়েছে বাকি মহাদেশের ক্লাবগুলির কাছেও। পরিসংখ্যান সংক্রান্ত একটি ওয়েবসাইটের দাবি, বাকি বিশ্বের সবচেয়ে সফল ক্লাব যে কোনও ইউরোপীয় লিগের মাঝামাঝি স্থানে থাকবে। সেরা হওয়া দূরের কথা। তবু অখ্যাত কোনও এশীয় বা লাতিন আমেরিকার ক্লাবের কাছে একই প্রতিযোগিতায় ম্যাঞ্চেস্টার সিটি বা প্যারিস সঁ জরমঁর মতো দলের বিরুদ্ধে খেলা অনেক বড় ব্যাপার। এশিয়ার ফুটবল সংস্থার (এএফসি) প্রধান দাতো উইন্ডসর জনের মতে, এশীয় ক্লাবগুলির কাছে সুযোগ রয়েছে বিশ্ব ফুটবলের মানচিত্রে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার। আফ্রিকার ফুটবল সংস্থার প্রধান লুক্সোলো সেপ্টেম্বরের মতে, ফুটবল নিয়ে তাঁদের মহাদেশের ধারণাটাই বদলে যেতে পারে, যদি বিশ্বকাপে আফ্রিকার কোনও ক্লাব সফল হয়।
আরও পড়ুন:
ইউরোপীয়দের খুঁতখুঁতানি, অহংকারী মনোভাব আগেও ছিল, পরেও থাকবে। তবে বাকি বিশ্বের দেশগুলি সাদরে ফিফার এই নতুন প্রতিযোগিতাকে স্বাগত জানিয়েছে। বিশ্বের সেরা ক্লাবগুলির সঙ্গে টেক্কা দেওয়ার সুযোগ সব সময় আসে না। তাই কেউই এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইছে না।