শিরোনামের শব্দটির সঙ্গে ‘লাভ’ বা পিয়ানোর সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক আছে ফুটবলের। বিশ্ব ফুটবলে আবার নতুন করে আলোচিত হচ্ছে ‘লাভলপিয়ানা মডেল’।
ফুটবলে প্রতি দিন বদলাচ্ছে খেলার ধরন। নতুন প্রযুক্তি, নতুন ফুটবলারের পাশাপাশি উঠে আসছেন নতুন কোচেরাও। আধুনিক প্রশিক্ষকদের মাথা থেকেই বেরিয়েছে ‘লাভলপিয়ানা মডেল’ বা ‘লাভলপিয়ানা বিল্ড-আপ’। ইউরোপীয়, বিশেষ করে ইংল্যান্ডের ফুটবলে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই মডেল। বিশেষ ধরনের এই ফর্মেশনের সুবিধা নিচ্ছে একাধিক দল। এমনকি, শুধু এই ছকের সঙ্গে মানানসই বিশেষজ্ঞ ফুটবলার নেওয়া হচ্ছে।
ফুটবলে অনেক দিন ধরেই প্রচলিত ৪-৪-২ ছক। যা সবচেয়ে ‘সুরক্ষিত এবং নিরাপদ’ বলেই পরিচিত। ভারতীয় ফুটবলে অমল দত্ত প্রথম বার এই ছকে দলকে খেলিয়েছিলেন, যা তখন পরিচিত হয়েছিল ‘ডায়মন্ড’ ছক নামে। এই ছকে চার ডিফেন্ডার, চার মিডফিল্ডার এবং দুই স্ট্রাইকারে খেলা হয়। ইদানীং এই ছক বদলে কোচেরা নিজেদের সুবিধা মতো ৪-৩-১-২ করে দেন। আরও একটু সাহসী কেউ কেউ ৪-১-২-১-২ ছক সাজান। তবে এই ছকে চার ডিফেন্ডার থাকেই।
লাভলপিয়ানা কী?
প্রচলিত ফুটবল ছকগুলোতে ইদানিং সামান্য বদল দেখা যাচ্ছে। চার ডিফেন্ডারের মধ্যে যাঁরা দু’প্রান্তে খেলেন, সেই ‘ফুলব্যাক’দের আরও স্বাধীনতা দেওয়া হচ্ছে আক্রমণে উঠে যাওয়ার ক্ষেত্রে। তাঁরা উপরে গিয়ে দুই উইঙ্গারকে সাহায্য করছেন অথবা দু’প্রান্ত থেকে বক্সে ক্রস তুলছেন। মাঝমাঠে দ্রুত বল দেওয়া-নেওয়ার জন্যও তাঁদের কাজে লাগানো হচ্ছে। যা সাধারণত করে থাকেন মিডফিল্ডারেরা। আক্রমণের সময় মাঝমাঠে ফুটবলার আরও বাড়িয়ে ‘নিউমেরিক্যাল সুপ্রিমেসি’-ই এই ছকের লক্ষ্য। এটাই লাভলপিয়ানা। অনেকেই অবশ্য একে ‘ছক’ বলতে নারাজ। তাঁদের মতে, লাভলপিয়ানা একটি ‘ফর্মেশন’। এই ফর্মেশন অনুযায়ী চার ডিফেন্ডারের সামনে শুরু করছেন এক ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার। দুই ফুলব্যাক উঠে গেলে তিনি রক্ষণের মাঝে নেমে আসছেন। মাঝে যে দু’জন সেন্টার-ব্যাক রয়েছেন, তাঁরা তখন মাঠের দু’প্রান্তে চলে যাচ্ছেন। ফলে আক্রমণে ওঠা সহজ হয়ে যাচ্ছে।
লাভলপিয়ানা ফর্মেশনে কারা খেলছে
এ বারের প্রিমিয়ার লিগে আর্সেনাল বনাম ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড ম্যাচে এই ছক দেখা গিয়েছে। আর্সেনালের নতুন মিডফিল্ডার মার্তিন জুবিমেন্দি প্রয়োজনমতো নেমে আসছিলেন রক্ষণের মধ্যে। দু’প্রান্তে সরে যাচ্ছিলেন সেন্টার-ব্যাক গ্যাব্রিয়েল এবং উইলিয়াম সালিবা। এই ছক কাজে লাগিয়েছে লিভারপুলও। কমিউনিটি শিল্ডে ক্রিস্টাল প্যালেসের বিরুদ্ধে রক্ষণের মধ্যে নেমে আসছিলেন রায়ান গ্রাভেনবার্চ। দু’প্রান্তে সরে যাচ্ছিলেন ইব্রাহিমা কোনাতে এবং ওয়াতারু এন্দো। দুই ফুলব্যাক মিলোস কেরকেজ় এবং জেরেমি ফ্রিমপং উঠে যাচ্ছিলেন আক্রমণে। ইপিএলে সবচেয়ে আগে এই ছকে দলকে খেলিয়েছেন পেপ গুয়ার্দিওলা। তিনি কাজে লাগাতেন ফার্নান্দিনহোকে। এখন তাঁর হাতে বিকল্প রয়েছে। উলভারহ্যাম্পটন ওয়ান্ডারার্সের বিরুদ্ধে দু’বার ম্যাঞ্চেস্টার সিটির খেলায় এই ছকের প্রয়োগ দেখা গিয়েছে। প্রথম বার নিকো গঞ্জালেজ় রক্ষণের মাঝে নেমে আসায় দুই সেন্টার-ব্যাক জন স্টোন্স এবং রুবেন দিয়াস দু’প্রান্তে সরে যান। পরে নিকোর জায়গায় নেমে আসতে থাকেন টিয়ানি রেইন্ডার্স।
বল দখলের লড়াই লিভারপুলের রায়ান গ্রাভেনবার্চের (লাল জার্সি)। ছবি: রয়টার্স।
ভারতে এই ফর্মেশনে খেলা সম্ভব?
এখনই এমন সম্ভাবনা নেই। কারণটা খুব সহজ— এই ফর্মেশনে খেলার উপযোগী ফুটবলার ভারতে নেই। কলকাতার দুই প্রধানের উদাহরণ দেওয়া যাক। মোহনবাগানের দীপক টাংরি এবং ইস্টবেঙ্গলের শৌভিক চক্রবর্তীকে দিয়ে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের কাজটা হয়তো হয়ে যাবে। কিন্তু লাভলপিয়ানায় এই দু’জনকে সাহায্য করার মতো বাকি ফুটবলার দেশে নেই। তা ছাড়া এই ছকের মূল লক্ষ্য আক্রমণাত্মক ফুটবল। আইএসএলের কোচেরা কি শুরু থেকে এতটা আক্রমণাত্মক হওয়ার ঝুঁকি নেবেন? কলকাতা ডার্বিতে ইস্টবেঙ্গলের অস্কার ব্রুজ়ো বা মোহনবাগানের হোসে মোলিনা কি বিপক্ষকে না মেপে প্রথম থেকেই অ্যাটাকিং ফুটবলে যাবেন? অমল দত্ত ডায়মন্ড ছক তৈরি করে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু লাভলপিয়ানার মতো নতুন কোনও ফর্মেশন এখনই ভারতীয় ফুটবলে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা কার্যত নেই।
কেন এই ছক এত বেশি ব্যবহৃত?
মাঠে আরও বেশি জায়গা তৈরি করা, নিজেদের মধ্যে দ্রুত বলের আদানপ্রদান এবং বিপক্ষের দুই স্ট্রাইকারকে আরও পরিশ্রম করানোই মূল লক্ষ্য। দুই সেন্টার-ব্যাক দু’প্রান্তে সরে গিয়ে কিছুটা হলেও সামনে জায়গা পাচ্ছেন। এতে দুই ফুলব্যাক এবং মিডফিল্ডারদের সঙ্গে বলের আদানপ্রদান আরও নিখুঁত হচ্ছে। সেন্টার-ব্যাকদের সঙ্গে ফুলব্যাকদের একাধিক ত্রিভুজ তৈরি হওয়ায় পাসিং আরও সহজ হচ্ছে।
অতীত নিদর্শন
গুয়ার্দিওলার হাত ধরে লাভলপিয়ানা জনপ্রিয় হলেও তিনি এর কৃতিত্ব নিতে রাজি নন। বরং কৃতিত্ব দিচ্ছেন এমন একজনকে, যাঁর কাছ থেকে এই স্প্যানিশ কোচ শিখেছেন, ঠিক কী ভাবে ফুটবলটা খেলতে হয়। তিনি জোহান ক্রুয়েফ। নেদারল্যান্ডসের ‘টোটাল ফুটবল’-এর জনক এবং বিশ্বজুড়ে সমাদৃত কোচ। ২০২১-এ ম্যাঞ্চেস্টার সিটির ওয়েবসাইটে এক সাক্ষাৎকারে গুয়ার্দিওলা বলেছিলেন, “ক্রুয়েফ এমন একজন মানুষ, যিনি আমাকে সবচেয়ে বেশি শিখিয়েছেন এবং যিনি সবচেয়ে বেশি খাটিয়েছেন।” গুয়ার্দিওলা বরাবর পছন্দ করেন ‘পজেশনাল ফুটবল’। অর্থাৎ বল নিয়ন্ত্রণে রেখে খেলা। সেই দর্শনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছে লাভলপিয়ানা মডেল। ক্রুয়েফ ছাড়া আরও দুই কোচ গুয়ার্দিওলার জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছেন। তাঁদের একজন জুয়ান ম্যানুয়েল লিলো। ফুটবল জীবনের শেষ ছ’মাস মেক্সিকোর অখ্যাত ক্লাব দোরাদোস দে সিনালোয়াতে খেলেছিলেন গুয়ার্দিওলা। সেই ক্লাবে সই করার আগেই গুয়ার্দিওলা ঘোষণা করেছিলেন, লিলোর কাছ থেকে কিছু শিখতে চান বলেই মেক্সিকো পাড়ি দিচ্ছেন। সিটির কোচ হওয়ার পর দু’বার সহকারী হিসাবে লিলোকে নিজের পাশে রেখেছিলেন গুয়ার্দিওলা।
লাভলপিয়ানা নাম কেন
এই বিশেষ ছক ফুটবল বিশ্বের সামনে যিনি প্রথম এনেছিলেন এবং মেক্সিকোয় খেলার সময় যাঁর কোচিং দেখে গুয়ার্দিওলা মুগ্ধ হয়েছিলেন, তাঁর নাম রিকার্ডো লা ভলপি। তাঁর নাম থেকেই এই ফর্মেশনের নাম লাভলপিয়ানা। আর্জেন্টিনার গোলকিপার হিসাবে ১৯৭৮ সালে বিশ্বকাপ জিতেছিলেন লা ভলপি। এর পরে সে দেশের বোকা জুনিয়র্স, ভেলেজ় সার্সফিল্ড এবং মেক্সিকোর মন্টেরে-সহ বহু ক্লাবে কোচিং করিয়েছেন। কোচ হিসাবে তাঁর সেরা সাফল্য মেক্সিকোকে ২০০৬ বিশ্বকাপের প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে তোলা। নিজে গোলকিপার হলেও ফুটবলের দর্শন সম্পর্কে লা ভলপির জ্ঞান ছিল অসামান্য। তিনি মনে করতেন, যে কোনও দলের আক্রমণ শুরু হয় পিছন থেকে। ডিফেন্সিভ লাইনে বেশি ফুটবলার রেখে বলের আদানপ্রদান করা গেলে তা থেকে গোল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এই পদ্ধতি মেক্সিকোয় পরিচিত ‘সালিদাস’ নামে। বার বার এই ছকে দলকে অনুশীলন করাতেন লা ভলপি। কারণ, যত বেশি অনুশীলন, তত বেশি এই ছক সম্পর্কে ফুটবলারদের স্পষ্ট ধারণা তৈরি হওয়া এবং মাঠে সফল ভাবে প্রয়োগ করার সম্ভাবনা। ২০২১-এ ‘দ্য অ্যাথলেটিক’-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে লা ভলপি বলেছিলেন, “২০০৫-এ কনফেডারেশন্স কাপে মেক্সিকোকে প্রথম এই ছকে খেলাই। পরের বছর বিশ্বকাপেও তাই। আমার মনে হয়, ২০১০-এ গুয়ার্দিওলার হাত ধরে ফুটবলে ৪-৩-৩ ছক ফিরেছিল। তার পর থেকে ওই ছক জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছিল। এখন এই ছক ব্যবহৃত হয় দলের সেরাটা বার করে আনতে। পিছন থেকে আক্রমণ শুরু করলে মাঝমাঠে বল আদানপ্রদানের জন্য বেশি ফুটবলার দরকার। কাজটা সহজ নয়।”
রিকার্ডো লা ভলপি। ছবি: সমাজমাধ্যম।
লাভলপিয়ানার আধুনিক সংস্করণ
২০০৬-এ অবসর নেওয়ার পর স্পেনে ফিরে এসে কিছুদিন কলামলেখক হিসাবে কাজ করেছিলেন গুয়ার্দিওলা। নিজের কলামে লা ভলপির কোচিংয়ের প্রশংসা করেছিলেন। দেড় বছর পরে ‘বার্সেলোনা বি’ দলের কোচিংয়ের দায়িত্ব পেয়ে লা ভলপির দর্শনই প্রয়োগ করেছিলেন গুয়ার্দিওলা। তার ছ’মাস পরে বার্সেলোনার সিনিয়র দলের কোচ হন তিনি। তখন এই দর্শন সফল ভাবে কাজে লাগানোর জন্য আরও বেশি ফুটবলার হাতে পান গুয়ার্দিওলা। ২০১০-এর শুরুর দিক থেকে এই ছকে খেলেই বিপক্ষকে তছনছ করে দিত বার্সেলোনা। দুই সেন্টার-ব্যাক কার্লেস পুয়োল এবং জেরার্ড পিকের মাঝে নেমে আসতেন সের্জিয়ো বুস্কেৎস। সেখান থেকে শুরু হত আক্রমণ, যা বেশির ভাগ সময়ে শেষ হত বিপক্ষের জালে বল জড়িয়ে। লাভলপিয়ানা মডেল অনুসরণ করেই ‘তিকিতাকা’ ঘরানাও সফল ভাবে প্রয়োগ করেছিলেন গুয়ার্দিওলা।
রিয়াল মাদ্রিদের ম্যাচে ‘লাভলপিয়ানা মডেল’-এ নীচে নেমে এসে খেলছেন আর্দা গুলের (১৫ নম্বর জার্সি)। ছবি: সমাজমাধ্যম।
‘লাভলপিয়ানা মডেল’-এর আসল উদাহরণ নিঃসন্দেহে দুই সেন্টার-ব্যাকের মাঝে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের নেমে যাওয়া। তবে শুধু সেটাই নয়, মাঝমাঠে বিপক্ষের থেকে বেশি ফুটবলার রাখাও ছকের আর একটা দিক। রিয়াল মাদ্রিদের উদাহরণ দেওয়া যাক। টনি ক্রুজ় খেলার সময় বার বার দুই সেন্টার-ব্যাকের মাঝে নেমে এসে গোলকিপারের কাছ থেকে বল পেতেন। সেখান থেকে শুরু হত আক্রমণ। নতুন কোচ জ়াবি আলোন্সো সেই কাজের ভার দিয়েছেন ২০ বছরের তরুণ আর্দা গুলেরকে।
২০২৪ থেকে আর কোচিং করান না লা ভলপি। তবে ফুটবলের প্রতি আগ্রহ কমেনি তাঁর। নিজের ইউটিউব চ্যানেলে প্রায় প্রতি দিনই কোনও না কোনও খেলার বিশ্লেষণ করেন। আধুনিক ফুটবল কী ভাবে বদলে যাচ্ছে, তার বর্ণনা দেন। ফুটবলে কাউকে সম্মান জানাতে তাঁর নামে কোনও শট বা কৌশলের নামকরণ করা হয়। ক্রুয়েফের সঙ্গে ‘টোটাল ফুটবল’, আন্তোনিন পানেনকার সঙ্গে ‘পানেনকা কিক্’, রেনে হিগুইতার সঙ্গে ‘স্করপিয়ন কিক’ যেমন জুড়ে গিয়েছে। তবে ‘লাভলপিয়ান মডেল’ নামটি খুব একটা শোনা যায় না। যদিও আধুনিক ফুটবলে বেশির ভাগ দলই কোনও না কোনও ভাবে এই ছক ব্যবহার করে চলেছে। ফুটবলজীবনের শেষে ছ’মাসের জন্য যদি গুয়ার্দিওলা উত্তর আমেরিকায় ‘তীর্থযাত্রা’য় না যেতেন, তা হলে হয়তো এখনও অজানা থেকে যেত বিশ্ব ফুটবলের মোড় ঘোরানো এই কৌশল!