E-Paper

মায়ের জন্য একটা বাড়ি বানাতে চাই

শুভজিৎ মজুমদার

শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০২৫ ০৭:৪১
দুরন্ত: ভারতীয় ফুটবলের নতুন তারা সঙ্গীতা।

দুরন্ত: ভারতীয় ফুটবলের নতুন তারা সঙ্গীতা। ছবি: এআইএফএফ।

কল্যাণীর গান্ধী হাসপাতালের কোয়ার্টারের এক চিলতে ঘরে ছ’জনের বিরাট সংসার। অথচ রোজগার মাত্র এক জনের। হাসপাতালের সাফাইকর্মী ফুলঝুরি বাসফোরের একমাত্র চিন্তা ছিল চার সন্তান ও শয্যাশায়ী স্বামীর মুখে কী ভাবে খাবার তুলে দেবেন। তার উপরে ছিল অনবরত আত্মীয়স্বজনদের আসা-যাওয়া। দু’বেলা ঠিক মতো খাবারই জুটত না অধিকাংশ দিন।

উদয়-অস্ত হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পরে বিশ্রাম নেওয়ার কথা ভাবাই ছিল ফুলঝুরির কাছে বিলাসিতা। মায়ের এই ক্লান্তিহীন লড়াই তাঁকে মানসিক ভাবে শক্তিশালী করে তুলেছিল। এখনও মা-ই তাঁর প্রেরণা। তিনি, সঙ্গীতা বাসফোর। তাঁর জোড়া গোলেই তাইল্যান্ডকে হারিয়ে আগামী বছর অস্ট্রেলিয়ায় মেয়েদের এএফসি এশিয়ান কাপের মূল পর্বে যোগ্যতা অর্জন করে ইতিহাস গড়ল ভারতীয় দল। উৎসবের আবহেও সঙ্গীতার মনে পড়ে যাচ্ছে শৈশবের সেই কঠিন লড়াই। সোমবার দিল্লি থেকে ফোনে আনন্দবাজারকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে সঙ্গীতা বলছিলেন, ‘‘শৈশবের সেই কঠিন দিনগুলি আমি কখনওই ভুলতে পারব না। অবশ্য ভুলতে চাইও না। কারণ, ওই দিনগুলিই আমাকে অনুপ্রাণিত করে আরও পরিশ্রম করতে, সফল হতে।’’ আরও বললেন, ‘‘অসুস্থতার কারণে বাবা কাজ করতে পারতেন না। মা একার রোজগারেই আমাদের চার বোনকে বড় করেছেন। আমাকে উজ্জীবিত করেছেন ফুটবল খেলতে। তার পরে দিদিদের বিয়ে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়। আমার মাসিরাও মায়ের উপরেই নির্ভরশীল। মাকে এত পরিশ্রম করতে দেখেই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আমাকে ভাল খেলে যে কোনও মূল্যে একটা চাকরি জোগাড় করতেই হবে। মায়ের পাশে দাঁড়াতেই হবে। মা-ই আমার আসল প্রেরণা।’’ যোগ করলেন, ‘‘এমনিতেই আমাদের অভাবের সংসার। তার উপরে আত্মীয়স্বজনদের আসা-যাওয়া লেগেই থাকত। ফলে অধিকাংশ দিনই দু’বেলা ঠিক মতো খাবার জুটত না। মাকে বারবার জিজ্ঞেস করতাম, তুমি কী ভাবে একা নিঃশব্দে সব কিছু সামলাচ্ছ? মা হেসে বলতেন, অতিথি ভগবান। এক দিন দেখবি সব ঠিকহয়ে যাবে।’’

এক দিন সব ঠিক হয়ে যাবে এই আশা নিয়েই ফুলঝুরি দেবী কোনও দিন সঙ্গীতাকে ফুটবল খেলতে বাধা দেননি। চেষ্টা করছেন, যতটা সম্ভব পাশে থাকার। এখন ভারতের হয়ে ফুটবল খেলতে নিয়মিত বিদেশে যান সঙ্গীতা। পাচতাঁরা হোটেলে থাকেন। বিদেশি বুট পরে মাঠে দৌড়লেও সঙ্গীতা ভুলতে চান না শৈশবকে। বলছিলেন, ‘‘কাজের জন্য মায়ের পক্ষে অধিকাংশ সময়ই হাসপাতালে থাকতে হত। ম্যাচ খেলে যখন কল্যাণীতে ফিরতাম রাত ১১-১২টা নাগাদ, দেখতাম স্টেশনে মা ও মাসি বসে রয়েছেন আমাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য। মা আমাকে সব সময় বলতেন, তুই মন দিয়ে খেলে যা। বাকি সব আমি সামলে নেব। মায়ের জন্যই আমি আজ এই জায়গায় পৌঁছতে পেরেছি। মায়ের জন্য এ বার একটা ভাল বাড়ি বানাতে চাই। আমার মা সারাজীবন কষ্ট করেছেন। এ বার একটু বিশ্রাম নিক। মাকে বলেছিলাম, এখন আমি রোজগার করছি। তুমি চাকরি ছেড়ে দাও। কিন্তু মা রাজি নয়। বলে, এই চাকরি করেই তোদের বড় করেছি। এখন আমি আর বেশি জোর করি না। কারণ, আমি সীমা সুরক্ষা বল (এসএসবি)-তে কর্মরত। থাকতে হয় শিলিগুড়িতে। চাকরি ছেড়ে দিলে মাকে তো সারাদিন একা থাকতে হবে বাড়িতে। বাবা বছর তিনেক আগে চলে গিয়েছেন। দিদিদেরও বিয়ে হয়ে গিয়েছে। একা থাকলে মা-র আরও মন খারাপ হবে।’’

সঙ্গীতার ফুটবল শুরু দশ বছর বয়সে মামা বিজয় বাসফোরকে দেখে। কল্যাণী থেকে সপ্তাহে তিন দিন সল্টলেকে অনুশীলন করতে যেতেন তিনি। ২০১৯ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ ভারতীয় দলে সুযোগ পান। সিনিয়র দলে সঙ্গীতার অভিষেক হয়২০১৫ সালে।

সঙ্গীতার আদর্শ ভারতের বেমবেম দেবী এবং ব্রাজিলের মার্তা দা সিলভা। চার বছর আগে ব্রাজিল সফরের জন্য ভারতীয় দলে সুযোগ পেয়ে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ছিটকে যান হাঁটুতে চোট পাওয়ায়। অস্ত্রোপচারও করাতে হয়েছিল। সঙ্গীতা বলে চললেন, ‘‘হাঁটুর চোটের কারণে ব্রাজিল সফরের আগে ভারতীয় দল থেকে ছিটকে যাওয়ার খুবই মন খারাপ হয়েছিল। তাই অস্ত্রোপচারের পরে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম। কিন্তু এসে দেখলাম, বাবার শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ। আমাকে চিনতেও পারেনি। এত কষ্ট হয়েছিল যে পরের দিনই বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম। তিন-চার দিনের মধ্যেই বাবা মারা যান। বাড়িতে থেকেও বাবার জন্য কিছু করতে না পারার যন্ত্রণা এখনও আমাকে ক্ষতবিক্ষত করে।’’

এএফসি এশিয়ান কাপের মূল পর্বে ভারত খেলবে। ইস্টবেঙ্গল খেলবে এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগে। আপনার কাছে কোনও প্রতিযোগিতার গুরুত্ব বেশি? এক মুহূর্ত ভেবে সঙ্গীতা বললেন, ‘‘ধাপে ধাপে এগোতে চাই। এএফসি এশিয়ান কাপের মূল পর্বে যোগ্যতা অর্জনের যে লক্ষ্য ছিল তা পূরণ হয়েছে। এ বার ইস্টবেঙ্গলের হয়ে এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগে সফল হতে চাই।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

AFC Champions League Indian Football Team East Bengal AFC Asian Cup

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy