Advertisement
১৭ মে ২০২৪
FIFA Womens World Cup

কোচের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, ১২ সেরা ফুটবলার ছাড়াই মেয়েদের বিশ্বকাপ স্পেনের হাতে

গত এক বছর ধরে কোচের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে সরগরম স্পেনের মহিলা ফুটবলাররা। দেশের অনেক সেরা ফুটবলার বিশ্বকাপে খেলেননি। তা সত্ত্বেও ট্রফি উঠল স্পেনের হাতে।

football

বিশ্বকাপ নিয়ে স্পেনের ফুটবলারদের উচ্ছ্বাস। ছবি: রয়টার্স।

আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০২৩ ১৮:১৪
Share: Save:

ইংল্যান্ডকে হারিয়ে মেয়েদের বিশ্বকাপ জিতল স্পেন। ওলগা কারমোনার একমাত্র গোলে ফাইনালে জিতে প্রথম বার ট্রফি পেল তারা। কিন্তু স্পেনের এই বিশ্বকাপ জয়ের নেপথ্যে জড়িয়ে রয়েছে অনেক বিদ্রোহ, প্রতিবাদ, দুঃখ, কষ্ট। যে দলের কোচের বিরুদ্ধে এক সময় বিদ্রোহ করেছিলেন প্রায় সমস্ত ফুটবলার, যে কোচের সঙ্গে এখনও ফুটবলারদের সম্পর্ক ভাল নয়, যে কোচের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বিশ্বকাপেই খেলেননি প্রায় ১২ জন ফুটবলার, তাঁরাই সব প্রতিকূলতা জয় করে বিশ্বকাপ হাতে তুলে নিলেন। কোনও অংশেই কম নয় ‘লা রোজা’র (স্পেনের দলকে এই নামেই ডাকা হয়) এই কৃতিত্ব। স্পেনের পুরুষ দলের সোনালি প্রজন্ম ২০১০ সালে বিশ্বকাপ জিতেছিল। তার ১৩ বছর পর মেয়েদের দলের সোনালি প্রজন্মও ট্রফি ঘরে তুলল।

স্পেনের এই বিশ্বকাপ যাত্রায় যিনি সবচেয়ে আলোচিত, তিনি কোনও ফুটবলার নন। কোচ জর্জ ভিলদা। এই ভিলদাকে নিয়ে কিছু দিন আগে পর্যন্ত স্পেনের ফুটবলারদের মধ্যে প্রবল বিদ্রোহ ছিল। স্পেনের কোচকে দলের বেশির ভাগই পছন্দ করেন না। তাঁদের দাবি, অতিরিক্ত পরিশ্রম এবং মানসিক চাপ তৈরি করেন ভিলদা। সে কারণে ফুটবলারেরা মাঠে নেমে নিজেদের সেরা দিতে পারেন না। স্পেনের ফুটবল সংস্থা অবশ্য কোনও দিন তাঁদের দাবিকে পাত্তা দেয়নি। তাঁরা বরাবর ভিলদার পাশে দাঁড়িয়েছে। ফুটবলারেরা প্রতিবাদ করেও দেশের কথা ভেবে একত্রিত হয়েছেন। যার ফল বিশ্বকাপ জয়।

কোচের সঙ্গে ফুটবলারদের সম্পর্ক কতটা খারাপ? বোঝা গিয়েছিল নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচে। সেই ম্যাচেও শেষ মুহূর্তে ওলগার গোলে জেতে স্পেন। কিন্তু ম্যাচের পর কোচের সঙ্গে ফুটবলারদের একসঙ্গে হতে দেখা যায়নি। সাধারণত ম্যাচের পর কোচের সঙ্গেই ফুটবলারেরা উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠেন। স্পেনের ক্ষেত্রে হয়েছে ঠিক উল্টোটা। ফাইনালের পরেও তাঁর বদল নেই। স্পেনের ফুটবলারেরা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে যখন নাচানাচি করছিলেন, তখন সেখানে কোচ থাকলেও তাঁকে বাকিদের থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন মনে হচ্ছিল।

স্পেনের কোচ জর্জ ভিলদা।

স্পেনের কোচ জর্জ ভিলদা। ছবি: রয়টার্স

গত ১২ মাসে স্পেনের মহিলাদের ফুটবল টালমাটাল অবস্থার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। রবিবারের ফাইনাল শুধু নয়, গোটা প্রতিযোগিতাতেই খেলেননি স্পেনের একাধিক সেরা ফুটবলার। নেই মাপি লিয়ন, যিনি ইউরোপের অন্যতম সেরা সেন্টারব্যাক। বার্সেলোনায় তাঁর সতীর্থ ক্লদিয়ো পিনাও বিশ্বকাপে খেলেননি। তাঁরা থাকলে বিশ্বকাপে নামার আগেই স্পেন ট্রফির দাবিদার হয়ে যেত। উল্টে এই অবস্থার মধ্যে তারা যে ট্রফি জিতবে, এটা অনেকেই ভাবতে পারেননি।

জাতীয় দলের হয়ে প্রায় শততম ম্যাচ খেলতে চলা ইরেন পারেদেস বিদ্রোহটা শুরু করেছিলেন। এই ইংল্যান্ডের হাতেই গত ইউরো কাপে হারের পর মহিলাদের দলের প্রতি সঠিক ব্যবহারের দাবি তুলেছিলেন তিনি। মেয়েদের ফুটবলের খোলনলচে বদলে দেওয়ার দাবি তুলেছিলেন। গুজব রটেছিল যে কোচের সঙ্গে ফুটবলারদের সম্পর্ক এতটাই খারাপ যে তা আর সারানো যাবে না। ভিলদাকে কোচ রেখে দেওয়া হয়। কিন্তু সেপ্টেম্বরে ১৫ জন ফুটবলার একসঙ্গে ফুটবল সংস্থাকে ইমেল করেন।

সেই ১৫ জন ছিলেন আইতানা বোনমাতি, মারিয়োনা কালদেনতে, ওনা বাতলে, পাত্রি গুইজারো, মাপি লিয়ন, সান্দ্রা পানোস, ক্লদিয়া পিনা, লোলা গালার্দো, আইনহোয়া মোরাজা, নিরিয়া এইজাগিরে, আমিউপ সারিয়েগি, লুসিয়া গার্সিয়া, লিলা ওউহাবি, লাইয়া আলেকজান্দ্রি এবং আন্দ্রিয়া পেরেরা। তাঁদের অভিযোগ ছিল, মহিলা দলে খেলার ফলে তাঁদের মানসিক অবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং শারীরিক অবনতি হয়েছে। ভিলদাকে সরাসরি সরিয়ে দেওয়ার দাবি করেননি কেউই। কিন্তু বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, কোচকে নিয়ে খুশি নন। অনুশীলনের পদ্ধতি, ফুটবলারদের প্রতি আচরণ, পরিকাঠামোর অভাব— ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে অভিযোগ ছিল। পাশাপাশি স্পেনের ফুটবল সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে তাঁরা জানিয়েছিলেন, ঘরোয়া লিগের ম্যাচ খেলতে এক শহর থেকে অন্য শহরে বিমানে নিয়ে যাওয়ার বদলে ট্রেনে নিয়ে যাওয়া হত। লম্বা যাত্রায় আগেই ক্লান্ত হয়ে পড়তেন তাঁরা।

ইরেন পারেদেসই (বাঁ দিকে) প্রথম ভিলদার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিলেন।

ইরেন পারেদেসই (বাঁ দিকে) প্রথম ভিলদার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিলেন। ছবি: রয়টার্স

যাঁরা ইমেল করেননি, তাঁরাও এই আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন। তার মধ্যে ছিলেন দু’বারের বালঁ দ্যর জয়ী আলেক্সিয়া পুতেয়াস, জেনিফার হারমোসো এবং অধিনায়ক পারেদেস। তিন জনেই ইউরোপের অন্যতম সেরা ফুটবলার। তাতেও টলানো যায়নি স্পেনের ফুটবল সংস্থাকে। সংস্থার প্রধান আনা আলভারেস বলেছিলেন, প্রতিবাদী ফুটবলারদের ক্ষমা চেয়ে দলে ফিরতে হবে। তবে বাইরে যাই হোক, মাঠে স্পেনের পারফরম্যান্সে তার প্রভাব পড়েনি। এতে স্পেনের ফুটবলারদের মধ্যেও একতা বাড়ে। আস্তে আস্তে আন্দোলন স্তিমিত হয়। অনেকেই দলে ফিরে আসেন। ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় দলে যোগ দেন হারমোসো।

মার্চে ফুটবলারদের সঙ্গে সংস্থার বৈঠকের পর পরিস্থিতি আরও ভাল হয়। দলে যোগ দেন পারেদেস। বিশ্বকাপের আগে পরিস্থিতি ক্রমশ ঠিক হচ্ছিল। ইমেল পাঠানো ১৫ জনের মধ্যে আট জন দলে যোগ দেন। সেখানে বাতলে, কালদেনতে এবং বোনমাতির মতো তিন গুরুত্বপূর্ণ ফুটবলারও ছিলেন। আগেই যোগ দিয়েছিলেন পুতেয়াস, হারমোসো এবং পারেদেস। কিন্তু লিয়নের মতো কিছু ফুটবলারের মতো তাতেও গলেনি। কোচের সঙ্গে সমস্যাও পুরোপুরি মেটেনি। ফলে বিশ্বকাপের আগে স্পেনকে নিয়ে সন্দিহান ছিলেন অনেকেই।

কিন্তু যাঁকে নিয়ে বিতর্ক, সেই ভিলদা ছিলেন আত্মবিশ্বাসী। ফাইনালে ওঠার আগে তিনি বলেছিলেন, “অনেকে অনেক কথাই বলেছে যা সত্যি নয়। যখন মানুষের মতামত নিয়ে অসত্য, অন্যায্য এবং মিথ্যা জল্পনা তৈরি হয়, তখন খুবই ব্যথা লাগে।”

ছেলেদের বিশ্বকাপ জেতার সময় স্পেনের যে রকম সোনালি প্রজন্ম ছিল, মেয়েদের বিশ্বকাপও জিতল সেই সোনালি প্রজন্মই। কিন্তু কোচের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কারণে সেই প্রজন্মই ভেঙে গুঁড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। বিশ্বকাপ জেতায় কি আবার আগের মতো সব মিটে যাবে?

ইতিহাস ভোলা যায় না। তাই বিশ্বকাপ স্পেনের ফুটবলারদের হাতে উঠলেও আগামী দিনে কি হবে, সেই ভবিষ্যদ্বাণী করতে নারাজ প্রত্যেকেই। কিন্তু ১২ জন সেরা ফুটবলার ছাড়াও স্পেনের জয় নিঃসন্দেহে মেয়েদের ফুটবলের এক অবিস্মরণীয় কৃতিত্ব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

FIFA Womens World Cup Spain Football
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE