বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ২২ বছর পরে ভারতের হার শুধু লজ্জা নয়, আরও বড় বিপর্যয়ের অশনি সংকেত। মাত্র এক লক্ষ ৫৬ হাজার জনসংখ্যার কুরাসায়ো ২০২৬ বিশ্বকাপের মূল পর্বে খেলবে। অথচ ১৪৬ কোটির দেশ ভারত এএফসি এশিয়ান কাপের মূল পর্বেই যোগ্যতা অর্জন করতে পারে না। বিশ্বকাপে খেলা তো কল্পনারও অতীত। হবে না-ই বা কেন? আইএসএলের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে। আই লিগ কবে শুরু হবে কেউ জানে না। সুপার কাপের গ্রুপ পর্বের খেলা শেষ হয়েছিল ৬ নভেম্বর। সেমিফাইনাল হবে ৪ ডিসেম্বর। ফাইনাল ৭ ডিসেম্বর! ভারতে ফুটবল পরিণত হয়েছে প্রহসনে।
ফিফা ক্রমতালিকায় ভারত ১৩৬। বাংলাদেশ রয়েছে ১৮৩ নম্বরে। ৪৭ ধাপ পিছিয়ে থাকা দেশের বিরুদ্ধে মঙ্গলবার রাতে খালিদ জামিলের দল যে ফুটবল খেলল, তার জন্য দু’সপ্তাহ ধরে অনুশীলন করার কোনও প্রয়োজন ছিল না। স্বাধীনতা দিবসের দিন পাড়ার পাড়ায় ‘ওয়ান ডে’ ফুটবলে যেমন ম্যাচের দিন ফুটবলার জোগাড় করে দল গড়া হয়, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নিখিল প্রভু, বিক্রম প্রতাপ সিংহদের খেলা দেখে সে রকম মনে হয়েছে সকলের। কেউ যেন কাউকে চেনেন না। প্রথম বার একসঙ্গে ম্যাচ খেলতে নেমেছেন। মাঝমাঠ থেকে বল নিয়ে উঠতে থাকা বাংলাদেশের রকিব হোসেনকে আটকাতেই পারলেন না আকাশ মিশ্র। এর পরে তিনি পেনাল্টি বক্সের মধ্যে পাস দেন মোরসালিনকে। ম্যাকার্টন লুইস নিকসন আশ্চর্যজনক ভাবে বাংলাদেশের স্ট্রাইকারকে আটকানোর চেষ্টাই করলেন না। কার্যত বিনাবাধায় মোরসালিন গোল করেন।
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের লজ্জার হারের পর থেকেই রীতিমতো ফুঁসছেন ভাইচুং ভুটিয়া। ভারতীয় ফুটবলের সর্বকালের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার বলছিলেন, ‘‘ভারতে এখন ফুটবলের নামে সার্কাস হচ্ছে। আইএসএলকে ঘিরে অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ায় ফুটবলারেরা যে প্রচণ্ড মানসিক উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে, খেলা দেখেই বুঝেছি। ওরা ভাল খেলার তাগিদটাই হারিয়ে ফেলেছে।’’ ভাইচুংয়ের ধারণাই ঠিক। জাতীয় দলের ফুটবলারেরা বলছিলেন, ‘‘আইএসএল নিয়ে এই অনিশ্চয়তায় আমরা প্রচণ্ড দুশ্চিন্তার মধ্যে প্রতিটি মুহূর্ত কাটাচ্ছি।জানি না কী হবে।’’
ভাইচুংয়ের মতে ভারতীয় দলের ব্যর্থতার আরও একটা কারণ, ঘনঘন দল পরিবর্তন। সিঙ্গাপুরের বিরুদ্ধে আগের ম্যাচে মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের শুভাশিস বসু, আপুইয়া, লিস্টন কোলাসো, সাহাল আব্দুল সামাদরা ছিলেন। এঁদের মধ্যে প্রথম একাদশে ছিলেন শুভাশিস, লিস্টন ও আপুইয়া। বাংলাদেশ ম্যাচের জন্য মোহনবাগানের কোনও ফুটবলারকেই ডাকেননি খালিদ। সিঙ্গাপুরের বিরুদ্ধে শুরু থেকে খেলেছিলেন মহেশ সিংহ। মঙ্গলবারের ম্যাচে খালিদ তাঁকে বসিয়ে রেখেছিলেন রিজ়ার্ভ বেঞ্চে। ভাইচুংয়ের কথায়, ‘‘ভারতীয় দলে ফুটবলার নির্বাচন ঠিক মতো হচ্ছে না। প্রতিটি ম্যাচেই দেখা যাচ্ছে প্রথম একাদশে একাধিক পরিবর্তন। খালিদের জমানায় ভারত তো কখনওই একটা দল হয়ে উঠতে পারেনি। কয়েক জন ফুটবলার থাকে যারা দলের প্রধান চালিকা শক্তি। তার পরে পরিস্থিতি এবং প্রতিপক্ষ অনুযায়ী কিছু ফুটবলার পরিবর্তন করেন কোচেরা। খালিদ চলে নিজের মর্জি অনুযায়ী।’’
কী রকম? ভাইচুংয়ের ব্যাখ্যা, ‘‘খালিদ নিজের ইচ্ছে মতো দল গড়ছে। ওর পছন্দের ফুটবলারদেরই শুধু নিচ্ছে। একাধিক ভাল ফুটবলারকে কোনও কারণ ছাড়াই ছেড়ে দিয়েছে। ফলে এ রকমই তো হবে।’’ এর পরেই ভাইচুং কাঠগড়ায় তুললেন সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনকে। বললেন, ‘‘তিন বছরে তিন বার কোচ বদল হয়েছে জাতীয় দলে। তিন জন সাধারণ সচিবও পরিবর্তন হয়েছে ফেডারেশনে। কোনও পরিকল্পনা নেই। আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর নেওয়া সুনীলকে জোর করে ভারতীয় দলে ফিরিয়ে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে চেয়েছিল কল্যাণ চৌবেরা। ভারতীয় ফুটবল যে ভাবে চলছে, এর চেয়ে ভাল তো কিছু হওয়ার ছিল না।’’
ভারতীয় ফুটবল কী ভাবে চলছে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ নাগরিকত্ব পাওয়া সত্ত্বেও রায়ান উইলিয়ামসের খেলতে না পারা। কারণ, অস্ট্রেলিয়া ফুটবল সংস্থা ছাড়পত্র দিলেও ফিফা এবং এএফসি দেয়নি। ফেডারেশন কর্তারা কি আদৌ আগ্রহী ছিলেন রায়ানের ছাড়পত্রের ব্যবস্থা করতে?
এএফসি এশিয়ান কাপের যোগ্যতা অর্জ পর্বে পাঁচটি ম্যাচ ভারতের হার তিনটি, ড্র দুই। যাত্রা শুরু হয়েছিল মানোলো মার্কেসের কোচিংয়ে। তার পরে দায়িত্ব নেন খালিদ। কী অসাধারণ ফল! ভারতীয় দলের আর এক প্রাক্তন অধিনায়ক প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘আইজ়ল এফসি বা জামশেদপুর এফসি-তে অর্জিত সাফল্য কখনও জাতীয় দলের কোচ হওয়ার মানদণ্ড নয়। খালিদের তো একটাই রণকৌশল— রক্ষণাত্মক ফুটবল।’’ যোগ করলেন, ‘‘ইরান, ওমানের মতো শক্তিশালী দলের বিরুদ্ধে রক্ষণাত্মক খেলার তবুও একটা যুক্তি আছে। কিন্তু বাংলাদেশ, আফগানিস্তানের মতো ফিফা ক্রমতালিকায় পিছিয়ে থাকা দলগুলির বিরুদ্ধে কেন জেতার জন্য ঝাঁপাব না? খালিদ কোচ থাকলে আরও ডুববে ভারত।’’ ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের খেলা দেখে লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছিল।’’
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রথম পর্বের দ্বৈরথে ঘরের মাঠে কোনও মতে হার বাঁচিয়েছিল ভারতীয় দল। তখন কোচ ছিলেন মানোলো। কিন্তু শিলংয়ের সেই ম্যাচেই হামজ়া চৌধুরীরা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, ফিফা ক্রমতালিকায় পিছিয়ে থাকলেও ভারতকে হারানোর ক্ষমতা রয়েছে তাঁদের। এই বাংলাদেশ বদলে যাওয়া বাংলাদেশ। মঙ্গলবার রাতে ঢাকার জাতীয় স্টেডিয়ামে ভারতকে হারিয়ে তা প্রমাণকরলেন হামজ়ারা।
২২ বছর পরে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে হেরে ভারতের ফুটবলপ্রেমীরা লজ্জায় মুখ ঢাকলেও খালিদ নির্বিকার। সাংবাদিক বৈঠকে ভারতীয় দলের কোচ বলেন, ‘‘২২ বছর পরে হার এমন কিছু বড় ব্যাপার নয়।’’
হায়, ভারতীয় ফুটবল!
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)