Advertisement
E-Paper

হারিয়ে দেখাও তো রোনাল্ডো, চ্যালেঞ্জ ফ্রান্সের

বড় মজায় কেটেছিল সেই রাতটা। শঁজেলিজে দিয়ে মানুষের স্রোত নেমেছিল। বাবাদের হাত ধরে দুই বন্ধু মিশে গিয়েছিলেন ফুটবল-পাগল ফরাসি গণজোয়ারে। দেশের মাটিতে জিনেদিন জিদানদের বিশ্বজয়ের রাত ছিল সেটা।

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০১৬ ০৪:১১
জোড়া গোলের নায়ক। ইউরো সেমিফাইনালে জার্মানিকে   হারিয়ে ফ্রান্সের ফরোয়ার্ড গ্রিজম্যানের নাচ। ছবি: এএফপি।

জোড়া গোলের নায়ক। ইউরো সেমিফাইনালে জার্মানিকে হারিয়ে ফ্রান্সের ফরোয়ার্ড গ্রিজম্যানের নাচ। ছবি: এএফপি।

বড় মজায় কেটেছিল সেই রাতটা। শঁজেলিজে দিয়ে মানুষের স্রোত নেমেছিল। বাবাদের হাত ধরে দুই বন্ধু মিশে গিয়েছিলেন ফুটবল-পাগল ফরাসি গণজোয়ারে। দেশের মাটিতে জিনেদিন জিদানদের বিশ্বজয়ের রাত ছিল সেটা।

আঠারো বছর আগেকার সেই রাতের সব কথা হুগো আর ভ্যালেন্তাইনের হুবহু মনে আছে বললে বাড়াবাড়ি হবে। দু’জনেই এখন আঠাশ-উনত্রিশ। বর্তমান ফরাসি কোচ দিদিয়ের দেশঁ যে দিন বিশ্বকাপ তুলেছিলেন দেশের অধিনায়ক হিসেবে, ওঁরা দু’জনেই তখন হাফপ্যান্ট। প্রাণপণ মন হাতড়েও তাই টুকরো টুকরো মজার কয়েকটা ছবি ছাড়া কিছু উঠে না আসে মুঠোয়।

সেই জন্যই ওঁরা কোনও তুলনায় যেতে চান না। শুক্রবার রাতে জোয়াকিম লো অ্যান্ড কোম্পানিকে দু’গোলে দুমড়ে ইউরো কাপের ঢিলছোড়া দূরত্বে এসে দাঁড়ানোর আবেগের সঙ্গে গত শতাব্দীর সেই স্বপ্নরাতের তুলনা হয় কি না— এ সব চর্চায় দুই বন্ধুর আগ্রহ নেই। ওঁরা সোজাসুজি ঢুকতে চান আঁতোয়া গ্রিজম্যানে!

আদরের ‘গ্রিজ’-কে নিয়ে দুই বন্ধু দারুণ একটা গান বেঁধেছেন। শুক্রবার রাতে আটলেটিকো মাদ্রিদ স্ট্রাইকারের দ্বিতীয় গোলের পর যা তাঁদের গাইতে শোনা যাচ্ছিল। প্রথমে বোঝা যায়নি। পুরোটাই ফরাসিতে। কিন্তু মাঝে-মাঝে ‘আঁতোনি’ শব্দটা কানে আসায় জিজ্ঞেস করা গেল। এবং সোত্সাহে ইংরেজিতে যে অনুবাদ তাঁরা করে দিলেন, তা এ রকম— আঁতোনি, আমাদের আঁতোনি/ তুমি আমাদের ফাইনালে তুললে/ আঁতোনি, আমাদের আঁতোনি/ তুমি আমাদের কাপও জেতাবে!

ফুটবলে গান নতুন কোনও বস্তু নয়। প্রত্যেকটা টিম নিয়ে গান থাকে, প্রিয় প্লেয়ার নিয়েও থাকে। ওয়েলস সমর্থকদের যেমন গ্যারেথ বেল, অ্যালান র‌্যামসিদের নিয়ে আছে। কথা একই রেখে নামগুলো পাল্টে-পাল্টে ওয়েলসবাসীরা গেয়ে থাকেন। দেশঁ-র টিমেও এই প্রথম কাউকে নিয়ে গান বাঁধা হল না। দিমিত্রি পায়েতকে নিয়ে বহু দিন আগে থেকে আছে। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে ওয়েস্টহ্যাম ম্যাচে যা শোনা যায়। ইউরোয় ছ’গোল করে গ্রিজম্যান এখন জাতীয় বীর, ফ্রান্সের জনপ্রিয়তম চরিত্র, জায়ান্ট স্ক্রিনে তাঁর দেবশিশুর মতো মুখ দেখামাত্র ফরাসি তরুণীদের উসখুস— গান তো এখন গ্রিজম্যান নিয়েই হবে!

বিস্ফোরণটা হল যুবকদের পরের সংলাপে। বিয়ারের নেশায় মত্ত হুগো এবং ভ্যালেন্তাইন ক্রমাগত তখন প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছেন, গ্রিজ যদি তিন নম্বর গোলটা দিতে পারেন, তাঁরা দু’জনেই সোজা পোশাক খুলে দেখাবেন উত্সব কাকে বলে!

ঈশ্বরের কৃপায় সে জিনিস দেখতে হয়নি। গ্রিজম্যান দু’গোলেই আটকে রইলেন। দুই বন্ধু তখন মধ্যরাতের আইফেল টাওয়ার ফ্যান জোনে গাইতে শুরু করলেন, ‘ওনে ফিনাল... ওনে ফিনাল!’ ‘ওনে ফিনাল’ মানে, ‘আমরা ফাইনালে’। কিন্তু এঁদের চলন-বলন, নাটকীয়তার বহর দেখলে কথাটাকে একটু পাল্টে দিতে ইচ্ছে করবে। ‘আমরা ফাইনালে’ নয়, এ যেন ‘আমরা ফাইনালটাও জিতে গিয়েছি!’

ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোকে এঁরা কেউ ধর্তব্যের মধ্যেই আনছেন না! গ্রিজম্যান-মায়ায় ফ্রান্স এখন এতটাই আচ্ছন্ন যে, ওয়েলসের বিরুদ্ধে সেমিফাইনালে পর্তুগিজ নায়কের দুর্ধর্ষ প্রত্যাবর্তন মৃদু কম্পনও তুলতে পারছে না। বেশ কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলে তাঁর প্রতি ‘সম্মান’-এর যা নমুনা পাওয়া গেল, তাকে দু’টো শব্দে মিটিয়ে ফেলা যায়— ‘‘ধুর, রোনাল্ডো!’’

বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের ধ্বংস করলে নিজেদের পৃথিবীর অধীশ্বর মনে হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু তা বলে ‘‘ধুর রোনাল্ডো!’’ অধুনা ফুটবল-বিশ্বের সম্রাট না হলেও যুবরাজ তো বটেই তিনি। একত্রিশ বছর বয়স হলেও গোলের সামনে যাঁর স্পটজাম্প বা নাক্‌ল বল ফ্রি-কিক গোলকিপারের হৃদযন্ত্র সাময়িক স্তব্ধ করে দেয়, তাঁকে এমন খোলাখুলি যুদ্ধের আহ্বান?

প্রশ্নটা তুলতে ওঁরা এ বার রোনাল্ডোর পুরুষকারকে চ্যালেঞ্জ করে বসলেন! হুগো বললেন, “তিন গোল দেব। ধরে নিন পর্তুগালকে আমরা গুঁড়িয়ে দিয়েছি। ফাইনালটা নেহাত খেলতে হবে বলে খেলব।” বন্ধুর কথা শুনে ভ্যালেন্তাইন এ বার জুড়ে দেন, “রোনাল্ডোকে বলছি, তুমি পুরুষকার দেখাও। প্রমাণ করো ভাগ্য-টাগ্য কিছুই নয়, তুমিই একাই যা করার করছো। এত বড় প্লেয়ার তো তুমি, দেশকে বড় মঞ্চ পর্যন্ত নিয়ে এসেছো। এ বার ফ্রান্সকে হারিয়ে দেখাও!” তত ক্ষণে আশপাশ থেকে কয়েক জন এগিয়ে এসেছেন। হাতে একটা অদ্ভুত মুদ্রা করছেন ওঁরা। এটা নাকি ধ্বংসের চিহ্ন। সঙ্গে স্লোগান— ‘ধ্বংস হবে রোনাল্ডো!’

পুরো দোষও তো দেওয়া যায় না। ফরাসি কাগজ ‘লে কিপ’ শনিবার গ্রিজম্যান-পোগবাদের জার্মান-বধের ছবি ছেপে লিখেছে: ‘চ্যাম্পিয়নের মতো’। ওই ‘মতো’টা রেখেই খুব সূক্ষ্ম ভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, রবিবার কারা স্তাদ দ্য ফ্রঁস কাঁপাতে যাচ্ছে। ফুটবলাররাও আবেগে উন্মাদপ্রায়। পঁয়ত্রিশ বছরের ‘বুড়ো’ ডিফেন্ডার প্যাট্রিস এভ্রা বলে ফেলেছেন, “সতীর্থরা দেখছি আমায় কাঁদিয়েই ছাড়বে। আমি আজ পর্যন্ত কোনও বড় ট্রফি ফ্রান্সের হয়ে জিতিনি। কিন্তু এ বার মনে হচ্ছে হয়ে যাবে।”

অধিনায়ক হুগো লরিসের মন বলছে, ফাইনালে তাঁদের হারানো খুব কঠিন হবে। গ্রিজম্যান গোটা দেশকে একটু ধৈর্য ধরতে অনুরোধ করেছেন। আসলে বলেছেন, উত্সব জমিয়ে রাখতে! “এটা আমাদের সবার জয়। ১০ জুলাইয়ের জন্য এখন অপেক্ষা করছি আমরা,” বলেছেন গ্রিজম্যান। ভাবলে কেমন লাগে! চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালের মতো মঞ্চে পেনাল্টি মিস করেছিলেন গ্রিজম্যান। ম্যানুয়েল ন্যয়ারকে উল্টো দিকে ছিটকে দেওয়া এক পেনাল্টিতেই আজ তিনি আজ মহানায়ক। আর কোচ দিদিয়ের দেশঁ? তাঁর কাছেও এটা স্বপ্নের মুহূর্ত, গর্বের রাত। বলেছেন, “প্লেয়াররা নিজেরাই নিজেদের ইতিহাসে পৌঁছে দিল। ফ্রান্সের মাঠে এমন জয়... এই অনুভূতি ভাষায় বোঝানো যাবে না!”

ভাষায় সত্যিই বোঝানো যায় না। গত রাতের প্যারিস-প্লাবনকে কি আর পৃথিবীর কোনও ভাষা ধরতে পারে? ফ্যান জোনে খাবার-দাবার, পানীয়ের দাম বেশ চড়া। এক গ্লাস বিয়ার সাত ইউরো। কিন্তু গত রাতে দেখা গেল, ইউরোর তোয়াক্কা না করে দিব্য একে অন্যের গায়ে বিয়ার ছেটাচ্ছে ফরাসি জনতা! একটা সময় দেখলাম, আইসল্যান্ডকে অনুকরণ করে মহাগর্জনে ‘ভাইকিং ক্ল্যাপ’ চলছে। কী আশ্চর্য! মেট্রো-যাত্রাও আজ ফ্রি! ফেরার সময় এক বৃদ্ধকে দেখা গেল, বাড়ির ব্যালকনি থেকে ঝুঁকে নীচের নীল স্রোতের সঙ্গে গলা মেলাচ্ছেন। এবং আরও এক বৃদ্ধের দেখা পেলাম, যাঁকে বোধ হয় আজীবন স্মৃতিতে বাঁচিয়ে রাখা যায়।

টুকটুক করে হাঁটছেন ফ্যান জোনে, বেরোতে চেষ্টা করছেন লাখখানেকের ভিড় থেকে। ইংরেজি জানেন না, ‘জুর্নালিস্ত’ শুনেও দাঁড়ান না, দিশাহারা খুঁজে চলেন বেরোনোর পথ। কালো চশমার ফাঁক দিয়ে দেখলাম, সাদাটে মণি। হাতে লাঠি।

দৃষ্টিহীন।

কেন এসেছেন তিনি? দেখতে তো পাবেন না, তা হলে? শ্রবণেন্দ্রিয়ের ভরসায়? নীল জলরাশির মধ্যে দাঁড়িয়ে তার স্বপ্নের গর্জনের ওম নিতে? হয়তো বা। হয়তো আঠারো বছর আগে তিনি জিদান দেখেছিলেন। হয়তো আঠারো বছর পর গ্রিজম্যান শুনে গেলেন।

জার্মানি আসলে গত কাল জিততই না। ফুটবল-দেবতাই জিততে দিতেন না। যে দেশের অন্ধ ফুটবল-প্রেম দৃষ্টিহীনকেও টেনে আনে ময়দানে, হারিয়ে দেয় জীবনের প্রতিবন্ধকতাকে, সে দেশের বিরুদ্ধে কেউ কখনও জেতে?

euro 2016 Final Portugal vs France
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy