Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
chess

ভবিষ্যতের এক বিশ্বসেরাকেই যেন দেখলাম

রবিবার ভারতীয় সময় মাঝরাতে (রাত দু’টোয়) ছেলেটা যে কাণ্ড করল, তা দেখে বিস্মিত না হয়ে পারা যাচ্ছে না। পাঁচ বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ম্যাগনাস কার্লসেনের বিরুদ্ধে ওর জয় অবিশ্বাস্য বললেও কমিয়ে বলা হবে।

রমেশবাবু প্রজ্ঞানন্দ

রমেশবাবু প্রজ্ঞানন্দ

দিব্যেন্দু বড়ুয়া
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৬:২৩
Share: Save:

কিছুটা সংশয় নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন করেন, বিশ্বনাথন আনন্দের পরে ভারত আর কখনও কোনও বিশ্বচ্যাম্পিয়ন কী পাবে? আমার তো মনে হচ্ছে, অবশ্যই পাবে। এবং সে-ই দাবাড়ু চেন্নাইয়ের ১৬ বছরের কিশোর রমেশবাবু প্রজ্ঞানন্দ হওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়!

রবিবার ভারতীয় সময় মাঝরাতে (রাত দু’টোয়) ছেলেটা যে কাণ্ড করল, তা দেখে বিস্মিত না হয়ে পারা যাচ্ছে না। পাঁচ বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ম্যাগনাস কার্লসেনের বিরুদ্ধে ওর জয় অবিশ্বাস্য বললেও কমিয়ে বলা হবে।

অবশ্য ওর উত্থানও চমকপ্রদ। আমাদের সেরা সময়েও ভাবতে পারতাম না, ১২ বছর ১০ মাস ১৩ দিনের একটা ভারতীয় ছেলে গ্র্যান্ডমাস্টার হয়ে যাবে! ২০১৮-র জুনে প্রজ্ঞা দ্বিতীয় সর্বকনিষ্ঠ জিএম হয়ে হইচই ফেলে দিয়েছিল। তখন থেকেই বিশেষ প্রতিভা হিসেবে সকলে ওকে জানে।

কে ভেবেছিল, মাত্র ১৬ বছর বয়সেই প্রজ্ঞা আরও বড় কিছু ঘটিয়ে ফেলবে। যেন অলৌকিক কিছু। কে না জানে, ২০১৩ সালে প্রথম বার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর থেকে কার্লসেন ক্রমশ ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গিয়েছে। না হলে ক’জন আর বিশ্বখেতাব পাঁচ বার জিততে পারে। ক’জনের ক্ষমতা আছে ওর দুর্ধর্ষ ট্যাকটিক্যাল ডিফেন্স আর অজানা আক্রমণের বাধা অতিক্রম করার।

সেখানে এ দেশের একটা বাচ্চা ছেলে রবিবার সেটাই করে দেখাল! এমন নয়, ভারতের আর কেউ কখনও কার্লসেনকে হারায়নি। আনন্দ তো হারিয়েছেই। নরওয়ের তারকার বিরুদ্ধে একবার জিতেছিল পি হরিকৃষ্ণও। কিন্তু এত কম বয়সি কেউ এই প্রথম কার্লসেনের বিরুদ্ধে জিতল। শুধু এ দেশের কথা বলছি না। বাকি বিশ্বেও আজ পর্যন্ত কেউ পারেনি।

এমন নয়, এয়ারথিংস মাস্টার্সে দারুণ কিছু শুরু করেছে প্রজ্ঞা। উল্টোটাই সত্যি। এমনিতে র‌্যাপিড দাবার ফর্ম্যাটে হচ্ছে এ যুগের প্রতিযোগিতা। একটা ম্যাচের জন্য ১৫ মিনিট। সঙ্গে প্রত্যেকটি চালের জন্য অতিরিক্ত ১০ সেকেন্ড দেওয়া হচ্ছে। প্রত্যেক দিন একজনকে চারটি ম্যাচ খেলতে হচ্ছে। মোট প্রতিযোগী ১৬। শুরুতে রাউন্ড রবিন লড়াই। সেখান থেকে সেরা আটজন খেলবে নকআউট। যা শুরু হবে কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যায় দিয়ে।

অনেকটা ফুটবলের মতোই জিতলে তিন পয়েন্ট, ড্র করলে এক। এখন পর্যন্ত খেলা হয়েছে আট রাউন্ড। নকআউটের আগে বাকি আরও সাতটি ধাপ। বিশ্বচ্যাম্পিয়নকে হারানো প্রজ্ঞা এখন যুগ্ম ভাবে ১২ নম্বরে আছে! অর্থাৎ ও নকআউটে খেলবেই, এখনই বলে দেওয়া যাচ্ছে না। চেন্নাইয়ের ‘বিস্ময় বালক’ পেয়েছে আট পয়েন্ট। আট ম্যাচেই। চারটি হেরেছে। দু’টি ড্র।

আনন্দ কিন্তু সবসময়ই বলে থাকে, প্রজ্ঞার সবচেয়ে বড় গুণ ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা। ছেলেটা রবিবার আক্ষরিক অর্থে সেটাই বোঝাল। চারটির মধ্যে দু’টি ম্যাচই জিতে। প্রথম জয়ও কম কৃতিত্বের নয়। যে ম্যাচে হারিয়েছে বিশ্বের ছ’নম্বর লেভ অ্যারোনিয়ানকে। এবং কার্লসেনের বিরুদ্ধে জিতে শুধু চমকে দেয়নি, একইসঙ্গে দাবা দুনিয়ার চর্চার চরিত্র হয়ে উঠেছে।

অথচ ওর কাজটা মোটেই সহজ ছিল না। ভারতে বসে অনলাইনে খেলতে হচ্ছে রাত জেগে। শুনলাম তার প্রস্তুতি নিতে গত দশদিন ও রাতে কার্যত ঘুমোয়নি। হতে পারে, প্রথম দিন তা-ই কিছুটা অসুবিধে হয়েছে মানিয়ে নিতে।

সুবিধের দিকটাও এখানে বলতেই হয়। সবচেয়ে বড় সুবিধে, এখন প্রজ্ঞারা যে কোনও সমস্যায় সরাসরি আনন্দের সঙ্গে কথা বলে নিতে পারছে। ভারতীয় দাবার একমাত্র বিশ্বচ্যাম্পিয়নই এখন ওদের নতুন মেন্টর।

ঠিক কী ভাবে আমাদের ছেলেটা স্বপ্নের জয় সম্ভব করল? মাস খানেক আগেও যে নেদারল্যান্ডসে কার্লসেনের কাছেই ধ্রপদী দাবায় হেরেছে, সে কোন অস্ত্রে অত দ্রুত খেলেও বার করল ম্যাচ? তা-ও কালো ঘুঁটি নিয়ে।

রবিবার কার্লসেন সাদা ঘুঁটি নিয়ে শুরুতেই মন্ত্রীর দিকে বোড়ে এগিয়ে দেয়। প্রজ্ঞা দু’চালের পরেই চলে যায় কুইন্স গ্যামবিট ডিক্লাইনের ট্যারাস ভ্যারিয়েশনে। এমনিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ভাল জায়গায় ছিল ২০ চালের পরেও। ঠিক এ রকম জায়গাতেই চাপ কাটাতে প্রজ্ঞা একটা বোড়ে খাইয়ে দেয়। তাতে ভারতীয় প্রতিভার খারাপ অবস্থাও ভাল হয়।

সঙ্গে একেবারে ঝানু ও অসম্ভব ঠান্ডা মাথার খেলোয়াড়ের মতো ২৬ থেকে ২৯-এ চারটি মোক্ষম চাল দেয় বোড়ে, মন্ত্রী, রাজা ও গজের। সঙ্গে ফাঁদে ফেলে কার্লসেনকে আরও একটা বোড়ে খাওয়ার টোপ দিয়ে। বিশ্বসেরা তারকা লোভ সামলাতেও পারেনি। তাতে প্রজ্ঞা পেয়ে যায় নিজের মন্ত্রী বিপক্ষের এলাকায় প্রবেশ করানোর সুযোগ। ৩২ চালে (ঘোড়ার সি থ্রি) অবিশ্বাস্য ভুল করে ফেলে কার্লসেন। হতে পারে জীবনে এমন ভুল ও দু’তিনবারও করেনি!

প্রজ্ঞা কিন্তু তার সুযোগ নিয়ে ম্যাচ বার করে ফেলে মাত্র এক মিনিট চিন্তা করে নিখুঁত ফিনিশের সৌজন্যে। যা এই বয়সের দাবাড়ুর অসম্ভব পরিণতিবোধের প্রমাণ। এমনি-এমনি কী ওকেই বিশ্বনাথন আনন্দের পরে ভবিষ্যতের ভারতীয় বিশ্বচ্যাম্পিয়ন মনে করা হচ্ছে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

chess Rameshbabu Praggnanandhaa magnus carlsen
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE