Advertisement
E-Paper

ইস্, আমাদের একটা নীল সমুদ্র কেন নেই

ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের গর্জন এক বার শুরু হলে অবিরাম চলে, চলতেই থাকে। সচিন তেন্ডুলকর স্ট্যান্ড, গাড়ওয়ারে প্যাভিলিয়ন ঘুরে-ঘুরে ওটা আসে, কাঁপিয়ে দিয়ে চলে যায় মুম্বই প্রেসবক্স। আরব সাগর যত নিস্তব্ধ, নিস্তরঙ্গ, ভারতের ম্যাচ পড়লে ঠিক ততটাই যেন বিপরীতধর্মী, সশব্দ প্রতিশোধস্পৃহায় ভুগতে থাকে তার স্টেডিয়াম।

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০১৬ ০৯:৩৪
রঙিন সমর্থন। ছবি: রয়টার্স।

রঙিন সমর্থন। ছবি: রয়টার্স।

ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের গর্জন এক বার শুরু হলে অবিরাম চলে, চলতেই থাকে। সচিন তেন্ডুলকর স্ট্যান্ড, গাড়ওয়ারে প্যাভিলিয়ন ঘুরে-ঘুরে ওটা আসে, কাঁপিয়ে দিয়ে চলে যায় মুম্বই প্রেসবক্স। আরব সাগর যত নিস্তব্ধ, নিস্তরঙ্গ, ভারতের ম্যাচ পড়লে ঠিক ততটাই যেন বিপরীতধর্মী, সশব্দ প্রতিশোধস্পৃহায় ভুগতে থাকে তার স্টেডিয়াম। গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ সেমিফাইনালেই তো। ভারত হেরেছিল, কিন্তু বিরাট কোহালির বীরগাথার সময়ে একবর্ণ লেখা সম্ভব হচ্ছিল না!

চিন্নাস্বামী দেখিয়েছে প্রিয় ক্রিকেটারের নামে মুহুর্মুহু জয়ধ্বনিতে ক্রিকেটের সঙ্গে সমর্থকের একাত্ম হয়ে যাওয়া। দেশ জিতলে তারা মোবাইল ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে আলোর মুক্তোমালা সৃষ্টি করে, আইপিএল ম্যাচে বাজায় ঢাক। ক্রিকেটের প্রতিটা রাত, প্রতিটা দিন ওখানে দুর্গাপুজোর মহাষ্টমী। যার ভোগ বিতরণ চলে গভীর রাত পর্যন্ত, দেশের টিম বাসের পেছনে যখন দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছোটে মানুষ।

ইডেন গার্ডেন্সের আবার অত্যাশ্চর্য এক মাহাত্ম্য আছে। ভারতের আর পাঁচটা ক্রিকেট স্টেডিয়ামের চেয়ে সে কৌলীন্যে এগিয়ে, এগিয়ে সমর্থনের সম্রাটসুলভ আচরণে, ভাল ক্রিকেটের প্রতি গভীর শ্রদ্ধায়। সময়-সময় সে জঙ্গি। কখনও বঙ্গসন্তানের প্রতি অবিচারের প্রতিবাদে ভারত-বিরোধী, কখনও দেশের প্রতি আনুগত্যের উদ্দাম বহিঃপ্রকাশে মাঠ ফাঁকা করে খেলাতে হয়। সে ক্রিকেটের প্রকৃত প্রেমিক, ভাল ক্রিকেটের সে মর্যাদারক্ষা করে, প্রতিপক্ষ পাকিস্তান হলেও অসুবিধে হয় না। আর হ্যাঁ, তার মেক্সিকান ওয়েভটা দেখার মতো!

ভারতের পূর্ব-পশ্চিম-দক্ষিণের ক্রিকেট-সমর্থনের ছবিগুলো এ বার এক-এক করে জুড়ে দিন। কোনও ক্যানভাস ফুটে ওঠে? ওয়াংখেড়ের অক্লান্ত চিৎকার, ইডেনের রাগ, বেঙ্গালুরুর পাগলামিকে এক মোহনায় নিয়ে এলে একটা সার্বিক ছবি ধরা পড়ে? পড়লে, নিশ্চিন্তে এ বার তাকে পাঁচশো দিয়ে গুণ করুন, ভাবতে থাকুন কয়েক মিনিট।

ভাবতে পারলে, ফুটবলের প্যারিসে আপনি স্বাগত!

শনিবার মধ্যরাতের আইফেল টাওয়ার ফ্যান জোনে দাঁড়িয়ে থাকলে, ভারতবর্ষের যে কোনও ক্রিকেট-সাংবাদিকের মনে তুলনার ভাবনাটা আসবে, আসতে বাধ্য। সমর্থন? একে সমর্থন বলে!! যদি একে বলে, তা হলে ভারতে যা দেখা যায়, সেটা কী? বিয়ার নিয়ে ক্রিকেট-বিশ্বের অনেক স্টেডিয়ামে ঢোকা যায়। কিন্তু দেশজ জয়ের চরমতম সুখসীমায় পৌঁছে সেই বিয়ার আকাশে ছুড়ে দেওয়া? কোথায়, দেখা যায় না তো! প্রেমিকা নিয়ে ক্রিকেট মাঠে অনেক যুবক আসেন, কিন্তু রক্ষণশীলতার কাঁটাতার ভেঙে তাকে কাঁধে তুলে নাচা যায় না! ঠোঁটে ঠোঁট রেখে প্রকাশ্য আদর, তা-ও সম্ভব নয়। ফুটবলের প্যারিস কিন্তু পারে, ফুটবলের প্যারিস তা শনিবার রাতে করে দেখিয়েছে।

পাঁচ বছর আগে ধোনি বিশ্বকাপ জেতার পর নাকি মেরিন ড্রাইভে গাড়ির মিছিল দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। পাগলের মতো হর্ন বাজিয়ে পাঁচ মিনিটের রাস্তা তারা পেরোচ্ছিল পাঁচ ঘণ্টায়। কিন্তু গাড়ি আটকে উদ্দাম নাচ? তার বনেটে লাফিয়ে উঠে পড়া? প্যারিস রাজপথ তাতেও কার্পণ্য করেনি। সুধীর গৌতম, ভারতীয় ক্রিকেটের সমর্থনের মুখ, ভারতের ম্যাচ থাকলে যাঁকে স্টেডিয়ামে দেখা যায়, তিনিও নিশ্চিত গো-হারা হেরে যেতেন। ভারতে তিনি একা। ইউরো মহাযজ্ঞের প্যারিসে হাজার-হাজার সুধীর গৌতম। চুল, পিঠ, বুক, গাল— পর্তুগাল, পর্তুগাল।

পর্তুগাল, নামটা ঠিক লেখা হল না বোধ হয়। কেউ তো পর্তুগাল বলছিলেন না, ওঁদের দেশে ওটা ‘পুর্তুগাল’। আর দেশকে নিয়ে গানের সুরটাও মোহময়ী, অপার্থিব— ‘আলে, আলে পুর্তুগাল আলে’। কোয়ারেসমার গোলটার পর দেখা গেল, এক টানে এক জন গায়ের টি-শার্টটা খুলে ফেললেন। রাতে এখানে এখন হাড়কাঁপানো ঠান্ডা, তবু। তার পর সোজা বন্ধুকে মোবাইলটা ধরিয়ে তার সামনে রোনাল্ডোর আকাশ ছুঁয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ার সেই বিখ্যাত সেলিব্রেশনের অনুকরণ!

সিআর সেভেন গত রাতে হাঙ্গেরি ম্যাচের ছায়া ছিলেন, এ সব দেখে কে বলবে? কে বলবে, গোটা ম্যাচে শতাধিক মিনিট তিনি নিষ্ক্রিয় ছিলেন? গোলের সময়টুকু ছাড়া তাঁকে আর পাওয়া যায়নি। আজ ইংল্যান্ডের এক ট্যাবলয়েড লিখেছে, জেতার পরেও টুইটারে রোনাল্ডো নিয়ে বিদ্রুপ হয়েছে। কেউ কেউ লিখেছেন, ‘রোনাল্ডো আপনি মাঠে ছিলেন তো? দেখলাম না!’ কিন্তু সে সব এঁদের কে বোঝাবে? এক তরুণকে দেখা গেল, বন্ধুর কাঁধে উঠে বিয়ার গ্লাস নিয়ে একটা ছোটখাটো টাওয়ার তৈরির ব্যর্থ চেষ্টায়। একটু পরপর সব গ্লাস হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ছে আর তিনি তা ছুড়ে ছুড়ে দিচ্ছেন জনতার দিকে।

ফ্রান্সে বসবাসকারী স্যামুয়েল নামের আর এক পর্তুগিজ যুবককে পাওয়া গেল যিনি ইংরেজিটা মোটামুটি বলতে পারেন। ভারতীয় সাংবাদিক শুনে প্রথমেই প্রশ্ন করলেন, “তোমার দেশ ফুটবল খেলে না?” আহামরি কিছু নয় শুনে দ্রুত বলে দিলেন, “তা হলে দেখে যাও। বিশ্বের সেরা ফুটবলারকে দেখে যাও।” মেসি, তিনি নন? স্যামুয়েলের গলা জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধু এ বার শ্লেষ ছুড়ে দেন, “হাসালে হে। পর্তুগিজকে জিজ্ঞেস করছ মেসি নিয়ে! রোনাল্ডোকে দেখো, বোঝো। যত বার তোমরা মিডিয়া ওর পিছনে লাগবে, তত বার ও প্রমাণ করে দেবে, কে সেরা!” পেছনে তাকিয়ে দেখি, পর্তুগালের বিশাল এক পতাকা নিয়ে একটা দল দাঁড়িয়ে পড়েছে। ‘গ্রুপফি’ উঠবে এখন। এক বৃদ্ধকে দেখা গেল, ‘লস্ট, লস্ট’ বলতে-বলতে দিশাহারা হয়ে ঘুরছেন। বন্ধুদের সঙ্গে এসেছিলেন হয়তো, কাউকে আর খুঁজে পাচ্ছেন না।

এত রং, আবেগের এত বন্য রূপ দেখলে ভাল যেমন লাগে, তেমন ভারতীয় সাংবাদিক হিসেবে চোরা দুঃখও হয়। কোথায়, আমরা যেটা খেলি তাতে তো এত কিছু থাকে না? ‘স্যা-চি-ন...স্যা-চি-ন’ মেঘগর্জন অবশ্যই লোকগাথা, কিন্তু সচিনকে নিয়ে, ভারতকে নিয়ে একটা গোটা গ্যালারি গান তো বাঁধেনি কখনও। নীল জার্সি পরে ভারতের স্টেডিয়ামে অনেকে আসে, কিন্তু সবাই আসে না। পূর্ণাঙ্গ নীল সমুদ্রও তাই তৈরি হয় না, ফাঁক থেকে যায়।

বাবার খেলা দেখে ছেলের হাল। শনিবার পর্তুগাল-ক্রোয়েশিয়া ম্যাচে ক্রিশ্চিয়ানো জুনিয়র। ছবি: টুইটার

ফুটবলে হয়। ফুটবল গান বাঁধে, ফুটবল রঙের সমুদ্র সৃষ্টি করে। এখানে মাঠের জায়ান্ট স্ক্রিনে নিজের দেশের দর্শককে দেখলে লোকে চিৎকার করে পাগলের মতো, চুমু ছোড়ে। লাবণ্য-বন্যতার এমন সঙ্গমের পাশে তখন ক্রিকেট সমর্থনকে খুব পরিমিত লাগে, অগভীর মনে হয়, এবং যাবতীয় রাগ গিয়ে পড়ে এআইএফএফের ওপর।

ফুটবল নিয়ে একটু ভাবলে, খেলাটার উন্নতিসাধনে মন দিলে কে বলতে পারে, বিদেশে দাঁড়িয়ে বিদেশি মাদকতায় হয়তো ডুবতে হতো না! হয়তো বিশ্বের কোনও না কোনও প্রান্তে সৃষ্টি হতো অন্য এক নীল সমুদ্র। এ রকমই কোনও ফ্যান জোনে, জায়ান্ট স্ক্রিনের সামনে। ফুটবল নামক মাদকদ্রব্যের স্বাদ নেওয়া যেত সেখানে দাঁড়িয়ে, দেশের সঙ্গে। আর কিছু না হোক, পর্তুগিজ যুবকের বিস্মিত মুখ অন্তত দেখতে হতো না, কানে আসত না বিদ্রুপ মাখানো শ্লেষ।

আশ্চর্য, তোমার দেশ ফুটবল খেলে না!

Euro 2016 France Ireland Griezmann
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy