ইউরো শুরু হওয়ার আগে প্রায় প্রত্যেক বিশেষজ্ঞের সম্ভাব্য সোনার বুটজয়ীদের তালিকায় ছিলেন টমাস মুলার, রবার্ট লেভানডস্কি, হ্যারি কেন্, জ্লাটান ইব্রাহিমোভিচরা। দু’মাস আগের ক্লাব ফুটবলের ছবি দেখলে ধরা পড়বে বুন্দেশলিগা, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ, ফরাসি লিগে এঁরা গোলের পর গোল করে এসেছেন। কেউ কেউ আবার নিজেদের ব্যক্তিগত লিগে সোনার বুটও জিতেছেন। ইউরোয় ওঁদের মধ্যে কারও দল শেষ ষোলোয় উঠেছে, কারও দল বিদায় নিয়েছে। কিন্তু এই সোনার ফরোয়ার্ডদের মধ্যে ইউরোয় মিল একটাই— কারও নামের পাশে কোনও গোল নেই।
ক্লাব ফুটবলে এখন আধুনিক রীতি হল— ‘তোমার ফরোয়ার্ড লাইন দুর্দান্ত থাকলে তুমিই রাজা।’ ডিফেন্স যতই টাইট হোক না কেন, উল্টো দিকে ভাল ফরোয়ার্ড থাকলে তাঁকে আটকানো কঠিন হয়ে যায়। কিন্তু ইউরোয় ছবিটা পুরোপুরি উল্টো। গ্রুপ পর্ব শেষ হয়ে যাওয়ার পর দেখা যাচ্ছে, টিমগুলো সে ভাবে গোল করতে পারেনি। আর ফুটবল দুনিয়ার সেরা গোল স্কোরাররা আটকে যাচ্ছেন ডিফেন্সের জালে।
কেন এমন হচ্ছে? ইস্টবেঙ্গলকে আই লিগ দেওয়া কোচ মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য মনে করছেন, ইউরোপিয়ান ঘরানার প্রথম বড় নিয়মই হল, কেউ কাউকে জায়গা ছাড়ে না। মনোরঞ্জন বলছেন, ‘‘মুলার, লেভানডস্কির মতো ফুটবলাররা ক্লাবের হয়ে অনেক গোল করে। কিন্তু দেশের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে দাঁড়ায়। ইউরোপিয়ান দেশগুলো ডিফেন্সিভ স্টাইলে দল সাজায়। গোল দেওয়ার থেকেও আগে গোল না খাওয়াটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়।’’
নিজেও ফুটবল জীবনে বহু ফরোয়ার্ড আটকেছেন, তাই জানেন একজন ডিফেন্ডারের জন্য ‘মার্কিং’ জিনিসটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। ভাল মার্কিং হওয়া মানে বিপক্ষ স্ট্রাইকার শট নেওয়ার জায়গা পাবে না, নড়াচড়ার খুব বেশি স্বাধীনতা থাকবে না। মার্কিং মানে তো যে কোনও ডিফেন্ডারের ব্রহ্মাস্ত্র। আর বিপক্ষে যখন কোনও মুলার বা লেভান়ডস্কি থাকবেন, তখন তো মার্কিংটা আরও কড়া হবে। মনোরঞ্জন বললেন, ‘‘মুলার বা লেভানডস্কিরা দেখছি আরও কম জায়গা পাচ্ছে। আশেপাশে তিন-চারজন করে সব সময় থাকছে। এই জন্য এখনও কোনও গোল পায়নি।’’ মনোরঞ্জনের সঙ্গে একমত পাঁচ বার আইলিগজয়ী কোচ আর্মান্দো কোলাসোও। ‘‘ভাল ফরোয়ার্ড থাকলে সবাই পিছনে আরও ম্যান বাড়িয়ে দিচ্ছে। তা হলে মুলাররা গোলটা দেবে কী করে,’’ বলছেন আর্মান্দো।
সেরা শার্পশ্যুটারদের এ রকম ফর্ম নিয়ে আবার দলের কোচেদের থেকেও মনে হয় বেশি চিন্তিত ইন্টারনেট। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে কয়েক জন যেমন ইব্রাহিমোভিচ-মুলারদের গোল না পাওয়ার সঙ্গে মরুভূমিতে পথ হারানো, তৃষ্ণার্ত অভিযাত্রীদের তুলনা করছে। খরা দু’জায়গাতেই!
মার্কিং যদি প্রাথমিক সমস্যা হয় তবে ক্লান্তিকেও কী বাদ দেওযা যায়। ফুটবলাররা এখন ক্লাবের হয়ে প্রায় চল্লিশটার উপর ম্যাচ খেলেন। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ হোক বা ঘরোয়া লিগ, প্রতিটা ম্যাচেই সব কিছু নিংড়ে দেন ফুটবলাররা। আর ক্লাবের হয়ে সাত-আট মাসের দীর্ঘ মরসুমের পরে শারীরিক ভাবেও তো একটা ধকল থাকে ফুটবলারদের উপর। তার উপরে ক্লাব মরসুম শেষ হওয়ার দিন সাতেকের মধ্যে অধিকাংশ ফুটবলারদের যোগ দিতে হয়েছে জাতীয় শিবিরে। ফুটবল বিজ্ঞান বলছে, এই অবস্থায় ‘ফেটিগ’ এড়ানো অসম্ভব। ভারতের আর এক নামী কোচ ডেরিক পেরিরা যেমন বলছেন, ‘‘একটা লম্বা ক্লাব মরসুমের পরে একটু রিকভারি টাইম দরকার হয়। কিন্তু ক্লাবের হয়ে খেলার কয়েক দিনের মধ্যেই তো মুলার, ইব্রাহিমোভিচদের দেশের হয়ে ইউরোর শিবিরে যোগ দিতে হয়েছে। তাই ফুটবলাররা ক্লান্ত হতে বাধ্য। আর ক্লান্ত হলে সহজ কাজগুলো কঠিন লাগে।’’
এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, দু’একটা ম্যাচ বাদ দিয়ে ফুটবল বিনোদনটা মার খেয়েছে ইউরোয়। ইব্রার আর কোনও সুযোগ নেই। কিন্তু মুলার-লেভানডস্কিদের সামনে এখনও সুযোগ আছে ইউরোকে গোল উৎসবে বদলে দেওয়ার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy