Advertisement
E-Paper

‘যে ছেলেটাকে সপাটে চড় মেরেছিলাম, তার মুখটা মনে পড়ছিল’

আমার গ্রামটার কথা মনে পড়ছে। সেই সব মানুষগুলোকে মনে পড়ছে খুব। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমাকে যারা টিটকিরি মারতো, সেই ছেলেগুলোর কথা খুব মনে পড়ছে। যে ছেলেটার গালে চড় মেরে বলেছিলাম, এর পর আমাকে দেখে কিছু বললে, অঙ্গভঙ্গি করলে রাস্তায় ফেলে মারব, সেই ছেলেটার কথা খুব মনে পড়ছে। রিওয় অলিম্পিকের ভিকট্রি স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে মা, বাবা, স্যরের (কোচ) মুখ আর ওদের কথাই বেশি মনে পড়ছিল আমার।

সাক্ষী মালিক

শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০১৬ ১৯:৩৪

আমার গ্রামটার কথা মনে পড়ছে। সেই সব মানুষগুলোকে মনে পড়ছে খুব। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমাকে যারা টিটকিরি মারতো, সেই ছেলেগুলোর কথা খুব মনে পড়ছে। যে ছেলেটার গালে চড় মেরে বলেছিলাম, এর পর আমাকে দেখে কিছু বললে, অঙ্গভঙ্গি করলে রাস্তায় ফেলে মারব, সেই ছেলেটার কথা খুব মনে পড়ছে। রিওয় অলিম্পিকের ভিকট্রি স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে মা, বাবা, স্যরের (কোচ) মুখ আর ওদের কথাই বেশি মনে পড়ছিল আমার। ভাবছিলাম, এ বার কি ওরা একটু বদলাবে? নিজেদের বদলানোর চেষ্টা করবে অন্তত? লজ্জা পাবে? অনুশোচনা হবে ওদের? এর পর কি ওরা মেয়েদের সম্মান করতে শিখবে? যে মেয়েকে ওরা টিটকিরি মারতো রোজ, ভাবতো, মেয়ের বিয়ে দিলেই মা, বাবার ল্যাঠা চুকে যায়, তাদের বুক কি গর্বে একটুও ফুলে উঠছে না মহিলা কুস্তিতে ভারতের প্রথম পদকটা আমি এনে দেওয়ায়?

সেই সব দিনের কথা খুব মনে পড়ে যাচ্ছে। স্যরের কাছে কুস্তি শিখতে যেতাম ছেলেদের সঙ্গেই। ছেলেদের সঙ্গে রোজ টক্কর দিতে হোত স্যরের ক্লাসে। বহু ছেলেকে (পুরুষ কুস্তিগীর) মাটিতে ফেলে দিয়েছি। উপড়ে ছুঁড়ে ফেলেছি, দূরে। প্যাঁচে, ট্যাকলে। স্যরের ক্লাসে যাওয়ার পথে রোজই রাস্তার মোড়ে মোড়ে ছেলেদের জটলা, ঠেক থেকে আমাকে দেখিয়ে হাসাহাসি হোত। মেয়ে হয়ে জন্মেছে, তবু মাটি মেখে পালোয়ান হওয়ার শখ! যেন মেয়েদের পালোয়ান হওয়াটাই মস্ত বড় অপরাধ! তারা শুধু কাঁদবে আর ঘরকন্না করবে! পুরুষের সেবা করবে, সন্তান ধারন ও পালন করবে। হরিয়ানার রোহতকে আমার সেই অজ পাড়াগাঁয়ের মাতব্বর কাকা, জ্যাঠারা, দাদুরাও আমার ওপর খুব চটে গিয়েছিলেন। আমার সরকারি চাকুরে মা, বাবার ওপরেও। বাবাকে রাস্তায় পেলে কেউ ছেড়ে কথা বলতেন না। আমাকে নিয়ে ওঁরা মসকরা করতেন বাবাকে। এমনও বলেছেন কেউ কেউ, ‘‘এক দিন ওই মেয়েই বাবাকে উপড়ে মাটিতে ফেলে দেবে। মাটিতে আছড়ে মারবে।’’ বাবাকে বাগে আনতে না পেরে গ্রামের কাকিমা, জেঠিমারা এসে মাকে বলাবলি শুরু করল, ‘‘করছোটা কী? মেয়েটাকে উচ্ছন্নে পাঠাচ্ছ? বিয়ে দাও। সংসার করুক।’’ মা একটু আধটু দোনামোনা করলেও বাবা এসে আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। যারা বাবাকে আমার সম্পর্কে বলতে আসতেন, বাবা তাঁদের মুখের ওপর সটান বলে দিতেন, ‘‘বেশ করছে। চার পাশে যা অসভ্য, কুলাঙ্গারে ভরে গিয়েছে, তাতে একটা একটা করে অনেককেই মাটিতে আছড়ে ফেলে মারা উচিত।’’

গ্রামের মাতব্বরা বুঝে গিয়েছিলেন, আমার মা, বাবাকে ‘সবক’ শেখানো যাবে‌ না। তাই ১২/১৪ বছর আগে গ্রামের মাতব্বর কাকা, জ্যাঠা, দাদারা এক দিন হঠাৎ করেই চড়াও হয়ে গেলেন আমার স্যর (কুস্তির কোচ) ঈশ্বর দাহিয়ার আখড়ায়। তাঁকে গিয়ে ঘেরাও করে ফেললেন ওঁরা। বিস্তর চেঁচামেচি, চোখরাঙানি। লোকগুলো চিৎকার করে বলেছিল, ‘‘আপনি ওকে শেখাচ্ছেন কেন? ঘরকন্না, বিয়ে, বাচ্চাকাচ্চার চিন্তা না করে একটা মেয়ে কুস্তি শিখবে, এ কেমন কথা! এই মোখড়া গ্রামে এর আগে আর কোনও মেয়ে তো এমন দুঃসাহস করেনি!’’ কিন্তু ঈশ্বরকে কি টলানো যায়?

এর পরেও রীতিমতো ছক কষে রোখার চেষ্টা হয়েছিল আমাকে। গ্রামের একদল ছেলেকে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল আমার পেছনে। যাওয়া-আসার পথে রোজ উত্ত্যক্ত করত ওরা। এক দিন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ায় একটা ছেলেকে ঠাটিয়ে চড় মেরেছিলাম। আখড়ার পথে এগোনোর আগে শাসিয়ে গিয়েছিলাম, ‘‘আর এক দিন দেখলে রাস্তার মধ্যেই তুলে আছাড় মারব।’’

সেই সব দিনের কথা আমার মুখ থেকে শুনেছিলেন কোচ কুলদীপ সিংহ। আমার স্যর ঈশ্বরের কথা শুনেছিলেন। তাই ম্যাচ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমার কোচ কুলদীপ সিংহ আমাকে তুলে নিয়েছিলেন কাঁধে। উৎসবের তখনই শুরু। সে ভারী সুন্দর দৃশ্য। রিওর কারিওকা কুস্তি রিংয়ে জাতীয় পতাকা জড়িয়ে আমি তখন দৌড়চ্ছি পাগলের মতো। এক সময়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ি। মাথা ঠোকাই ক্যানভাসে। একটু পরে ভিকট্রি স্ট্যান্ডে উঠেও কেঁদেছি। আনন্দে, সেই সব দিনের স্মৃতিতে। ভারতের জাতীয় পতাকাটাকে একটু একটু উঠতে দেখে বুকের ভেতরটায় কেমন একটা হচ্ছিল! নিজেকে বলে যাচ্ছিলাম, ‘‘তু তাগড়ি হ্যায়, তুঝকো মেডেল মিলেগি’’।

ম্যাচের আগে আমি সারা দিনই ভেবেছি, আমার জন্য পদক আছে। আমি পারব, এই বিশ্বাসটা আমার ছিল। নিজেকে বুঝিয়েই গিয়েছি, আমার ১২ বছরের তপস্যা মিথ্যা হতে পারে না। পদক জিতবই। তবে এই কৃতিত্বটা শুধুই আমার নয়, তামাম দেশবাসীর। আমার কোচ, স্যর ঈশ্বর, সতীর্থ গীতা (ফোগত) দিদি, সাপোর্ট স্টাফ– সকলেরই।

ব্রোঞ্জের লড়াইটাও সহজ ছিল না। প্রথম দু’রাউন্ডে জেতার পর মেয়েদের ৫৮ কেজি ফ্রিস্টাইল বিভাগের কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে গিয়েছিলাম। রাশিয়ার কাছে। কিন্তু কুস্তির নিয়ম অনুযায়ী, যাঁর কাছে হেরেছেন তিনি যদি ফাইনাল খেলেন, তা হলে এসে যাবে তিন রাউন্ড প্লে-অফ খেলার সুযোগ। এর আগে পদক জয়ের সময়ে যে সুযোগ পেয়েছিলেন সুশীল কুমার, যোগেশ্বর দত্তরা। সেটাই আমি পেয়ে গিয়েছিলাম। প্রথম রাউন্ড ‘বাই’ পাওয়ার পর দ্বিতীয় রাউন্ডে মঙ্গোলিয়ার ওরোখেন পুরেভদরজকে হারিয়ে দিই ১২-৩ এ। কিন্তু কিরঘিজস্তানের আইসুলু টাইবেকোভার সঙ্গে চূড়ান্ত লড়াইয়ের শুরুতেই ০-৫ পিছিয়ে পড়ি। এক সময় মনে হয়েছিল, আর বোধ হয় হল না!

‘ওস্তাদ’-এর মারটা দিলাম একেবারে ‘শেষ রাতে’ই। যে জেদ নিয়ে গ্রামের মুখিয়াদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে যেতাম আখড়ায়, যেন সেই জেদ নিয়েই অত্যাশ্চর্য ভাবে ফিরে এলাম লড়াইয়ে। ‘ডাবল লেগ অ্যাটাকে’ শক্তিশালী সাক্ষী দু’পায়ের ফাঁক দিয়ে হাত গলিয়ে উপুড় করে দিলাম টাইবেকোভাকে। হুমড়ি খেয়ে আছড়ে পড়া প্রতিদ্বন্দ্বীর আর কিছু করার ছিল না। ০-৫ থেকে ৮-৫। মাত্র আট সেকেন্ডেই কেল্লাফতে!

আরও পড়ুন- আমি তৃপ্ত, একটা পদক নিয়ে যাচ্ছি দেশে

আমার অনেক যন্ত্রণার উপশমের সুখটাই এখন আমি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছি। আর এখানেই থেমে গেলে আবার হাসাহাসি শুরু হবে, সেটাও মাথায় রাখছি!

ওদের আর কিছুতেই ঠাট্টা, মসকরা করতে দেব না আমাকে নিয়ে! মেয়েদের নিয়ে!

(পদক জয়ের পর সংবাদ মাধ্যমে দেওয়া সাক্ষী মালিকের বিবৃতির ভিত্তিতেই এই লেখা।)

Rio Olympic Wrestling Shakshi Malik Bronze
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy