Advertisement
E-Paper

সিডনির অঘোষিত ‘ফাইনালে’ অস্ট্রেলিয়া এসে পড়ল ধোনির ভারতের সামনে

জন বুকানন আনন্দবাজারের পাতায় দিন সাতেক আগে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে অস্ট্রেলিয়াকে হারাতে হলে অ্যাডিলেডই সেরা সুযোগ। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট ইতিহাসে সফলতম কোচের থিওরি ছিল যে, ছোট সাইড বাউন্ডারি আর ড্রপ ইন উইকেটের বৈশিষ্ট্য সমেত একমাত্র অ্যাডিলেড ওভালই মাইকেল ক্লার্কের অস্ট্রেলিয়াকে বিপন্ন অবস্থায় পেতে পারে। সেই সুযোগে যদি পাকিস্তান তাদের পেড়ে ফেলতে পারে তা হলে ভারতের সোনায় সোহাগা।

গৌতম ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০১৫ ০৩:৫৭
ওয়াহাব রিয়াজের আগুনে বোলিংও ওয়াটসনের হাসি কাড়তে পারল না। ছবি: গেটি ইমেজেস।

ওয়াহাব রিয়াজের আগুনে বোলিংও ওয়াটসনের হাসি কাড়তে পারল না। ছবি: গেটি ইমেজেস।

জন বুকানন আনন্দবাজারের পাতায় দিন সাতেক আগে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে অস্ট্রেলিয়াকে হারাতে হলে অ্যাডিলেডই সেরা সুযোগ। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট ইতিহাসে সফলতম কোচের থিওরি ছিল যে, ছোট সাইড বাউন্ডারি আর ড্রপ ইন উইকেটের বৈশিষ্ট্য সমেত একমাত্র অ্যাডিলেড ওভালই মাইকেল ক্লার্কের অস্ট্রেলিয়াকে বিপন্ন অবস্থায় পেতে পারে। সেই সুযোগে যদি পাকিস্তান তাদের পেড়ে ফেলতে পারে তা হলে ভারতের সোনায় সোহাগা।

আজকের জুম্মাবার তাই বিরলতম দিন যেখানে মেলবোর্নের হোটেলে বসে থাকা টিম ইন্ডিয়া এবং অগণিত ভারতীয় সমর্থক— সবাই পাকিস্তানের জন্য কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছিলেন। শখ করে কে আর অস্ট্রেলিয়ার মাঠে অস্ট্রেলিয়া খেলতে চায়!

রাতের অ্যাডিলেড ওভাল দেখাল ক্রিকেট স্কিলকে প্রার্থনা দিয়ে কাঁটাতার করে দেওয়া যায় না! সে আপন নিয়মে ফুটবেই! অস্ট্রেলিয়া শুধু তো কঠিন হয়ে যাওয়া ম্যাচটা বারই করল না ভারত সহ বিশ্বকাপে টিকে থাকা দলগুলোর জন্য একটা নীরব বিবৃতি দিয়ে জিতল। বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনাল ছ’উইকেটে অনেকে জিততে পারে কিন্তু তারা আবার ৯৭ বল আগে এমন চূড়ান্ত মাস্তানিতে খেলা শেষ করতে পারে না!

ওয়াহাব রিয়াজ নামক লাহৌরী পেসার একা পাকিস্তানের হয়ে লড়াই করলেন। তিনি ওই ম্যাজিক স্পেলটা করার সময় প্রেসবক্সের আশেপাশেই ঘুরছিলেন ওয়াসিম আক্রম। কেকেআরের হয়ে কিছু দিনের মধ্যেই কলকাতায় এসে পড়বেন, জানালেন। তা বহু বহু বছর পর পাকিস্তানের কোনও পেসারের গতি আর লাইন দেখে মনে হল, না একে আক্রমের ছায়াশিষ্য বলা যেতেই পারে। ঘণ্টায় ১৪৫ কিলোমিটার গতি ওয়াহাবের। শুদ্ধ অ্যাকশন তো অবশ্যই। কোনও কোনও ডেলিভারি ১৪৯ কিলোমিটার অবধি চলে যাচ্ছে। খেলা চলাকালীন দেখলাম কেভিন পিটারসেন টুইট করেছেন, বহু বছরের মধ্যে বিদেশি কোনও বোলারের অস্ট্রেলিয়ার বুকে এটাই সেরা স্পেল। আরও একটা টুইট চোখে পড়ল, রিয়াজ নাকি লাহৌরের বিখ্যাত অ্যাচিসন কলেজের ছাত্র। যেখানকার অ্যালামনির মধ্যে পড়েন ইফতিকার আলি খান পটৌডি, মজিদ খান, ইমরান খানরা। ওয়াহাব সেই সময় গতিতে অস্ট্রেলিয়ার চোখেমুখে ফুলকি ধরাচ্ছেন। ক্লার্ক ফাস্ট বোলার এত ভাল খেলেন। অথচ তাঁর শর্ট বল নামাতে না পেরে শর্ট লেগে আউট হয়ে গেলেন। এর পর ওয়াটসন তাঁকে হুক করতে গিয়ে ফাইন লেগে সহজতম ক্যাচ তুললেন যা ক্লাস সিক্সের ফিল্ডার মিস করলে পরের দিন হাউস টিম থেকে বাদ হয়ে যাবে। রাহাত আলি কাঁপতে কাঁপতে সেটাও ফেললেন। কিছু পরে আর একটা ক্যাচ ফেললেন সোহেল খান। এটাও ‘ফেলা শক্ত’ শ্রেণির পর্যায়ভুক্ত। বোলার সেই ওয়াহাব!

সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

পাকিস্তানবাসী প্রচুর আশা করেছিল মিসবার টিম বিরানব্বইয়ের খোঁচা খাওয়া বাঘের স্মৃতি ফিরিয়ে এনে আশ্চর্য প্রত্যাবর্তন ঘটাবে। তেইশ বছর আগে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়া দলের অভিমুখ তো ঘুরে গেছিল পারথে অস্ট্রেলিয়াকে হারানো থেকেই। আজও অস্ট্রেলিয়া! ভেন্যু আরও সহজ— ব্যাটিং পিচ হিসেবে পরিচিত অ্যাডিলেড। তা সেখানেই তেইশ বছর আগের স্মৃতি ফিরিয়ে আনল মিসবার টিম। তখন গ্রাউন্ড ফিল্ডিং আজকের মতোই শৈশবে ছিল। এমন গজামার্কা ক্যাচ হয়তো পড়েনি, কিন্তু স্ট্যান্ডার্ডটা এমনই হতদরিদ্র ছিল।

মহম্মদ ইরফান ফিট থাকলে তাও হয়তো লড়াই বাড়াতে পারত পাকিস্তান। ওয়াহাব একেবারে একা হয়ে গেলেন। ভাবা হয়েছিল স্পিনে তাঁকে সাহায্য করবেন শাহিদ আফ্রিদি। কিন্তু এই আফ্রিদির ফিটনেসের যা অবস্থা, তাঁকে একমাত্র টিভি স্টুডিওয় মানাতে পারে। মাঠে তাঁকে মমি মনে হচ্ছিল পুরনো লোকটার। গোটা বিশ্বকাপে আফ্রিদির সর্বোচ্চ রান মাত্র ২৮। এমনিতেও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে তাঁর ওয়ান ডে গড় ১৮। এখন না করতে পারেন ব্যাট, না বল। মনে হয় কাঁধের যে জার্কটা দিয়ে বলে মোচড় আনতেন, সেই কাঁধেই কোনও চোট হয়েছে। তিনি এবং মিসবা আজকের পর থেকে ওয়ান ডে ক্রিকেট যে খেলবেন না তাতে মনে হয় না দুঃস্বপ্নেও কোনও পাক সমর্থকের বালিশ ভিজবে বলে। অ্যাডিলেডের সাইড বাউন্ডারি ছোট বলে এত কথা হয়েছিল। তার সুযোগ নিতে গিয়েই কিনা মিসবা সহ তিনটে উইকেট বেকার গেল। প্রতি বারই ফিল্ডার ক্যাচ ধরল লাইনের ধারে।

দুপুরে টিভি বক্সের বাইরে দেখা হতে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় মৃদু হাসলেন। “কী ড্রপ ইন পিচ-ড্রপ ইন পিচ আপনারা বলছিলেন। আমি তো কোনও তফাত বুঝি না। অস্ট্রেলিয়া কেমন পুরু ঘাস রেখেছে দেখেছেন? আরে কারিকুরি করতে চাইলে ড্রপ ইনেও করা যায়।”

তাঁর সঙ্গে এ ব্যাপারে তর্ক এগিয়ে নেওয়ার উপায় নেই। কারণ অ্যাডিলেডের মতো উইকেট যেখানে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের তাজা পিচেও বিরাট কোহলিকে দু’ইনিংসে সেঞ্চুরি করতে দিয়েছে, সেই পিচ আজ এমন পুরু ঘাসের হল কী করে?

রহস্যটা না হয় পরে ফাঁস হবে। এখনকার মতো মিচেল স্টার্ক এবং মিচেল জনসন তার ওপর এমন বন্য হুঙ্কার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন যেন আজ বিশ্বকাপ ফাইনালই হচ্ছে। স্টার্ক এ দিন দু’গজ গতি বাড়িয়ে বল করলেন। জনসন, তিনিও সেকেন্ড স্পেলে ক্রমাগত শর্ট করে গেলেন। পেছনে স্লিপ কখনও তিন জন, কখনও চার জন। মাইকেল ক্লার্ক ব্যাটসম্যানদের প্রায় নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগ দেননি।

দু’টো দলের আসল তফাত অবশ্য বোলিং নয়, করে দিল— ফিল্ডিং। পাকিস্তানের ফিল্ডিং ইমরানের আমলেরও নয়, ভুল লিখেছিলাম। আব্দুল হাফিজ কারদারের সময়কার। যখন ডাইভ দিলে লোকে হাসত। আর অস্ট্রেলিয়া ২০১৯ বিশ্বকাপের। সরফরাজের যে ক্যাচটা ওয়াটসন শুরুতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে নিলেন তাতেই যেন গোটা টিমের ফিল্ডিংয়ে পাশ নম্বর ঠিক হয়ে গেল। অবশ্যই যেটা অনেক উঁচুতে।

পাকিস্তান মিডল অর্ডার তার সামনে ব্যাট করল সত্তর দশকের সেই আরব শেখদের মতো! যাদের সম্পর্কে গল্প প্রচলিত ছিল, এতই বিলাসি যে দেশে ফেরার আগে মেরিন ড্রাইভের ওপরে পাঁচতারা হোটেল থেকে ভারতীয় মুদ্রা ছুড়ে ছুড়ে নীচে ফেলে দেয়। রাহাত আলির সহজ ক্যাচ ফেলাটা যাঁরা টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে দেখছেন, তাঁদের মনে রাখা উচিত ভাগ্যের অফুরন্ত সাহায্য পাকিস্তানও পেয়েছে। সৌভাগ্যটা হল ম্যান অব দ্য ম্যাচ হ্যাজলউডের বল মিসবার উইকেটে লেগেও বেল না পড়া। স্পিনারের বল উইকেটে লেগে বেল না পড়ার ঘটনা নয়। কেউ কখনও শুনেছে পেস বোলারের বল ব্যাটসম্যানের প্যাডে লেগে স্টাম্পে লাগার পর বেল থেকে আগুনের ফুলকিটা অবধি একবার জ্বলেছে। অথচ বেল পড়েনি? ক্রিকেটে এমন ঘটনা আদৌ হয়েছে? মিসবা তখনও রান করেননি। ওই সময় তিনি আউট হয়ে গেলে তো অ্যাডিলেড ওভাল গ্যালারি জুড়ে পাক সমর্থকদের অন্তত দু’এক ঘণ্টার লাফালাফিটাও হয় না।

সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

আজ সকালে মাঠে ঢোকার আগে চার পাশটা এমন ভিড়হীন দেখছিলাম যে, মনে হচ্ছিল ভেতরে বোধহয় কোনও স্কুলের অ্যানুয়াল স্পোর্টস হচ্ছে। এমসিজির ওই রকম লড়াকু মঞ্চ থেকে এখানে ফাঁকা। এ তো যেন দু’পক্ষই দু’পক্ষকে ওয়াকওভার দিয়ে দিয়েছে। মিসবা টস জিতে ব্যাট করছেন তখনও স্যর ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান প্যাভিলিয়নের নীচ দিকটা ফাঁকা। পাকিস্তানি ইনিংসের মাঝখানটায় লোক ঢুকতে ঢুকতে মোটামুটি মাঠটা আবার ভর্তি হয়ে গেল।

পাক সমর্থকেরা অবশ্য ফিরে গেলেন ভাঙা হৃদয় নিয়ে। তাঁদের টিমই তো বিশ্বকাপের বাইরে চলে গেল। শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ আগেই বাইরে চলে গেছিল। একমাত্র উপমহাদেশীয় শক্তির প্রতিনিধিত্ব করতে পড়ে থাকল ভারত। সামনে টুর্নামেন্টের অঘোষিত এক নম্বর। যারা ইতিমধ্যে বলতে শুরু করেছে, সিডনিতে আবার স্পিনিং উইকেট কীসের?

এর পরেও মেলবোর্নে ২৯ তারিখের ম্যাচটাকে কেন ফাইনাল হিসেবে দেখা হচ্ছে কে জানে! ফাইনাল তো সিডনিতে হয়েই যাচ্ছে— ২৬ মার্চ। রেকর্ডে যতই তাকে সেমিফাইনাল বলার চেষ্টা করুক!

সংক্ষিপ্ত স্কোর
পাকিস্তান ২১৩ (হ্যারিস ৪১, হ্যাজলউড ৪-৩৫)
অস্ট্রেলিয়া ২১৬-৪ (স্মিথ ৬৫, ওয়াটসন ৬৪ ন.আ, রিয়াজ ২-৫৪)।

world cup 2015 gautam bhattacharya MS Dhoni Shane Watson Australia Cricket Team Indian Cricket team
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy