Advertisement
E-Paper

রিওয় সোনার লাফ ভারতের ছেলের

তখনও ঘোর কাটেনি। ফোনে কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝে থামছিলেন বছর একুশের মরিয়াপ্পন থঙ্গভেলু। রিও দে জেনেইরোতে তখন ভোর তিনটে। তবু চোখে ঘুম নেই তাঁর। বলছিলেন, ‘‘এই একটা মুহূর্তের জন্যই তো এত দিনের পরিশ্রম!’’

সায়ন আচার্য

শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:০৮
অকেজো ডান পা। রিওয় তবু স্বপ্ন-উড়ান মরিয়াপ্পনের। ছবি: এপি।

অকেজো ডান পা। রিওয় তবু স্বপ্ন-উড়ান মরিয়াপ্পনের। ছবি: এপি।

তখনও ঘোর কাটেনি। ফোনে কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝে থামছিলেন বছর একুশের মরিয়াপ্পন থঙ্গভেলু। রিও দে জেনেইরোতে তখন ভোর তিনটে। তবু চোখে ঘুম নেই তাঁর। বলছিলেন, ‘‘এই একটা মুহূর্তের জন্যই তো এত দিনের পরিশ্রম!’’

হাজার ফ্ল্যাশবাল্বের ঝলকানি ছিল না তাঁর জন্য। ছিল না মিডিয়ার হুমড়ি খেয়ে পড়া। যে ভারতীয় আমজনতা মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেও রিও অলিম্পিক্সের এক-একটা ইভেন্টের দিনক্ষণ মুখস্থ করে টিভির সামনে বসত, তাদেরও ক’জন জানত তামিলনাড়ুর এই তৃতীয় বর্ষের ছাত্রের কথা? কোনও চ্যানেলে নিরবচ্ছিন্ন সম্প্রচারও তো ছিল না! অথচ শুক্রবার রাতে মরিয়াপ্পনও একটা মহাগুরুত্বপূর্ণ হাইজাম্প ফাইনালে নেমেছিলেন। সেটাও এক রিও অলিম্পিক্স— প্যারালিম্পিক্স।

প্যারা-অ্যাথলিট মরিয়াপ্পন সেখান থেকেই একটা সোনার পদক নিয়ে ফিরছেন। এবং ওই একই ইভেন্টে ব্রোঞ্জ জিতেছেন তাঁরই ‘গুরুভাই’, নয়ডার বরুণ সিংহ ভাটি।

রিও অলিম্পিক্সের একেবারে শেষ লগ্নে ব্যাডমিন্টনে রুপো পেয়েছিলেন পিভি সিন্ধু। কুস্তিতে এসেছিল সাক্ষী মালিকের ব্রোঞ্জ। জিমন্যাস্টিক্সে চতুর্থ, দীপা কর্মকার নতুন ইতিহাস লিখেছিলেন। সব ঠিক আছে। কিন্তু ওই যে জনগণমন-র সুরে তেরঙ্গা পতাকাটা উঠতে থাকা— সেই ছবিটাও তো দেখতে চাইছিল দেশ। আট বছর আগে বেজিংয়ে যা দেখিয়েছিলেন অভিনব বিন্দ্রা।

ছবিটা ফিরিয়ে দিল ব্রাজিলের সেই একই শহরে তথাকথিত ‘কম ওজনদার’ প্রতিবন্ধীদের অলিম্পিক্স। প্যারালিম্পিক্সে এর আগে দু’টো সোনা ছিল ভারতের। ১৯৭২ সালে সাঁতারে মুরলীকান্ত পেটিকর, ২০০৪-এর জ্যাভেলিন থ্রোয়ে দেবেন্দ্র ঝাঝারিয়া। কিন্তু এক ইভেন্টে ভারতের সোনা ও ব্রোঞ্জ? নাহ্, এটা কিন্তু নতুন ইতিহাস।

আনন্দবাজারের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ফোনের ওপারে মৃদু হাসলেন মরিয়াপ্পন। বললেন, ‘‘এখনও ভাবতে পারছি না, আমিও অলিম্পিক্সে সোনা জিতেছি। সিনেমা দেখছি না তো?’’

সেই মরচে ধরা লাইনটাই ফের ব্যবহার করতে হয়— মরিয়াপ্পন থঙ্গভেলুর বাস্তব জীবনে চিত্রনাট্যের চেয়ে কিছু কম নাটক নেই।

২০০১। বয়স তখন বছর পাঁচেক। সালেমের অখ্যাত পেরিয়াবাদগমপট্টি গ্রামের স্কুলে যাচ্ছিলেন মরিয়াপ্পন। হুড়মুড় করে এক লরি এসে ধাক্কা মারে তাঁর ডান পায়ে। দিন আনা-দিন খাওয়া পরিবারকে ডাক্তাররা জানিয়ে দেন, কোনও ভাবেই ডান-পায়ে শক্তি ফেরা সম্ভব নয়।

লড়াইয়ের সেই শুরু।

এই ঘটনার পর-পরই, স্ত্রী-ছেলে-মেয়েকে ফেলে রেখে আলাদা সংসার পাতেন মরিয়াপ্পনের বাবা। মা সরোজা কিন্তু লড়ে যাচ্ছিলেন। সংসার চালাতে ইটভাটায় মজুরি আর পাড়ায় পাড়ায় ফল ফেরি করতেন তিনি। ছেলের চিকিৎসার জন্য ব্যাঙ্ক থেকে তিন লক্ষ টাকা ঋণও নিয়েছিলেন। মরিয়াপ্পন বলছিলেন, ‘‘সেই ধার আজও শোধ হয়নি। আশা করি, সোনা জেতার পর ভাগ্যের চাকাটা ঘুরবে।’’

হাইজাম্পে এলেন কী ভাবে?

সে আর এক গল্প। প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও নিচু ক্লাসে স্কুলের ভলিবল দলে সুযোগ পেয়েছিলেন মরিয়াপ্পন। প্রথম কোচ এলামপারিথি বলছিলেন, ‘‘শারীরশিক্ষার শিক্ষক রাজেন্দ্রন সাহেব ওকে ভলিবল খেলতে উৎসাহ দেন। সেই থেকেই ওর খেলাধুলোর শুরু।’’ স্কুল জীবনের শেষ দিকে এলামপারিথি মরিয়াপ্পনকে নিয়ে আসেন হাইজাম্পে। ‘‘ওকে প্রথম দেখি একটা স্থানীয় টুর্নামেন্টে। তখনই বুঝতে পারি, হাইজাম্পে এলে ও অনেক দূর যাবে’’— বলছিলেন প্রথম কোচ।

স্কুলে বন্ধুরা বাঁকা কথা শোনাত, টিটকিরি দিত পাড়ার অনেকেও। তবু একরোখা মরিয়াপ্পনের জীবন কিন্তু বদলাচ্ছিল একটু একটু করে।

বছর দুয়েক আগে বেঙ্গালুরুতে আন্তঃকলেজ টুর্নামেন্টে যান। সেখানেই চোখে পড়েন জাতীয় কোচ সত্যনারায়ণের। মাস ছয়েকের মধ্যেই ফের বেঙ্গালুরু। শুরু হয় নিয়মিত অনুশীলন। মরিয়াপ্পন বলছিলেন, ‘‘কোচ না থাকলে কিছুই হতো না। গত দেড় বছরে উনি আমার টেকনিক পাল্টেছেন, আর তার ফলও পেয়েছি হাতেনাতে।’’ গত মার্চে আইপিসি গ্রাঁ প্রি-তে রেকর্ড গড়ে প্যারালিম্পিক্সে যোগ্যতা অর্জন করেন। তার পর থেকে রিওই ছিল পাখির চোখ। ফোনে কোচও বললেন, ‘‘ঘণ্টার পর ঘণ্টা ট্রেনিং করিয়েছি ওকে। এ দিনও প্রথম রাউন্ডের পর ভেবেছিলাম রুপো জিতবে। সোনাটা সত্যিই ভাবিনি।’’

প্যারালিম্পিক্সে যথেষ্ট কঠিন হিসেবেই ধরা হয় মরিয়াপ্পনের ইভেন্ট, ‘টি ৪২’ হাইজাম্পকে। আর তাতেই শেষ লাফে ১.৮৯ মিটারের রেকর্ড করে ফেলেছেন তিনি। রুপো পেলেন কে? টি-৪২ হাইজাম্পে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন, আমেরিকার স্যাম গ্রিউই। তিনি লাফিয়েছেন ১.৮৬ মিটার। সত্যনারায়ণের আর এক শিষ্য, ব্রোঞ্জজয়ী বরুণও ১.৮৬ মিটার পার করেছিলেন। ছোটবেলায় পোলিওর শিকার বরুণ বিচারকদের রায়ে তৃতীয় হয়ে যান।

রিওর সাফল্য অবশ্য রাতারাতি পাল্টে দিয়েছে দুই হাইজাম্পারের দুনিয়া। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী থেকে শুরু করে অভিনব বিন্দ্রা, অমিতাভ বচ্চন টুইটারে প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন। সঙ্গে শুরু হয়েছে আর্থিক পুরস্কার ঘোষণা। মরিয়াপ্পনের জন্য দু’কোটি টাকার পুরস্কার ঘোষণা করেছেন তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা। ক্রীড়া মন্ত্রক আবার সোনাজয়ী মরিয়াপ্পনের জন্যে ৭৫ লক্ষ এবং বরুণের জন্য ৩০ লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে। এ সবের মাঝেই কোচ সতর্ক করছেন ছাত্রকে। বলছেন, ‘‘ওকে বলেছি, হাওয়ায় না ভাসতে।’’

মরিয়াপ্পন অবশ্য এখন স্বপ্ন দেখছেন একফালি ছাদের। বলছেন, ‘‘এখনও আমরা ভাড়াবাড়িতে থাকি। মা প্রতি মাসে পাঁচশো টাকা ভাড়া দেন। একটা বাড়ি কেনা খুব জরুরি। আর একটা চাকরি।’’

ভোর হচ্ছে রিওয়। মরিয়াপ্পন থঙ্গভেলু এগিয়ে গেলেন অন্য ভোরের দিকে। এক পায়ে স্পোর্টস শু, শীর্ণ অন্য পায়ে একটা নীল মোজা। আর বুকভরা আত্মবিশ্বাস। ওই তাঁর দৌড় শুরু হল!

paralympics gold rio
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy