Advertisement
E-Paper

লর্ডসে কালো আকাশের নীচে বিধ্বস্ত ভারতীয় ব্যাটিং

শুক্রবার বৃষ্টিভেজা লর্ডসে যে ভারতীয় দলে দেখা গেল, তাদের কপিলের দৈত্য নয়, ওয়াড়েকরের ক্ষতবিক্ষত সৈন্য মনে হচ্ছিল। যারা দ্বিতীয় ইনিংসে পঞ্চাশও তুলতে পারেনি। সর্বোচ্চ ছিল একনাথ সোলকারের ১৮ নট আউট। আর কেউ দুই অঙ্কে পৌঁছতে পারেননি। এখানে অতটা খারাপ অবস্থা না হলেও ৩৫.২ ওভারে ইনিংস গুটিয়ে গেল ১০৭ রানে।

সুমিত ঘোষ

শেষ আপডেট: ১১ অগস্ট ২০১৮ ০৩:৪৫
হর্ষ-বিষাদ: ভারতীয় ব্যাটিংকে ধ্বংস করে অ্যান্ডারসনের হুঙ্কার। (ডান দিকে) ধস আটকাতে পারলেন না কোহালিও। শুক্রবার লর্ডসে। রয়টার্স, এপি

হর্ষ-বিষাদ: ভারতীয় ব্যাটিংকে ধ্বংস করে অ্যান্ডারসনের হুঙ্কার। (ডান দিকে) ধস আটকাতে পারলেন না কোহালিও। শুক্রবার লর্ডসে। রয়টার্স, এপি

লর্ডসে দু’রকমের ইতিহাসই আছে ভারতীয় ক্রিকেটের। গর্বের আর লজ্জার!

কপিল দেবের ভারত ১৯৮৩-তে এখানে ক্লাইভ লয়েডের বিশ্বত্রাস ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে ক্রিকেটের সেরা অঘটন ঘটায়। বিশ্বকাপ জিতে ইতিহাস তৈরি করে। আবার ওয়েস্ট ইন্ডিজে সিরিজ জেতা অজিত ওয়াড়েকরের গায়ে ১৯৭৪-এর টেস্ট সিরিজে ৪২ অলআউটের সর্বনিম্ন স্কোরের কালির দাগও লাগিয়ে দিয়েছিল লর্ডস।

শুক্রবার বৃষ্টিভেজা লর্ডসে যে ভারতীয় দলে দেখা গেল, তাদের কপিলের দৈত্য নয়, ওয়াড়েকরের ক্ষতবিক্ষত সৈন্য মনে হচ্ছিল। যারা দ্বিতীয় ইনিংসে পঞ্চাশও তুলতে পারেনি। সর্বোচ্চ ছিল একনাথ সোলকারের ১৮ নট আউট। আর কেউ দুই অঙ্কে পৌঁছতে পারেননি। এখানে অতটা খারাপ অবস্থা না হলেও ৩৫.২ ওভারে ইনিংস গুটিয়ে গেল ১০৭ রানে।

অজিঙ্ক রাহানে সাংবাদিক সম্মেলনে এসে দাবি করে গেলেন, ভারত এখনও ম্যাচ জিততে পারে। শুনে হাসাহাসি হচ্ছিল। এই অবস্থা যাঁদের ব্যাটিংয়ের, তাঁদের ভবিষ্যদ্বাণীতে কে বিশ্বাস রাখবে! আগে জিতুক, তার পর দেখা যাবে।

শুক্রবার বেশির ভাগ সময়টা কালো করে ছিল লর্ডসের আকাশ। শুরুটা ঠিক সময়ে হলেও লুকোচুরি চলল আবহাওয়া আর ক্রিকেটের। বার বার ছেদ পড়ল ম্যাচে। কে জানত ভারতীয় ব্যাটিংয়ের জন্যও কালা দিবস অপেক্ষা করছে।

কোহালি কুম্ভ হয়ে না দাঁড়ালে ভারতীয় ব্যাটিং ডুববে, এটা এখন ধরে রাখা যায়। এ নিয়েও কোনও সন্দেহ নেই যে, ব্যাটসম্যানদের জন্য কঠিনতম পরীক্ষার দিন উপস্থিত হয় এ রকম পরিবেশে। মাথার উপরে সারাক্ষণ মেঘ ঘুরছে, সাপের মতো ছোবল মারছে বল। প্রতিপক্ষে এমন চার বোলার, যাঁরা নিজেদের দেশে বিশ্বের সেরা পেস আক্রমণ। জিমি অ্যান্ডারসন পাঁচ উইকেট নিলেন ২০ রানে। বোঝালেন কেন ডেভিড বেকহ্যামের অনুকরণে তাঁকে নিয়ে বলা হয় ‘বেন্ড ইট লাইক অ্যান্ডারসন’! কিন্তু তিনি একা নন, বাকিরাও এক ইঞ্চি জমি দেননি। মাইকেল হোল্ডিং বলছিলেন, ‘‘পরিবেশ বোলারদের পক্ষে ঠিকই। কিন্তু তার পরেও বোলারদের দৌড়ে এসে ঠিক জায়গায় বলটা ফেলতে হবে। সেটাই করে যাচ্ছে ইংল্যান্ডের পেসাররা।’’

যত দূর মনে করা যাচ্ছে, কোহালিকে একটা সামনের পায়ে কিছুটা হাল্কা ডেলিভারি এবং অশ্বিনকে একটা হাফভলি ছাড়া কোনও আলগা বলই করেননি ইংল্যান্ডের চার পেসার। এটাই ভারতীয় বোলাররা হলে ওভার পিছু দু’টো করে বাজে বল দিতেন।

অ্যান্ডারসনকে ধৈর্য ধরে সামলাচ্ছিলেন কোহালি। সেই সময়টা মনে হচ্ছিল, ক্রিকেটের সেরা ফর্ম্যাট এখনও টেস্ট এবং সেরা দ্বৈরথ চলছে লর্ডসের বাইশ গজে। পাঁচ স্লিপ নিয়ে বল করছেন অ্যান্ডারসন। প্রায় ভর্তি স্টেডিয়াম তাঁকে তাতিয়ে চলেছে। অতক্ষণ বৃষ্টির পরেও কেউ মাঠ ছেড়ে চলে যাননি। এটাই তো টি-টোয়েন্টির জমানায় টেস্ট ক্রিকেটের সেরা বিজ্ঞাপন। অ্যান্ডারসনের অস্ত্র লেট সুইং। সেটাকে সামলানোর জন্য কোহালিও দেরিতে শট খেলছেন। ক্রিজের বাইরে দাঁড়াচ্ছেন যাতে সুইং ভাঙার আগে, সাপ ছোবল মারার আগেই তাকে মেরে ফেলা যায়। চার বছর আগে ইংল্যান্ড সফরে এসে বলের দিকে ব্যাটকে ঠেলে দিচ্ছিলেন। সেই কারণে বার বার ক্যাচ দিচ্ছিলেন উইকেটের পিছনে। এ বার ব্যাট ঢুকিয়ে রাখছেন শরীরের দিকে আর আলগা করে দিচ্ছেন ব্যাটের উপর হাতের রাশ। কানায় লাগলেও বল স্লিপ ফিল্ডারের হাতে পৌঁছচ্ছে না অনেক ক্ষেত্রে।

কিন্তু অ্যান্ডারসনকে সামলাতে সামলাতেই যে উদয় হলেন ক্রিস ওক্‌স। যিনি বল করতে আসার আগেই মাইকেল হোল্ডিং সাবধান করে দিচ্ছিলেন, ‘‘দারুণ সুইং করায় কিন্তু ওক্‌স। লর্ডসের ঢালের দিকটার সুবিধেও পাবে। আরও ভয়ঙ্কর ভাবে বাঁক নিতে পারে ওর আউটসুইং।’’ হোল্ডিংয়ের পর্যবেক্ষণই ঠিক হল। বিদেশের মাঠে এই মুহূর্তে কোহালির উইকেট যাওয়া মানে নব্বইয়ের দশকে সচিনকে আউট করার মতো উৎসব করে সব দল। সেই সময়ে বলা হত, ‘সচিন নাও, ম্যাচ নাও’। এখন ‘কোহালি নাও, ম্যাচ নাও’। সেটাই দেখা গেল ওক্‌স প্রতিপক্ষ অধিনায়ককে তোলা মাত্র।

ওয়াড়েকরের টিমে সে দিন সর্বোচ্চ স্কোরার ছিলেন সোলকার। এ দিন কোহালির দলের সর্বোচ্চ স্কোরার অশ্বিন। ৩৮ বলে করলেন ২৯। কোহালি ৫৭ বলে ২৩। রাহানে ১৮। হার্দিক পাণ্ড্য দু’বার ব্যাটের কাণায় লাগিয়ে পাওয়া বাউন্ডারির সৌজন্যে ১১। বাকিরা কেউ দুই অঙ্কে পৌঁছননি। এম বিজয়, কে এল রাহুলদের দেখে মনে হচ্ছিল, জয়েন্টের প্রশ্নপত্র ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে ক্লাস ওয়ানের শিশুদের হাতে। যাঁদের কোনও ধারণাই নেই এই পরিবেশে কী ভাবে সুইং শিল্পীদের খেলতে হবে।

ক্রিকেট ম্যাচ সম্প্রচারের সময় দেখানো একটা বিজ্ঞাপন খুব জনপ্রিয় হয়েছে। যেখানে বলা হয়, ভারতের রাস্তায় আলাদা আলাদা সব মহাপুরুষ পাওয়া যায়। সেটাকে অনুকরণ করে ভারতীয় ব্যাটিং নিয়ে এখন বলা হচ্ছে, ম্যাচ দেখতে আসুন। আলাদা আলাদা সব মহাপুরুষ দেখতে পাবেন। দুই ওপেনার পাবেন, যাঁদের ডাকনাম ‘স্টাইল ভাই’। কারও মাথায় পনিটেল। কারও ভর্তি ট্যাটু। কেউ হাঁটতে হাঁটতে বোল্ড হবেন, কেউ স্লিপে ক্যাচিং প্র্যাক্টিস দেওয়াতে সেঞ্চুরি হাঁকানোর মুখে।

স্টাইল ভাই নম্বর তিন— অলরাউন্ডার হার্দিক পাণ্ড্য। একটা বল স্লিপে খোঁচা দিয়ে সহজ ক্যাচ পড়ায় বেঁচে গেলেন। পরের বল ঠিক একই ভাবে ক্যাচ দিয়ে আউট। এজবাস্টনে যে ভাবে ব্যাট-প্যাডের ফাঁক দিয়ে বল গলে বোল্ড হয়েছিলেন দীনেশ কার্তিক, এখানেও তা-ই। তা হলে দু’টো টেস্টের মাঝের দিনগুলোতে কী করলেন তিনি!

লাইভ খেলা দেখছি না অ্যাকশন রিপ্লে, গুলিয়ে যাচ্ছিল! এজবাস্টনে তা-ও কোহালি রান করেছিলেন। এখানে সেটা ঘটেনি। পূজারা-কোহালি পার্টনারশিপ তৈরি হচ্ছিল। সেটাও ভেঙে গেল ভুল বোঝাবুঝিতে পূজারা রান আউট হতে। ব্যাটিংয়েরও তাই কালা দিবস চলল! ব্যাটিংয়ের কালা দিবস।

Cricket Test India England James Anderson Virat Kohli
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy