Advertisement
E-Paper

টি-টোয়েন্টির উপহার পন্থদের ‘মাস্‌ল মেমোরি’

যে কোনও খেলায় সফল হওয়ার জন্য প্রয়োজন দক্ষতা। এই দক্ষতা হল মায়েলিন নামের এক বস্তুর বৃদ্ধি। আমাদের মোটর নার্ভের উপর একটি আবরণ থাকে। যাকে বলা হয় মায়েলিন আবরণ।

চিন্ময় রায়

শেষ আপডেট: ১০ মে ২০১৯ ০৩:০৩
পন্থ: একই শট বারবার খেলে তুঙ্গে ঋষভের ‘মাস্‌ল মেমোরি’।

পন্থ: একই শট বারবার খেলে তুঙ্গে ঋষভের ‘মাস্‌ল মেমোরি’।

গুগলে মাস্‌ল মেমোরি ক্লিক করলেই এখন আসছে ঋষভ পন্থের নাম। সানরাইজার্স হায়দরাবাদের বিরুদ্ধে এলিমিনেটরে ২১ বলে ৪৯ রান করার পরে পন্থ ফাঁস করেছেন তাঁর ছয় মারার রহস্য। পন্থ জানিয়েছেন, মাস্‌ল মেমোরির সাহায্যে একের পর এক বল তিনি গ্যালারিতে পাঠিয়েছেন। পন্থের পেশির শক্তি নিয়ে সন্দেহ নেই। ৯০ মিটারের ছক্কাগুলো তার প্রমাণ। কিন্তু পেশির স্মৃতির অর্থ কী? মানে এ কী মুখস্ত বিদ্যা ব্যবহার করে ছয় মারা?

না। বিষয়টি এতো হাল্কা নয়। শারীর বিজ্ঞানের চোখ দিয়ে মাস্‌ল মেমোরি বিষয়টি সহজ করে বোঝা যাক।

বিজ্ঞানের ভাষায় মাস্‌ল মেমোরি: যে কোনও খেলায় সফল হওয়ার জন্য প্রয়োজন দক্ষতা। এই দক্ষতা হল মায়েলিন নামের এক বস্তুর বৃদ্ধি। আমাদের মোটর নার্ভের উপর একটি আবরণ থাকে। যাকে বলা হয় মায়েলিন আবরণ। অনুশীলনে মগ্ন থাকার সময় মোটর নার্ভে অনবরত সঙ্কেত পৌঁছয়। তাতে নার্ভের উপর মায়েলিনের আবরণ আরও মোটা হয়। যত মায়েলিনের বৃদ্ধি হয়, ততই বাড়ে মাস্‌ল মেমোরি। নার্ভ থেকে দ্রুত মস্তিষ্কে পৌঁছয় সঙ্কেত।

ব্যাটিংয়ের মাস্‌ল মেমোরি: বার বার অনুশীলনের ফলে পেশির মধ্যে পরিবর্ত ক্রীয়া সৃষ্টি হয়। ঠিক সাইকেল চালানোর মতো। বিষয়টি একেবারে মজ্জায় ঢুকে যায়। এটাই মাস্‌ল মেমোরি। ক্রিকেটের ক্ষেত্রে মাস্‌ল মেমোরির একটি ধারণা দিয়েছেন কুইন্সল্যান্ডের এক গবেষক। তিনি বলেছেন, ‘‘ব্যারি রিচার্ডসের ব্যাটিং দেখে অনেকে বলতেন ও যেন অর্ধেক ঘুমের মধ্যে ব্যাট করছে। এতটাই দেরিতে বল মারতেন। গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথের লেটকাট কেউ ভোলেনি। উইকেটকিপারের গ্লাভসে বল পৌঁছনোর মুহূর্তে স্পিনারকে কাট করতেন। দেরিতে শট নেওয়ার জায়গায় শরীরকে নিয়ে যাওয়াই হল বডি পজিশনের শেষ কথা। সে জায়গায় পৌঁছলে ব্যাটসম্যান দারুণ টাইমিংয়ের সঙ্গে শট নিতে পারে। বহুবার অনুশীলন করার পরেই শরীরকে সেই জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়।’’ এটাই ব্যাটিংয়ের মাস্‌ল মেমোরি।

অনুশীলনই শেষ কথা: প্রয়াত বব উলমার তাঁর বই, ‘‘দি আর্ট অ্যান্ড সায়েন্স অব ক্রিকেট’’-এ লিখে গিয়েছেন, ব্যাটিং বা বোলিংয়ের কোনও একটি ভঙ্গি ১০ হাজার বার অনুশীলন করলে তা অবচেতন মনে জায়গা করে নেয়। এ ভাবেই তিনি মাস্‌ল মেমোরিকে ব্যাখ্যা করেছেন। স্যর ডন ব্র্যাডম্যান একটি স্টাম্পের সাহায্যে দেওয়ালে গল্‌ফ বল মেরে প্রস্তুতি নিতেন। যাতে প্রত্যেকটি বল ব্যাটের মাঝখান দিয়ে তিনি খেলতে পারেন। সে ভাবেই তৈরি হয় তাঁর মাস্‌ল মেমোরি। ভারতের প্রাক্তন স্পিন-ত্রয়ী বেদী, প্রসন্ন ও বেঙ্কটরাঘবনের কথা উঠলে সবাই বলতেন, মাঝ রাতে উঠে বল করলেও ওঁরা গুড লেংথ স্পটেই বল ফেলবেন। সেটাই বোলারদের মাস্‌ল মেমোরি।

অনুশীলনের সঠিক পদ্ধতি জানতে হবে: ভারতীয় দলের সঙ্গে কাজ করার সময় দেখেছি বব উলমারের দশ হাজার বারের এই তত্ত্ব স্মরণ করিয়ে দিতেন বর্তমান বোলিং কোচ বি অরুণ। মুনাফ পটেল, শ্রীসন্থদের নেটে একটি লক্ষ্য তৈরি করে দিতেন। দু’পা দৌড়ে এসে সেই লক্ষ্যে বল করতে হত। এমনকি স্টাম্পের সামনে বোতল রেখেও ভুবনেশ্বর কুমার, আশিস নেহরাদের তাতে মারতে বলতেন। একই অনুশীলন একাধিক বার করার পিছনে লক্ষ্য ছিল মাস্‌ল মেমোরি তৈরি করার। কেন বুমরা ও ভুবনেশ্বর এত ভাল ইয়র্কার করেন? তার পিছনে রয়েছে সঠিক অনুশীলনের পদ্ধতি। ভিডিয়োয় দেখা হত বল ছাড়ার সময় হাত ও পায়ের মধ্যে সঠিক ব্যবধান রয়েছে কি না। এতটাই গভীরে গিয়ে অনুশীলন করানো হত। তবেই ইয়র্কার মারলে ম্যাচে সেটা ফুলটস হবে না।

কোহালি: মাস্‌ল মেমোরির সঙ্গে যোগ হয়েছে পেশি শক্তিও। নিয়মিত অলিম্পিক লিফ্টিংয়ে।

শারীরচর্চা প্রভাব ফেলে ব্যাটিং, বোলিংয়ে: দৌড়বিদ হওয়ার স্বপ্ন দেখলে একজনকে দৌড়তে হবে। সাইক্লিস্ট হওয়ার স্বপ্ন দেখলে আগে চালাতে হবে সাইকেল। তেমনই এক জন ক্রিকেটারকে পেশি শক্তি বাড়াতে গেলে ক্রিকেটের নিয়ম মেনেই ব্যায়াম করতে হবে। টি-টোয়েন্টির যুগে অনেকেই ছয় মারে। কিন্তু আন্দ্রে রাসেল বা ঋষভ পন্থের মতো এক নাগাড়ে কেন ছয় মারতে পারে না? এখানেই ভূমিকা রয়েছে শক্তি বাড়ানোর ব্যায়ামের। ভারতীয় দলের ফিটনেস কোচ শঙ্কর ভাসুর সঙ্গে কাজ করে বুঝেছি, শক্তি বাড়ানোর একটি দিক হল ফাংশনাল ট্রেনিং। সহজ কথায়, ক্রিকেটে বল করা অথবা ব্যাট করার ভঙ্গি ব্যবহার করেই শক্তি বাড়ানোর ব্যায়াম। ক্রিকেটে সুইপ শট নেওয়ার ভঙ্গিতেই মেডিসিন বল নিয়ে লাঞ্জ অ্যান্ড রোটেশন ট্রেনিং করা যায়। খেলা শুরু হওয়ার আগে পেসাররা বল করার ভঙ্গিতেই মেডিসিন বল ছুড়ে পেশির শক্তি বাড়ায়। এই পদ্ধতিতে অনুশীলন করলে পেশিগুলোও ক্রিকেটের ভঙ্গি অনুযায়ী সক্ষম হয় এবং ক্লান্ত হয়ে পড়ে না। সেই সঙ্গে প্রয়োজন পাওয়ার ট্রেনিং। পাওয়ার ট্রেনিং অর্থাৎ অলিম্পিক লিফ্ট। শরীরের নীচ থেকে দ্রুত কাঁধের উপর বারবেল তোলার অনুশীলন। যা করে জোর বাড়িয়েছেন বিরাট কোহালি।

কী ভাবে: ২০১২ সালে বিরাট কোহালির শটে সে রকম জোর ছিল না। ছয় মারার চেষ্টা করতেন, কিন্তু বল পড়ত বাউন্ডারির আগে। হতাশ কোহালি তার পরে শঙ্কর ভাসুর কাছে শুরু করেন অলিম্পিক লিফ্ট। দ্রুত পেশি শক্তিশালী হওয়ার সঙ্গে যোগ হয় মাস্‌ল মেমোরি। বর্তমানে বিরাটের শট একের পর এক পড়ছে গ্যালারিতে।

মাস্‌ল মেমোরির সমস্যা: মাস্‌ল মেমোরির চক্রব্যূহে আটকে অনেক বোলার নির্বিষ হয়ে গিয়েছেন। যেমন সুনীল নারাইন। সন্দেহজনক অ্যাকশন বদলের পরে কমে গিয়েছে তাঁর উইকেট সংখ্যা। কিন্তু যশপ্রীত বুমরার অ্যাকশনে সমস্যা থাকা সত্ত্বেও ওর অ্যাকশন বদলানো হয়নি। বুমরার বাঁ হাত কাঁধের ওপর ওঠেই না। জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে অরুণ চেষ্টাই করেননি বুমরার অ্যাকশন বদলানোর। অরুণ বলতেন, খুঁত থাকা অ্যাকশনে যদি আঘাতজনিত সমস্যা না আসে তা হলে যে রকম আছে, সে রকম রেখে দাও। সচেতন ভাবে মোটর নার্ভের ১৫-২০ বছরের কাজ করার রাস্তা বদলাতে গেলে খারাপ ছাড়া ভাল হবে না। যে সমস্যা দেখা গিয়েছে নারাইনের ক্ষেত্রে।

শেষে একটা কথাই বলার। কথায় আছে, ‘‘অনুশীলন তোমাকে ধারালো করে’’। কিন্তু আমি বলব সঠিক অনুশীলনের পদ্ধতিই একজনকে ধারালো করে তোলে।

IPL 2019 Cricket Muscle Memory Rishabh Pant Virat Kohli
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy