Advertisement
E-Paper

ডেভিসে লি-সাম্রাজ্যের পতন দেখল রাজধানী

চৌহান। ঘোরি। লোদি। মুঘল। ব্রিটিশ— অনেক সাম্রাজ্যের ঐতিহাসিক পতন দেখেছে দিল্লি। শনিবারের বারবেলায় পেজ-সাম্রাজ্যের পতনও দিল্লিতে সম্ভবত ঘটে গেল!

সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:৩৯
স্বপ্নভঙ্গের দিন। স্টেপানেকদের বিরুদ্ধে ডাবলসে হেরে ১-২ পিছিয়ে পড়লেন লি-বোপান্নারা। শনিবার। নয়াদিল্লিতে। ছবি: প্রেম সিংহ।

স্বপ্নভঙ্গের দিন। স্টেপানেকদের বিরুদ্ধে ডাবলসে হেরে ১-২ পিছিয়ে পড়লেন লি-বোপান্নারা। শনিবার। নয়াদিল্লিতে। ছবি: প্রেম সিংহ।

চৌহান। ঘোরি। লোদি। মুঘল। ব্রিটিশ— অনেক সাম্রাজ্যের ঐতিহাসিক পতন দেখেছে দিল্লি। শনিবারের বারবেলায় পেজ-সাম্রাজ্যের পতনও দিল্লিতে সম্ভবত ঘটে গেল!

দেশের চিরসবুজ টেনিস নক্ষত্র ডিএলটিএ-র কোর্টে রোহন বোপান্নাকে নিয়ে জাতীয় দলের নীল জার্সিতে নিছক একটা ডাবলস ম্যাচই শুধু হারলেন তা তো নয়! চেকদের বিরুদ্ধে ১-২ পিছিয়ে পড়ে ভারতের ডেভিস কাপ ওয়ার্ল্ড গ্রুপে ওঠার পথ কঠিন করে তুলেছেন তাও কেবল নয়। তার চেয়েও অনেক বেশি তাৎপর্যের, ঘরের মাঠে দেড় যুগ পরে প্রথম কোনও ডেভিস কাপ ডাবলসে হারতে হল লিয়েন্ডারকে। শেষ বার এমন ঘটেছিল ১৫ বছর আগে ২০০০-এ লখনউয়ে লেবাননের বিরুদ্ধে সৈয়দ ফজলউদ্দিনকে পার্টনার নিয়ে।

সেটাও চিরলড়াকু লিয়েন্ডার পেজ পাঁচ সেটে হেরেছিলেন। আজকের আগে ডেভিসে তাঁর শেষ হারও তিন বছর আগে। উজবেক জুটির বিরুদ্ধে অ্যাওয়ে টাইয়ে। সেটাও চার সেটে। শনিবারের মতো আত্মসমর্পণের লজ্জা মাখা ৫-৭, ২-৬, ২-৬-এর মতো নয়! নিজের সাতটা সার্ভিস গেমের চার-চারটেতে ব্রেক হয়ে নয়। সঙ্গীর তিনটে সার্ভিস গেম নষ্ট হওয়ার পিছনে ‘অপরাধী’ থেকে নয়। নোটবুক খুলে দেখছি, বোপান্নার সার্ভ ব্রেকে লিয়েন্ডারের ফোর্সড আর আনফোর্সড এরর-এর মিলিত সংখ্যা নয়-নয় করে ন’টা!

রাদেক স্টেপানেক-অ্যাডাম পাভলাসেকের বিরুদ্ধে ১২৯ মিনিটের ম্যাচে নেটের সামনে তাঁর একটা মাত্র সেই রিটার্ন, যার পিছনে সুপরিচিত অ্যাথলেটিজম, সেই রিফ্লেক্স। পিছন থেকে মারা গোটা দুয়েক চতুর ওভারহেড লব, দু’-চারটে তড়িৎ ড্রপ ভলির বাইরে লিয়েন্ডারের আজ কোনও মনে রাখার মতো শট নেই। অথচ স্টেপানেক এভারেস্ট সমান অভিজ্ঞ ডাবলস তারকা হলেও তাঁর আর অ্যাডামের জুটি আজই প্রথম বার কোর্টে নেমেছিল। কুড়ি বছরের অ্যাডামের ডাবলস র‌্যাঙ্কিং আড়াইশোরও বেশি। ডেভিসে মাত্র দ্বিতীয় ডাবলস ম্যাচ খেললেন। সেখানে নেটের উল্টো দিকের লিয়েন্ডার-রোহন জুটি শুধু ডেভিসেই নয়, পেশাদার ট্যুরেও কম করে গোটা তিরিশেক ম্যাচ খেলেছেন গত ন’বছরে। কিন্তু লিয়েন্ডারের সাংবাদিক সম্মেলনে বলা কথাটাই বোধহয় সত্যি!

‘‘আজ কোর্টে তিন জন গ্রেট ডাবলস প্লেয়ার ছিল। কিন্তু সবচেয়ে ভাল খেলল এক অনভিজ্ঞ তরুণ! হতে পারে অ্যাডামকে আমরা টার্গেট করব, এটা একটু বেশি ভেবে আর ওর পিছনে একটু তাড়াতাড়ি পড়তে গিয়ে উল্টে ওকেই বাড়তি উদ্দীপ্ত করে দিয়েছিলাম আমরা!’’

বোপান্নাও যথেষ্ট খারাপ খেলেছেন। বাঁ দিকের কোর্ট, টেনিসের পরিভাষায় যাকে অ্যাডভান্টেজ কোর্ট বলে, সে দিকে খেললে সেই প্লেয়ারকে আরও বেশি জমাট হতে হয়। অগোছালো, দ্বিধাগ্রস্থ থাকলে চলে না। কারণ, ১৫-৩০, ৩০-৪০-এর মতো বিগ পয়েন্টগুলো বাঁ দিকের কোর্টেই খেলা হয়। অথচ এ দিন সার্ভিস রির্টানের সময় বোপান্নার ব্যাকহ্যান্ড অচল। নেটের সামনে ফোরহ্যান্ড অচল। এর পরে এক জন ডাবলস প্লেয়ারের খেলায় আর কী থাকল!

কিন্তু পার্টনারের খারাপ দিনে তাঁকে ঘাড়ে নিয়ে, সঙ্গীর খেলাটাও প্রায় নিজে খেলে দিয়ে ডেভিসে অনেক ডাবলস ম্যাচ অতীতে বার করেছেন লিয়েন্ডার। এ দিন সে সব তো অনেক দূরের ব্যাপার, অত্যাশ্চর্য ভাবে চাপের মুখে লিয়েন্ডারের সেই বিখ্যাত বডি ল্যাঙ্গুয়েজটাও যেন উধাও! একমাত্র চেকদের প্রথম সেট জেতার জন্য করা অ্যাডামের সার্ভিস গেম ভারতীয় জুটি ব্রেক করার পর লিয়েন্ডার হাত মুঠো করে গ্যালারির দিকে বার কয়েক ছুড়লেন। ব্যস, ওই এক বারই!

বরং তৃতীয় সেটে স্টেপানেকের সার্ভিস লিয়েন্ডারের নেটে রিটার্নে চেক প্রজাতন্ত্র ম্যাচ জেতার পর ৩৭ বছরের চেক ডাবলস তারকা এক দৌড়ে গ্যালারিতে উঠে গিয়ে তাঁর দেশের সমর্থকদের আলিঙ্গনে ধরা দিলেন। ঠিক সেই সময় লিয়েন্ডারের মুখটা প্রেসবক্স থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল— করুণ মুখে ওই দিকেই তাকিয়ে! যেন বলতে চাইছেন— আজ যেটা আমার করার কথা ছিল, ভাই রাদেক, তুমি সেটা করছ!

দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবালের দু’দলের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার চেয়েও আজ চমকপ্রদ ছিল গ্যালারিতে ভারতীয় পুরুষ আর মেয়ে হকি দলের হাজিরা। কঠিন টাইয়ের একমাত্র যে ম্যাচে ভারত হটফেভারিট সেই ডাবলসে লিয়েন্ডারদের উৎসাহ দিতে। কিন্তু মেয়ে হকি দল প্রথম সেটের পরেই উঠে পড়ে। আর অলিম্পিক্স হকি দলের কোচ অল্টম্যান্স দ্বিতীয় সেট দেখে যখন বেরিয়ে যা্চ্ছেন, এক পরিচিত সাংবাদিককে দেখে কাঁধ ঝাঁকিয়ে যে ভঙ্গিটা করলেন, তার একটাই মানে হয়— এর পরে আর বসে থেকে কী লাভ! অন্য ইভেন্টের হলেও, কোচ তো! ঠিক ধরে ফেলেছিলেন, আজ শেষমেশ কী করুণ পরিণতি আছে লিয়েন্ডারদের!

টেনিসমহলও বিশেষ ভিন্ন মত নয়। জয়দীপ মুখোপাধ্যায় ‘‘এটা ভারতীয়দের একটা খারাপ দিন ছিল’’ প্রথমে বলেও যোগ করলেন, ‘‘তবে লিয়েন্ডার-বোপান্নাকে এত খারাপ খেলতে আগে দেখিনি।’’ আখতার আলির আবার সংযোজন, ‘‘ট্যুরের ‘বেস্ট অব থ্রি’ সেট ম্যাচে তোমার যে সব ভুলত্রুটি চাপা দিলেও দেওয়া যায়, ডেভিসে পাঁচ সেটের খেলায় সেগুলো ধরা পড়বেই।’’

কথাটার লক্ষ্য কি লিয়েন্ডার? কিংবদন্তি মার্টিনা হিঙ্গিসকে নিয়ে খেলে মিক্সড ডাবলসে ইতিহাস গড়লেও ডাবলস সার্কিটে প্রথম দু’মাসের পর থেকে লিয়েন্ডারের রেজাল্ট নিদারুণ! ছ’জন পার্টনার পাল্টেছেন। একটাও গ্র্যান্ড স্ল্যামে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠেননি। এটিপি টুরেও সর্বোচ্চ— সেমিফাইনাল!

অথচ, আধুনিক ডাবলস ম্যাচ আগের চেয়ে বেশি বেসলাইন নির্ভর হয়ে পড়ছে বলে তার সঙ্গে মানিয়ে নিতে বিয়াল্লিশেও লিয়েন্ডার নতুন ব্যক্তিগত কোচ এনেছেন মাত্র তিন মাস আগে। তাঁরই প্রাক্তন যুক্তরাষ্ট্র ওপেন ডাবলস খেতাব জয়ী পার্টনার মার্টিন ডাম।

টুপিতে আর এক চেক পালক! লিয়েন্ডারের খেতাব, রানার আপ ট্রফি মিলিয়ে ১৬টা গ্র্যান্ড স্ল্যাম ডাবলস ফাইনালের দশটায় চেক পার্টনার। এখন কোচও সেই দেশের। স্টেপানেক বোধহয় ঠিকই বলেছেন, ‘‘লিয়েন্ডার তো অর্ধেক চেক।’’

বাকি অর্ধেকে কি পুরো ভারতীয় আবেগ আসছে না আর! কিন্তু এই লোকটাই তো ডেভিসে নামেন বুকে অদৃশ্য তেরঙ্গা নিয়ে! না কি স্কিলে টান? অবশেষে!

Leander Paes Rohan Bopanna magic
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy