Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
মনোহর আইচ (১৯১২-২০১৬)

কলকাতাকে আরও এক উপহার, ‘মন্দির’ দান করে গেলেন পূজারি

পাইকপাড়ার প্রবীণ বাসিন্দার বাড়িতে মুসুরির ডাল আর পুঁইশাকের চচ্চড়ি রা­ন্না হয়েছিল রবিবার দুপুরেও। তবে এ বার আর সেটা দিয়ে গুরুকে বাঁধা গেল না! বাগুইয়াটির যোগীপাড়ায় মনোহর আইচের নিথর দেহটার পায়ের কাছে বসে তিরাশি বছরের ছাত্র ক্ষিতীশ রঞ্জন চট্টোপাধ্যায় চোখ মুছতে মুছতে বলে উঠলেন, ‘‘মুসুরির ডাল আর পুঁইশাকের লোভ দেখিয়েও বিষ্ণুদাকে আটকাতে পারলাম না।”

প্রীতম সাহা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ জুন ২০১৬ ০৪:০৭
Share: Save:

পাইকপাড়ার প্রবীণ বাসিন্দার বাড়িতে মুসুরির ডাল আর পুঁইশাকের চচ্চড়ি রা­ন্না হয়েছিল রবিবার দুপুরেও। তবে এ বার আর সেটা দিয়ে গুরুকে বাঁধা গেল না!

বাগুইয়াটির যোগীপাড়ায় মনোহর আইচের নিথর দেহটার পায়ের কাছে বসে তিরাশি বছরের ছাত্র ক্ষিতীশ রঞ্জন চট্টোপাধ্যায় চোখ মুছতে মুছতে বলে উঠলেন, ‘‘মুসুরির ডাল আর পুঁইশাকের লোভ দেখিয়েও বিষ্ণুদাকে আটকাতে পারলাম না। একটা সময় যার টানে জেসিটি-র মালিকের বিরাট অঙ্কের প্রস্তাব নাকচ করে ফিরে এসেছিলেন কলকাতায়। ওঁর থাপ্পড়, লাথি আর মারগুলো খুব মিস করব।’’

আসলে ক্ষিতীশবাবু কেন, ‘পকেট হারকিউলিস’-কে যে কেউ-ই আর বেঁধে রাখতে পারলেন না। রবিবার দুপুর আড়াইটে নাগাদ ১০৪ বছরের ষোলো আনা বাঙালিবাবু মনোহর আইচ মারা গেলেন বয়সজনিত কারণে। যে শরীরকে তিনি মন্দির হিসেবে দেখতেন, তাও দান করে গেলেন মানুষের কল্যাণে। মৃত্যুর পর বাড়ি থেকে তাঁর দেহ নিয়ে যাওয়া হয় আর জি কর হাসপাতালে। তার আগে নিয়ে যাওয়া হল তাঁর চোখও।

বিশ্বশ্রী চলে গেলেন ঠিকই। কিন্তু রেখে গেলেন অজস্র সোনালি ফ্রেমবন্দি করা স্মৃতি। বডি বিল্ডিংকে ভারতে সর্বোচ্চ শৃঙ্গে পৌঁছে দিয়েছিলেন তিনিই। তাঁর হাত ধরেই ‘পাওয়ার’ বডি বিল্ডিংয়ের জন্ম এই দেশে। মনোহর আইচের অন্যতম ছায়াসঙ্গী ক্ষিতীশবাবু বলছিলেন, ‘‘১৯৫৩ সাল থেকে ওঁর সঙ্গে আছি। বডি বিল্ডিং যে শুধু পেশি ফোলানো নয়, সেটা প্রথম বিষ্ণুদার থেকেই শিখি। বডি বিল্ডিং মানে শক্তি প্রদর্শনও। আর সেই শক্তিবৃদ্ধির জন্য খাবার-দাবারের দিকে বিশেষ নজর দিতেন উনি।’’

অবলীলায় সেঞ্চুরি হাঁকানোর পিছনেও মনোহরের ‘টপ সিক্রেট’ সেই খাদ্য-প্রণালি। মুসুরির ডাল আর পুঁইশাকের চচ্চড়ি তো বটেই, মাছের মুড়ো আর কচুর লতিও অসম্ভব ভালবাসতেন তিনি। তাঁর বেশ কিছু পুরনো ছাত্র বলছিলেন, ‘‘আমাদের সময় তো আর পেশি বাড়ানোর ইঞ্জেকশন ছিল না। তাই প্রাকৃতিক ভাবেই সেটা বাড়াতে হত। সেজন্য মাছের মুড়ো বেশি করে খেতেন মনোহরদা। মাছের মাথায় গ্রোথ হরমোন থাকে বলে।’’ পুরোদস্তুর বাঙালিয়ানা খাবারই বেশি পছন্দ করতেন বিশ্বশ্রী। এমনকী শেষ জীবনে কফি, চা, বিস্কুট ছাড়া সেই মাছের ঝোল আর ভাতই খেতেন। তবে পেস্ট করা।

বডি বিল্ডিংয়ের পরে খাবার তাঁর দ্বিতীয় পছন্দ হলে, তৃতীয় স্থানে অবশ্যই থাকবে তাঁর শহর কলকাতা। একটা সময় নাকি ইংল্যান্ডে থাকার প্রস্তাবও প্রত্যাখান করেছিলেন, শুধু এই শহরের জন্য। পরিবারের এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বলছিলেন, ‘‘উনি সব সময় বলতেন, কলকাতার মতো আবহাওয়া নাকি কোথাও নেই। এমনকী ইংল্যান্ডেও নেই। এখানকার পরিবেশ বডি বিল্ডারদের জন্য আদর্শ। তাই কখনও কলকাতা ছাড়ার কথা মাথাতেই আসেনি তাঁর।’’ এ দিন তাঁর প্রয়াণের খবর শুনে ছুটে আসেন ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী লক্ষ্মীরতন শুক্ল এবং বিধাননগরের বিধায়ক সুজিত বসু। সমবেদনা জানান রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও।


শেষ শ্রদ্ধা। মনোহর আইচের বাড়িতে লক্ষ্মীরতন শুক্ল। রবিবার। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস

‘বিশ্বশ্রী’ মনোহর আইচকে তো সবাই চেনেন। তবে তাঁর যে আরও একটা পরিচয় আছে, সেটা কি জানেন? শুনলে হয়তো আঁতকে উঠবেন অনেকে যে, তিনি এক সময় জেলও খেটেছিলেন! তবে চুরি, ডাকাতির জন্য অবশ্যই নয়। মনোহরের সাত বছরের জেল হয়েছিল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য। স্বাধীনতার আগে। তাঁর সবচেয়ে পুরনো ছাত্র ক্ষিতীশবাবু বলছিলেন, ‘‘কেউ হয়তো বিশ্বাস করবে না যে, উনি ৪ ফুট ১১ ইঞ্চি হয়েও র‌য়্যাল এয়ারফোর্সে কাজ করেছেন। কিন্তু বেশি দিন চাকরি করেননি। আসলে ওই সময় একটা নিয়ম ছিল। রাতে ব্রিটিশ অফিসারদের ডিনারের পর যে খাবার বাঁচত, সেটা সকালে ভারতীয় সৈনিকদের দেওয়া হত। আর বিষ্ণুদা সেটা খেতে শুধু অস্বীকার করেছিলেন তাই নয়, প্রতিবাদও করেছিলেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। যার ফলে সাত বছর সাজা হয় তাঁর।’’

যদিও চার বছরেই সেই সাজা শেষ হয়ে যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে। লাহৌর, পেশোয়ার হয়ে মনোহরের হাজতবাস শেষ হয় আলিপুর জেলে। তবে এই চার বছরের হাজতবাসের সময় বডি বিল্ডিংয়ের চর্চায় পুরোপুরি ডুবে যান মনোহর। মজার ব্যাপার হল, বডি বিল্ডিংয়ের প্রতি তাঁর ভালবাসা এবং নিষ্ঠা দেখে জেলের আধিকারিকরাও মনোহরের জন্য জেলে স্পেশ্যাল ডায়েট চালু করে দেন। কেন না মানুষ মনোহরকে কাছ থেকে দেখার পরে মুগ্ধ হন ব্রিটিশরাও। আর মনোহর? কঠোর পরিশ্রমের পুরস্কার জেল থেকে বেরোনোর পরেই হাতেনাতে চলে আসে। এক বছরের মধ্যে স্বাধীন ভারতে প্রথম মিস্টার ইউনিভার্সও হয়ে যান। তার পর একে একে আরও সাফল্য।

এখন সেই বাড়িটা আছে। ট্রফি, স্মারকও আছে। নেই শুধু বিশ্বশ্রী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Manohar Aich Pocket Hercules Mr Universe
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE