লড়াই: চলছে প্রশিক্ষণ। নিজস্ব চিত্র
সবুজ মাঠে ছোট ছোট পাস, লম্বা শট। কখনও বা ড্রিবলিংয়ের জাদু। মাঠে ছুটছে মেয়েরা। তাদের এক একটা শটে যেন মাদলের মাদকতা। বাংলার মেয়েদের ফুটবলে এখন দাপট দেখাচ্ছে জঙ্গলমহল বিশেষ করে পশ্চিম মেদিনীপুরের মেয়েরা।
বছর কয়েক আগেই রাজ্যের মহিলা ফুটবল মানচিত্রে ঢুকে পড়েছিল পশ্চিম মেদিনীপুর। সাঁকরাইল, নয়াগ্রাম, শালবনি, জামবনি থেকে একের পর এক মেয়ে ইতিমধ্যেই উঠে এসেছেন ফুটবল ময়দানে। মূলত জনসংযোগের লক্ষ্যে পুলিশ আয়োজিত জঙ্গলমহল কাপের হাত ধরে মেয়েদের ফুটবলের যে স্বপ্নবীজ বোনা শুরু হয়েছিল এখন সেটা ফল দিতে শুরু করেছে।
সম্প্রতি দিল্লিতে হয়ে গেল ‘খেলো ইন্ডিয়া স্কুল গেমস’ সেখানে বাংলার মেয়েদের ফুটবল দল যোগ দিয়েছিল। সেই দলে ছিল ঝাড়গ্রামের নয়াগ্রাম থানা বালিকা বিদ্যাপীঠের মুগলি হেমব্রম, তাপসি হেমব্রম ও সুষমা মুর্মু, জামবনির বাহিরাগ্রাম কে বি হাইস্কুলের মাধো হাঁসদা, পশ্চিম মেদিনীপুরের গৈতা হাইস্কুলের কৃষ্ণা সিংহ ও বর্ষা ঘোড়াই, দাঁতন বীণাপাণি বালিকা বিদ্যালয়ের লক্ষী মুর্মু। তাদের খেলা নজর কাড়ে সবার। জানুয়ারিতে উত্তরবঙ্গে আয়োজিত রাজ্য গেমসের ময়দানে মহিলা ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে এই জেলা।
কীভাবে তৈরি হচ্ছে ‘সাপ্লাই লাইন’?
ঝাড়গ্রাম জেলা গঠন হলেও এখনও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা বিদ্যালয় ক্রীড়া সংসদের মধ্যেই রয়েছে ঝাড়গ্রামের স্কুলগুলি। পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম জেলার কয়েকটি বিদ্যালয় মেয়েদের ফুটবল নিয়ে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে কাজ করে চলেছে। তাদের মধ্যে অন্যতম নয়াগ্রাম থানা বালিকা বিদ্যাপীঠ, গৈতা হাইস্কুল, দুধকুণ্ডি হাইস্কুল, বাহারিগ্রাম হাইস্কুল, শালবনি নিচুমঞ্জরী হাইস্কুল, দাঁতন বীণাপাণি বালিকা বিদ্যালয়।
নয়াগ্রাম থানা বালিকা বিদ্যাপীঠের মেয়েরা ২০১৩ সালে সুব্রত কাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। ২০১৪-১৬ রানার্স হয়েছে। ২০১৭ তেও তারা রাজ্য চ্যাম্পিয়ন। এই বিদ্যালয়ের বেশিরভাগ ছাত্রীই হস্টেলে থাকে। তাই তারা দলবদ্ধভাবে নিয়মিত অনুশীলনের সুযোগ পায়। যেটা বোঝাপড়া তৈরির অন্যতম অস্ত্র। ওই বিদ্যালয়ের ক্রীড়া শিক্ষিকা কাকলি চক্রবর্তী জানান, বিদ্যালয়ের নিজস্ব মাঠ নেই। তাই বিদ্যালয় সংলগ্ন মাঠে অনুশীলন হয়। তবে অনুশীলনে কোনও ফাঁকি নেই। বিদ্যালয়ের শিক্ষা কর্মীরা মেয়েদের প্রশিক্ষণ দেন। গত এক বছর ধরে মেদিনীপুর শহর থেকে একজন ফুটবল প্রশিক্ষক আসছেন। বিদ্যালয় থেকেই মেয়েদের ফুটবল সরঞ্জাম কিনে দেওয়া হয়। শারীরিক সক্ষমতা বাড়াতে ফুটবলারদের খাবারের তালিকাতেও বিশেষ নজর দেওয়া হয়। সকালে থাকে ছাতু, কলা, ডিম সেদ্ধ, ভেজানো ছোলা। দুপুরে ভাত, ডাল, আনাজ মাছ বা মাংস। বিকেলে ফল, দুধ বা হরলিক্স। টিভিতে গুরুত্বপূর্ণ ফুটবল ম্যাচের সম্প্রচার হলে সেটিও ছাত্রীদের দেখানো হয়। এই বিদ্যালয়ের মুগলি হেমব্রম, তাপসি হেমব্রম, সুষমা মুর্মু, তুলসি হেমব্রম, শ্রবণী সরেন, কাকলি হাঁসদা, খুকুমনি সিংহেরা ইতিমধ্যেই বাংলার মহিলা ফুটবলে উঠতি প্রতিভা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। তাদের অনেকেই বাংলার হয়েও খেলেছেন। মুগলি বলে, ‘‘২০১১ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলাম। তখন থেকেই দু’বেলা ফুটবলের অনুশীলন করি।’’
নারায়ণগড় ব্লকের গৈতা হাইস্কুল ২০১৫ ও ২০১৭ সালে সুব্রত কাপে জেলা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এই বিদ্যালয়ের ছাত্রী কৃষ্ণা সিংহ, কুহেলি রক্ষিত, মৌমিতা দারা, সুপ্রিয়া রাউলরা ফুটবল নিয়ে রীতিমতো ভাবেন। প্রধান শিক্ষক অনাদি নন্দন রায় জানান, এই বিদ্যালয়ে ছাত্রীবাস নেই। তাই ফুটবলের অনুশীলন হয় ছুটির পরে।
সাতের দশকে বাংলার ফুটবলে মেয়েদের বেশি করে আসা শুরু। তখন বাংলার রাজনীতিতে ছিল উত্তাল সময়। ফুটবল গবেষকেরা মনে করেন, উত্তাল রাজনীতির টালমাটাল অবস্থা থেকে বাঁচতেই তখন ফুটবলকেই আশ্রয় করেছিলেন মেয়েরা। জঙ্গলমহলের ক্ষেত্রেও কিন্তু মেয়েদের ফুটবল মাঠে আসার পিছনে নির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। দুভার্গ্যজনক হলেও এটা সত্যি যে জঙ্গলমহলের বিভিন্ন এলাকায় এখনও কুসংস্কারই শেষ কথা বলে। মেয়েদের ক্ষেত্রে নানা বিধিনিষেধ রয়েছে। সেখানে ফুটবল যেন মেয়েদের কাছে প্রতিবাদের হাতিয়ার। এক-একটি সাফল্যর সঙ্গে সেই বার্তা আরও দৃঢ় হচ্ছে।
তবে পথ মোটেও গোলাপ বিছানো নয়, কাঁটাই বেশি। জঙ্গলমহলের একাধিক ক্রীড়া শিক্ষিকার আক্ষেপ, অনূর্ধ্ব ১৪ খেলার পরে অনেকেই মাঠে আসছেন না। আবার মেয়েদের ফুটবল অনুশীলনের পরিকাঠামোও সেভাবে গড়ে ওঠেনি। পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রামের বেশিরভাগ স্কুলের তো নিজেদের খেলার মাঠই নেই। ফুটবল অনুশীলনের জন্য অন্য সংস্থার ভরসায় থাকতে হয়। কোথাও আবার মাঠ থাকলেও পাঁচিল নেই। তাই বল বেরিয়ে যায় বার বার। মূলত জঙ্গলমহলের মেয়েদের ফুটবলের উন্নতির জন্যই ২০১২ সালে শালবনি জাগরণ ফুটবল কোচিং সেন্টার তৈরি হয়েছিল। এখন শালবনি, চন্দ্রকোনা, গোয়ালতোড়, গড়বেতার বিভিন্ন বিদ্যালয় ও কলেজের মেয়েরা ফুটবল প্রশিক্ষণ নিতে আসেন। সেই সংস্থার সম্পাদক সন্দীপ সিংহের মতে, ‘‘এখন সাফল্য মিলছে। কিন্ত তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হলে শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরও আরও এগিয়ে আসতে হবে।’’ পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা বিদ্যালয় ক্রীড়া সংসদের সাধারণ সম্পাদক সোমনাথ দাসের ক্ষোভ, ‘‘জেলায় জুনিয়র, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক মিলিয়ে ১২৭৮ টি স্কুল রয়েছে। সেখানে হাতেগোনা ৭-৮ টি বিদ্যালয়ের মেয়েরা ফুটবল খেলছে। বাকি স্কুলগুলি কী করছে?’’
শান্তি মল্লিক, কুন্তলা ঘোষ দস্তিদার, মিনতি রায়, আলপনা শীলদের মতো কয়েকটি নাম বাদ দিলে বাংলার মেয়েদের ফুটবলে মনে রাখার মতো নাম তেমন নেই। কলকাতায় মহিলা ফুটবল লিগ চলে বটে, কিন্তু তার খবরই বা ক’জন রাখে? এই পরিস্থিতিতে পশ্চিম মেদিনীপুর কি আদৌও পথ দেখাতে পারবে? কাঁটা থাকলেও আশাটা আস্তে আস্তে বাড়ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy