Advertisement
E-Paper

সঞ্জয় এখন বাড়িতে বসেও জেতাচ্ছেন

মাটিতে শুয়ে পড়া ওডাফাকে দেখে মনে হচ্ছিল, আকাশ থেকে ভোকাট্টা হয়ে পড়া ঘুড়ি। কোথায় সেই আগুনে ফুটবল! ড্রিবল করতে গিয়ে দুবলাপাতলা কিংশুক বা নবাগত প্রণয়ের পায়েও হুমড়ি খাচ্ছেন। থাবা বসিয়েছে বয়স, তাই ইচ্ছে থাকলেও শরীর চলছে না। গোটা ম্যাচে মাত্র তিন বার স্ট্রাইকিং জোন থেকে নীচে নেমে কষ্ট করে বল ধরেছেন। গ্যালারি থেকে ‘গো ব্যাক ওডাফা’ স্লোগান উঠছে।

রতন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৩:৩৫
বারাসতে আলো ও অন্ধকার। শনিবারের কাতসুমি, ওডাফা। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস

বারাসতে আলো ও অন্ধকার। শনিবারের কাতসুমি, ওডাফা। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস

মাটিতে শুয়ে পড়া ওডাফাকে দেখে মনে হচ্ছিল, আকাশ থেকে ভোকাট্টা হয়ে পড়া ঘুড়ি।

কোথায় সেই আগুনে ফুটবল! ড্রিবল করতে গিয়ে দুবলাপাতলা কিংশুক বা নবাগত প্রণয়ের পায়েও হুমড়ি খাচ্ছেন। থাবা বসিয়েছে বয়স, তাই ইচ্ছে থাকলেও শরীর চলছে না। গোটা ম্যাচে মাত্র তিন বার স্ট্রাইকিং জোন থেকে নীচে নেমে কষ্ট করে বল ধরেছেন। গ্যালারি থেকে ‘গো ব্যাক ওডাফা’ স্লোগান উঠছে। কলকাতায় এসে এরকম পরিবেশ সম্ভবত আগে কখনও দেখেননি কিং কোবরা। মাটিতে শুয়ে পড়াই তো স্বাভাবিক। তাঁর ‘রাজার টুপি’-ই যে এ দিন বারাসতে টেনে খুলে নিল বাগান! অনায়াসে। নিখুঁত অঙ্কে।

ম্যাচ শেষে মনে হচ্ছিল, বিপক্ষের বৃদ্ধ নাইজিরিয়ান সিংহকে নিয়ে একটু বেশিই যেন কেঁপেছিল মোহনবাগান টিম ম্যানেজমেন্ট। সম্ভবত সে জন্য কাতসুমির উড়ন্ত চুমু কাঁচ ঢাকা ভিভিআইপি বক্সে বসা তাঁর বান্ধবীর কাছে পৌঁছতে লেগে গেল ৭২ মিনিট! এবং এটা ঠিক, ওডাফা-জুজুতে অযথা আক্রান্ত না হলে আই লিগের প্রথম পর্ব শেষে শৃঙ্গে পাতা চেয়ারটা আরও শক্তপোক্ত করতে এ দিন এতক্ষণ সময়ও লাগত না সঞ্জয়-ব্রিগেডের। ৮ ম্যাচে ১৮। আকাশে পূর্ণিমার জ্বলজ্বলে চাঁদের আলো কুয়াশা ভেদ করে আলতো নামছিল শনি-সন্ধের বারাসত স্টেডিয়ামে। তবু তাতেও কী চকচকে দেখাচ্ছিল সনি নর্ডি-জেজে-কিংশুকদের মুখগুলো! সেই মায়াবী আলোয় হাঁটতে হাঁটতে সনির মুখ থেকে বেরোল ‘‘এই জয়টা আমাদের কাছে খুবই মূল্যবান। আমরা যে কামব্যাক করতে পারি প্রমাণিত। চ্যাম্পিয়ন হতে এ ভাবেই ম্যাচ বাই ম্যাচ এগোতে হবে আমাদের।’’

লিগের মজাই হল, যে টিম চাপের মুখেও স্থিতধী হয়ে কামব্যাক করতে পারবে ট্রফি তার-ই। বাগানে এই অদৃশ্য প্ল্যাকার্ড যিনি সব সময় ঝুলিয়ে রাখেন সেই সঞ্জয় সেন অসুস্থ। মাঠেই আসতে পারেননি সনিদের কোচ। আঠারো বছর কোচিং করাচ্ছেন। জীবনে প্রথম বার টিম খেলছে আর তিনি কোচ হয়েও বাড়িতে। কথা বলতেই কষ্ট হচ্ছে। তীব্র কাশি, সঙ্গে ধুম জ্বর। কোনও রকমে ফোনে বললেন, ‘‘এ তো দেখলাম, মাঠে থাকার চেয়েও বেশি টেনশন! এর চেয়ে মাঠে অ্যাম্বুলেন্সে বসে খেলা দেখলে মনে হয় ভাল হত। টিভিতে খেলা দেখার সময় টেনশনে শরীর আরও খারাপ লাগছিল।’’

আই লিগের নিয়মে ম্যাচের আগে কোচ-ফুটবলারদের মোবাইল জমা রাখতে হয়। ফলে এ দিনের বাগান কোচ শঙ্করলাল চক্রবর্তীর সঙ্গে ক্লাবের ফুটবল বিভাগের এক কর্তার ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখছিলেন সঞ্জয়। গোলশূন্য হাফটাইমেও চেতলা থেকে বারাসতের বাগান ড্রেসিংরুমে প্রয়োজনীয় নির্দেশ এল সেই ফোনে। ম্যাচ শেষে ‘ধন্যবাদ’ও। পরে ফোনে চেতলার বাড়ি থেকে সঞ্জয় বললেন, ‘‘ওডাফা কিছু করতে পারবে না জানতাম। আমার ডিফেন্স ওকে ‘হোল’ তৈরি করতেই দেয়নি। অত বড় স্ট্রাইকার একটা-দু’টো সুযোগ তো পাবেই!’’ উচ্ছ্বাস না কটাক্ষ ঠিক বোঝা গেল না।

শেষ তিন ম্যাচে স্পোর্টিং অপরাজিত থেকে এখানে খেলতে এসেছিল। ওডাফার পায়ে ছিল চার গোল। লিগ টেবলে পিছন থেকে বিপজ্জনকভাবে উঠে আসছিল গোয়ান ক্লাব। এহেন বিপক্ষকে থামাতে এ দিনের কোচ শঙ্করলাল আসল অস্ত্র প্রয়োগ করলেন অনেক পরে। চোট পেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ব্র্যান্ডনের জায়গায় শৌভিককে মাঝমাঠে নামানোর পরেই বাগানে বসন্ত এল। মাঝমাঠ থেকে কাতসুমি সরে গেলেন ডানদিকে। সনি আর কাতসুমি দুই প্রান্তে ডানা ঝাপ্টাতেই ওডাফার দল টলমল। প্রথমার্ধেই দু’-দুটো গোললাইন সেভ করে নিশ্চিত পতন রুখেছিলেন স্পোর্টিং স্টপার লভডে। গোয়ার ক্লাবের পোস্টেও একবার বল ধাক্কা খেল। তখন শুধু আগুনে ছিলেন সনি। দ্বিতীয়ার্ধে কাতসুমি তাঁর দোসর হতেই কাঙ্খিত গোল। যে গোলের শুরু সনিতে। মাঝে জেজে বলটা বুকে নামিয়ে দিতেই জাপানি বোমা আছড়ে পড়ল স্পোর্টিং ক্লুবের জালে।

স্পোর্টিংয়ের এই টিমটা যেন বাগানের অ্যালামনি! ও়ডাফা, ডেনশন, মেহরাজ, অরিন্দম, রাভানন— সবাই বাগানের প্রাক্তনী। তাঁদের একটা জেদ এই ম্যাচে কাজ করবে আশা করা গিয়েছিল। কিন্ত সে ভাবে কেউ চোখে পড়লেন কই? ওডাফার মতোই নিষ্প্রভ বাকিরাও। নাইজিরিয়ান স্ট্রাইকার চেঁচাচ্ছিলেন ম্যাচের পর। নব্বই মিনিটে গোটা তিরিশ বল এসেছে তাঁর কাছে। দু’টো গোলের সুযোগও পেয়েছেন। কিছুই করতে পারেননি। ম্যাচ শেষে হতাশ গলায় বলে গেলেন, ‘‘গোলের সুযোগ নষ্ট করাতেই হারলাম।’’ সনিকে কেমন দেখলেন? প্রশ্ন আসতেই ‘বাই’ বলে হাঁটা লাগালেন ওডাফা।

তাঁর টিমবাসে ওঠার এত দ্রুততা কেন? বোঝা গেল পিছন ফিরে তাকাতেই। বাধ্যতামূলক ‘র‌্যান্ডম’ ডোপ টেস্ট দিতে যাওয়া কাতসুমির পিছনে যে তখন কয়েকশো সবুজ-মেরুন সমর্থকের মিছিল। সনিকে ঘিরে তীব্র ‘জয় হো’! কিংশুক-বলবন্তদের দিকে নাগাড়ে ছোড়া চলছে সবুজ আবির। স্টেডিয়ামের গেটের সামনের অস্থায়ী ফেন্সিং ভেঙে পড়েছে হুড়মুড় করে। কর্তব্যরত পুলিশও সেলফি তুলতে ব্যস্ত। কে সামলাবে উচ্ছ্বাস? দিন তিনেক আগে শিলং লাজং ম্যাচ ড্র করায় যা করা যায়নি, সেই জমে থাকা আবেগ উড়িয়ে ফের জয়ডঙ্কা বাজানোর উৎসব যেন।

ওডাফা-বধ সাঙ্গ। আই লিগের প্রথম পর্ব শেষে শৃঙ্গ মুঠোয়। ফের খেতাব জয়ের চওড়া সরণিতে পা। অপরাজিত থাকার গৌরবও অটুট। তবু বাগানে পুরো স্বস্তি নেই যেন। এত ‘আলো আমার আলো’র মধ্যেও আশঙ্কার চোরাস্রোত। সামনের সপ্তাহে গোয়ায় টানা দু’টো অ্যাওয়ে ম্যাচ। যার প্রথমটা সালগাওকরের বিরুদ্ধে, সেই গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচেই আবার নেই বাগান ডিফেন্সের দুই স্তম্ভ—লুসিয়ানো আর প্রণয় হালদার। দু’জনেরই কার্ড সমস্যা। বিপদে পড়লেন তো? কোচের অনুপস্থিতিতে সহকারী শঙ্করলাল বললেন, ‘‘আমাদের হাতে অনেক বিকল্প আছে। ভাবছি না।’’ বারাসতে বসে শঙ্করলাল যা বললেন, চেতলা থেকে সেটারই প্রতিধ্বনী এল সঞ্জয়ের মুখ থেকেও।

বাগান যদি আই লিগ ‘ডাবল’ করতে পারে তা হলে ফুটবলার-কোচের সঙ্গে-সঙ্গে ক্লাব কর্তারাও সমান কৃতিত্ব পাবেন। স্পনসর সমস্যার মধ্যেও সোনার টিমের সঙ্গে সোনালি বেঞ্চ তৈরির জন্য। বাগানে ফুল ফোটার আসল রসায়ন যে এটাই!

মোহনবাগান: দেবজিৎ, রাজু, কিংশুক, লুসিয়ানো, ধনচন্দ্র, কাতসুমি, ব্র্যান্ডন (শৌভিক), প্রণয়, সনি, জেজে, কর্নেল (বলবন্ত)।

MostReadStories
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy