গোল শোধের পর উচ্ছ্বাস। ৮৮ মিনিটে খাদের কিনার থেকে নেদারল্যান্ডসকে টেনে তুললেন স্নেইডার। এর পর জয় এল ইনজুরি টাইমের পেনাল্টিতে। মেক্সিকোর বিরুদ্ধে রবিবার। ছবি: এএফপি
ব্রাজিলের যে শহরে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যেতে-যেতে প্রায় ফিনিস্ক পাখির মতো বেঁচে উঠল নেদারল্যান্ডস, সেই ফোর্তালেজার সঙ্গে ডাচদের বহু বছরের সম্পর্ক। এমনকী, জায়গাটার নামটাও ওলন্দাজদেরই দেওয়া। ৩৬০ বছর আগে। আসলে ফোর্তালেজাকে নিজেদের উপনিবেশ বানানোর মতলব ছিল ডাচদের। কিন্তু মাত্র তিরিশ বছর পরেই তারা উৎখাত হয়েছিল সেখান থেকে। রবিবার ফোর্তালেজার মাঠে যেন তার ‘পোয়েটিক জাস্টিস’ পেল ডাচরা।
এবং কী নাটকীয় ভাবেই না! ৮৮ মিনিট অবধি ‘মেক্সিকান ওয়েভ’-এর হাতে ‘উৎখাত’ হতে-হতে খেলা শেষের মাত্র দু’মিনিট আগে স্নেইডারের অসম্ভব ভাল একটা গোলে সমতায় ফেরে নেদারল্যান্ডস। একটা লুজ বলকে দারুণ ভাবে অনুসরণ করে পেনাল্টি বক্সের মাথা থেকে গোলার মতো শটে গোল। নিঃসন্দেহে এ বারের বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা। ওচোয়ার মতো গোলকিপারও নড়ার সুযোগ পায়নি। তার পর ইনজুরি সময়ের দু’মিনিটে (ম্যাচের ৯২ মিনিট) রবেনের পেনাল্টি এনে দেওয়া দলকে। পরিষ্কার পেনাল্টি। বক্সের মধ্যে রবেনের সামনে যখন বল, তখন ওকে ল্যাং মেরেছিল মেক্সিকো অধিনায়ক রাফায়েল মার্কুইজ। চার বার বিশ্বকাপে মেক্সিকোর অধিনায়ক, এ দিনও দলের রক্ষণকে দুর্দান্ত নেতৃত্ব দিল। কিন্তু ওই এক ল্যাং ওকে খলনায়ক বানিয়ে দিল দেশবাসীর কাছে। বেচারা! রবেনরা প্রথমার্ধেও একটা পেনাল্টির দাবি করেছিল রেফারির কাছে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে বক্সের মধ্যে হলেও বল ছিল রবেনের পিছনের দিকে। বরং বলটাকে খাবলে সামনে আনতে গিয়ে নিজেই পড়ে যায় ও। খেলার প্রায় শেষ মুহূর্তে পাওয়া পেনাল্টি থেকে গোল করতে কিন্তু ভুল করেনি হুন্টেলার। ঠান্ডা মাথায় গোল করে শেষ আটে নিয়ে গেল দলকে। ম্যাচের বয়স তখন ৯৪ মিনিট! খানিকটা ঝুঁকি নিয়েই ফর্মে থাকা ডাচ অধিনায়ক ফান পার্সির জায়গায় হুন্টেলারকে নামিয়েছিলেন ডাচ কোচ লুই ফান গল।
শুধু এই একটা সিদ্ধান্তই নয়, আমার মতে রবিবার ডাচদের নাটকীয় জয়ের অদৃশ্য নায়ক কোচ-ই। ৪৮ মিনিটে ভ্লার ভুল হেড থেকে বল পেয়ে দস সান্তোস মেক্সিকোকে এগিয়ে দেওয়ার পরপরই তিনি ডিফেন্ডার ভেরহার্টকে বসিয়ে তার বদলে মেম্ফিস দেপে-কে নামিয়ে লেফট উইং করে দেন। আর ভেরহার্টের জায়গায় রাইট ব্যাক করে দেন কাউটকে। একেবারে সঠিক আর অব্যর্থ ট্যাকটিক্যাল পরিবর্তন। এর পরই রবেন-দেপে দুই উইং দিয়েই আক্রমণ তুলে খেলাটাকে ছড়িয়ে দিতে থাকে। আর এতক্ষণ দুর্দান্ত সংগঠিত দেখানো মেক্সিকান ডিফেন্সেও ফাঁকফোকর দেখা দিতে থাকে। ওচোয়া এই সময় দে ভ্রিজ, রবেন, হুন্টেলারের থেকে অন্তত তিনটে সেভ না করলে (এমনকী একটা অফসাইড-আক্রমণও সেভ করেছে মেক্সিকোর তারকা গোলকিপার) নেদারল্যান্ডস আগেই গোল পেয়ে যেত।
মেক্সিকো কোচ মিগুয়েল হেরেরার ‘টুইটার ফলোয়ার’-এর সংখ্যা নাকি ৮০ লাখ! বিশ্বকাপের বত্রিশ কোচের মধ্যে সর্বাধিক। রবিবার আর একটু হলে সবচেয়ে ট্যাকটিশিয়ান কোচ হিসেবেও গণ্য হয়ে যেতেন। যে ভাবে পাঁচ জন মিডফিল্ডার রেখে শুরু থেকেই হেভিওয়েট নেদারল্যান্ডসের হাত থেকে মাঝমাঠের দখল নিয়ে ফেলেছিলেন! প্রথম পঁয়তাল্লিশ মিনিট ফান পার্সিকে একবার ছাড়া খুঁজে পাওয়া যায়নি। রবেন যে রবেন, সে-ও বিপক্ষের ডাবল কভারিংয়ের জাঁতাকলে পড়ে তখন কেমন যেন ফ্যাকাসে! যখনই বল ধরছিল, দ্বিতীয় ট্যাকলে ওর পা থেকে বল কেড়ে নিচ্ছিল মেক্সিকানরা। একমাত্র কাউট-কে ‘ওয়ার্ক হর্স’ দেখাচ্ছিল। কিন্তু ডাচদের সব আক্রমণই ছিল ডানপন্থী। ফলে মেক্সিকো রক্ষণের সুবিধে হয়ে যাচ্ছিল একবগ্গা আক্রমণগুলো সামলাতে। দ্বিতীয়ার্ধে আক্রমণ বদলে ফেলল ডাচরা। দুই উইং দিয়ে মেক্সিকো রক্ষণে হানা দিতে শুরু করল দেপে-রবেন। ফলে প্রথমার্ধে হেরেরা, পেরালতা যত নিশ্চিন্তে ঘনঘন ডাচ অ্যাটাকিং থার্ডে উঠছিল, দ্বিতীয়ার্ধে এক গোলে এগিয়ে যাওয়ার পরেও সেটা করতে সাহস পায়নি। তা ছাড়া গোল পাওয়ার পর মেক্সিকান কোচ যেন বাড়তি ডিফেন্সিভ হয়ে পড়েছিলেন। গোলস্কোরার দস সান্তোসের মতো ফরোর্য়াডকে বসিয়ে আকুইনোর মতো ডিফেন্সিভ মিডিও নামানোর মধ্যেই মেক্সিকো কোচের সেই অত্যধিক ডিফেন্সিভ প্রবণতাটা স্পষ্ট।
ম্যাচটা আসলে ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী অ্যাটাকিং লাইনের সঙ্গে সবচেয়ে সংগঠিত ডিফেন্সের। নেদারল্যান্ডস তিন ম্যাচে ১০ গোল করে থাকলে মেক্সিকো তিন ম্যাচে মাত্র এক গোল খেয়ে এই ম্যাচটা খেলতে নেমেছিল। কিন্তু প্রথমার্ধটা মেক্সিকান কোচের মগজাস্ত্রের জোরে যেমন তাঁর দলকে বেশি আক্রমণাত্মক দেখাচ্ছিল, তেমনই ডাচ কোচের পাল্টা গেমপ্ল্যানিংয়ে শেষ আধ ঘণ্টা মেক্সিকোর জমাট রক্ষণকে নড়বড়ে দেখিয়েছে। ফুটবলের বৃহত্তম মঞ্চে এমন উলটপুরাণ ঘটাতে পারেন সত্যিকারের বড় কোচেরাই। ফান গল তেমনই এক জন ধুরন্ধর কোচ। ফান পার্সিদের দেশজ কোচের ট্যাকটিক্যাল দক্ষতা দেখে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডও নিশ্চয়ই এ দিন খুশি হবে। বিশ্বকাপের পরেই যে ফান গল ম্যান ইউয়ের চাকরিতে যোগ দিচ্ছেন।
তার আগে এ দিন রাতে ফোর্তালেজার সমুদ্রসৈকতে ‘হলান্ডেস ভোয়াদর’ লেখা গোটাকয়েক বার-এর কোনও একটায় ফান গল-রবিন ফান পার্সিদের জয়োৎসব করতে দেখলে বোধহয় অবাক হওয়ার নেই! ফোর্তালেজার ওই বারগুলোর নামের ইংরেজি অর্থ ‘দ্য ফ্লাইং ডাচম্যান’। মেক্সিকো ম্যাচের শেষ আধ ঘণ্টা ঠিক যেমনটা ছিল ফান গলের টিম!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy