Advertisement
E-Paper

স্যর মার্টিন, আপনি তো দারুণ খেলছেন

ঠিক চব্বিশ ঘণ্টা আগে অদ্ভূত ভাবে মার্টিন ক্রো-র কথা উঠল পাক ম্যানেজমেন্ট টিমে একজনের সঙ্গে আলোচনায়। ভদ্রলোক বলছিলেন, ভাল অধিনায়ক হতে গেলে ভাগ্য লাগে। যেটা শাহিদ আফ্রিদির একদম নেই। ইমরান খানের আছে। লাক-এর নমুনা কী? না বিরানব্বই বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে চোট পেয়ে মার্টিন ক্রো-র বেরিয়ে যাওয়া।

গৌতম ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০১৬ ০৩:০৫

জন্ম ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৬২

মৃত্যু ৩ মার্চ ২০১৬

ঠিক চব্বিশ ঘণ্টা আগে অদ্ভূত ভাবে মার্টিন ক্রো-র কথা উঠল পাক ম্যানেজমেন্ট টিমে একজনের সঙ্গে আলোচনায়।

ভদ্রলোক বলছিলেন, ভাল অধিনায়ক হতে গেলে ভাগ্য লাগে। যেটা শাহিদ আফ্রিদির একদম নেই। ইমরান খানের আছে। লাক-এর নমুনা কী? না বিরানব্বই বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে চোট পেয়ে মার্টিন ক্রো-র বেরিয়ে যাওয়া।

অকল্যান্ডের সেই সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডের সর্বোচ্চ স্কোরার ছিলেন ক্রো। রান আউট হয়ে যান ৯১ করে। পায়ে চোট পাওয়ায় পাকিস্তান ইনিংসে অধিনায়কত্ব করতে পারেননি। জন রাইটের ওপর দায়িত্ব ছেড়ে যান। যিনি নিছক ব্যাকরণ মানা ক্যাপ্টেন। এ-র পর বি। বি-র পর সি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটমহলে চব্বিশ বছর পরেও অনেকের স্থির বিশ্বাস, ক্রো মাঠে থাকলে ইনজামামের বিধ্বংসী ইনিংস থামানো যেত। ইনজামামের ৩৭ বলে ৬০ রানের ইনিংস সে দিন পাকিস্তানকে নিশ্চিত হারের মুখ থেকে বিশ্বকাপ ফাইনালে তুলে দেয়। অনেকে যেমন মনে করেন, ইনজামামের ওই আগ্রাসন সে দিন কারও পক্ষেই থামানো সম্ভব ছিল না। তেমনি অনেকের আজও মনে হয়, ক্রো অনের দিকে এমন কিছু অভিনব ফিল্ড অ্যাডজাস্টমেন্ট করতেন যে ইনজামামের এত সহজে পুল মারা হত না।

ইনি মাস্টার স্ট্র্যাটেজিস্ট ক্রো। যাঁর ৫৩ বছর বয়সে লিম্ফোমা-তে মারা যাওয়ার প্রশ্ন নেই। ইনি এক যুগন্ধর অধিনায়ক যিনি ক্রিকেট বিজ্ঞানে অমর থেকে যাবেন স্লো বোলিং দিয়ে ওয়ান ডে ক্রিকেটে ইনিংস শুরু করানোর পথিকৃত হিসেবে। আবার ওয়ান ডে ওপেনিং মানে পাওয়ার হিটিং এটাও গ্রেটব্যাচের মাধ্যমে প্রথম আনুষ্ঠানিক ভাবে চালু করেন মার্টিন ক্রো।

সেই সময় উপমহাদেশ আর অস্ট্রেলিয়া— দুটো আলাদা নিয়মে ওয়ান ডে খেলা হত। ভারত-পাকিস্তানে তিরিশ গজি বৃত্তের মধ্যে সব সময় চারজন করে রাখতে হত। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম ১৫ ওভারে তিরিশ গজি বৃত্তের বাইরে থাকত দু’জন করে। ওই দু’জন বাইরে থাকার সুযোগ নিয়ে কী উদ্ভাবন দেখানো যায় তা নিয়ে ভাবার সুযোগ তো এত অধিনায়ক পেয়েছিলেন। বর্ডার, টেলর, লয়েড, কপিল, রিচার্ডস, গাওয়ার।

ইতিহাস জ্বলন্ত সাক্ষী যে কারও মাথা থেকে কোনও অভিনবত্ব বার হয়নি। ক্রো কিন্তু একটা গ্রেটব্যাচ দাঁড় করিয়ে দেন। যার টুকলি সেই বিশ্বকাপেই ইংল্যান্ড করতে গেছিল ইয়ান বোথামকে ওপেনার নিয়ে এসে। লাভ হয়নি। কিন্তু সফল অনুকরণ হল পরের বিশ্বকাপে যখন লঙ্কা একই কাজ করল জয়সূর্যকে দিয়ে।

উইজডেন গত পঞ্চাশ বছরে ক্রিকেটার হিসেবে সবচেয়ে প্রভাবশালী এই চারজনকে বেছেছিল— সোবার্স, ওয়ার্ন, সচিন, ভিভ।

প্রভাব বলতে যদি নিছক মাঠের পারফরম্যান্সের প্রভাব হয় তা হলে তালিকাটা একমাত্র গ্রাহ্য। গোটা খেলার ওপর প্রভাব বাছতে গেলে তালিকাটা হওয়া উচিত— ক্লাইভ লয়েড, স্টিভ ওয়, ইমরান খান এবং মার্টিন ক্রো।

ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্টে তাঁর গড় ৪৫। ওয়ান ডে-তে ৩৮। ওটা আধুনিক ফাস্ট বোলার-মুক্ত যুগে অন্তত দশ যোগ হয়ে দাঁড়াবে ৫৫ আর ৪৮। ফাস্ট বোলার অধ্যুষিত জঙ্গলে টেস্ট ব্যাটসম্যানের কঠিন সময় ছিল ১৯৮৫-১৯৯১। এই সময়ের মধ্যে ক্রো ১৭ সেঞ্চুরি করেছিলেন। যা ওই সময় আর কেউ করেনি। এত রানও না। ক্রিকেটের বিখ্যাত ‘টু ডব্লিউ’ বারবার বলেন তাঁদের সবচেয়ে ভাল খেলেছেন মার্টিন ক্রো।

বিষ্যুৎবারের বারবেলায় প্র্যাকটিসে বার হওয়ার আগে ওয়াকার ইউনিস এক নাগাড়ে বলে যাচ্ছিলেন, ‘‘ওই সময়টা আমাকে আর ওয়াসিমকে বিশ্বে কেউ খেলতে পারেনি। ব্যাটসম্যান ৬০-৭০ করলে আমরা অবাক হয়ে যেতাম, হলটা কী? অথচ ক্রো লাহৌর টেস্টে যে সেঞ্চুরি করেছিল বোলার হয়েও ভুলিনি। এর পর করাচির ওই ট্র্যাকে পুরনো বল বাঁই-বাঁই করে ঘুরছে, সেখানে করল ৭০-এর কাছাকাছি।’’ সাফল্যের রহস্যটাও খুঁজে পেয়েছিলেন ওয়াকাররা, ‘‘অন্যদের সঙ্গে ওর তফাত ছিল। সবাই রিভার্স করার আগে আমাদের খেলত। এমন কী সচিনও ফ্রন্টফুটে আসত। মার্টিন ক্রো সুইংটা ভাঙলে খেলত ছোট ব্যাকলিফ্টে। আমি আর ওয়াসিম ওকে সবচেয়ে সমীহ করতাম কারণ ব্যাটসম্যান পেছনে খেললেই আমাদের সমস্যা।’’

কোথায় অকল্যান্ডের ধারে সমাধিস্থ হবে ক্রোর শরীর। কোথায় ঢাকা! ১১০৮৯ কিমি দূরে। তবু ওয়াকারের কথা শুনে মনে হল, পরম শ্রদ্ধায় সেরা প্রতিদ্বন্দ্বীর দেহের পাশেই তিনি দাঁড়ানো। নীরব কুর্নিশে হাত ওপর।

নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের ভ্রাম্যমান ব্র্যান্ড অ্যাম্বাস্যাডর বলতে আজও রিচার্ড হ্যাডলি! কিন্তু হ্যাডলি শুধু শো-কেসের দুর্ধর্ষ পরিসংখ্যান। টেস্ট বোলারের রোল মডেল। কিন্তু তিনি নিছকই পারফর্মার। সফল আজ্ঞা বহনকারী। নির্দেশক নন। তাঁর প্রভাব আউট সুইং ছাড়িয়ে সামগ্রিক ক্রিকেটের উপর তাই পড়ার নয়।

ক্রো হয়তো হ্যাডলির মতো নাইটহুড পাননি। কিন্তু সর্বাঙ্গীণ ব্যাপ্তিতে ছিলেন ক্রিকেটের এক স্যর। অবসরের পরেও উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা চালিয়ে গিয়েছেন। তাঁর প্রফেসর শঙ্কুগিরি ব্যাট তুলে রাখার সঙ্গে মোটেও লোপ পায়নি।

ক্রো ছিলেন আধুনিক ক্রিকেটের সেরা উদ্ভাবক। বহু বছর আগে পারথ টেস্টে তাঁর বিশেষ শট নির্বাচন এবং বাকি সিরিজে সেটা একবারও না খেলা ইয়ান চ্যাপেলকে কেমন মুগ্ধ করেছিল, এ দিনও রোমন্থন করছিলেন। ক্রো তাই নিছক নিউজিল্যান্ডের সেরা ব্যাটসম্যান নন। ক্রিকেট স্ট্যাটস নিয়ে তাঁকে মাপতে যাওয়াটাই মারাত্মক মূর্খামি।

যত দিন ক্রিকেটে উদ্ভাবন থাকবে। স্পিনার দিয়ে শুরু হবে প্রথম ওভার। পাওয়ার হিটার শুরু থেকে চালাবে। করাচির ধুলোর মধ্যে পুরনো বলে কেউ সুইং ভাঙার পর খেলবে তত দিন মার্টিন ক্রো-কে মেরে ফেলে কার সাধ্যি? তত দিনে হয়তো তাঁর বয়স হবে ১৫৩। হোক না, ক্ষতি কী?

ওয়েল প্লেড স্যর মার্টিন। ধুর, ভুল। ভুল।

স্যর মার্টিন, আপনি তো দারুণ খেলছেন!

Martin Crowe cricket death New Zealand legend
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy