Advertisement
E-Paper

বাদলদার টেস্ট খেলা উচিত ছিল

সারা জীবনে একবারই তাঁর কথা অমান্য করেছি। সেটা ১৯৭১-৭২ মরসুম। ইডেনে রঞ্জি সেমিফাইনালে বাংলা-হায়দরাবাদ ম্যাচ। আমি বাংলার ক্যাপ্টেন। ওদের উইকেটকিপার কৃষ্ণমূর্তি আউট হচ্ছে না।

চুনী গোস্বামী

শেষ আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:১৭
প্রাক্তন রঞ্জি অধিনায়ক পুণ্যব্রত দত্তকে শেষ শ্রদ্ধা সিএবি কোষাধ্যক্ষ বিশ্বরূপ দে-র। শনিবার। -শঙ্কর নাগ দাস

প্রাক্তন রঞ্জি অধিনায়ক পুণ্যব্রত দত্তকে শেষ শ্রদ্ধা সিএবি কোষাধ্যক্ষ বিশ্বরূপ দে-র। শনিবার। -শঙ্কর নাগ দাস

সারা জীবনে একবারই তাঁর কথা অমান্য করেছি। সেটা ১৯৭১-৭২ মরসুম। ইডেনে রঞ্জি সেমিফাইনালে বাংলা-হায়দরাবাদ ম্যাচ। আমি বাংলার ক্যাপ্টেন। ওদের উইকেটকিপার কৃষ্ণমূর্তি আউট হচ্ছে না। হঠাৎ মাঠে একটা চিরকূট এল। তাতে লেখা—ডিউ ফ্যাক্টর কাজে লাগাও। নতুন বল নাও। প্রেরক বাংলার নির্বাচক কমিটির তখনকার চেয়ারম্যান আমাদের বাদলদা। আমি তা না শুনে দিলীপ দোশীকে দিয়েই বল করিয়ে ম্যাচটা জিতে গেলাম।

শনিবার দুপুরবেলা বাড়িতে যখন শুনলাম আমার সেই বাদলদা আর নেই, তখন ঝাপসা চোখে এই ঘটনাটাই মনে পড়ছিল বার বার।

প্রায় ষাট বছরেরও বেশি সময়ের পরিচয়। পুরো নাম পুণ্যব্রত দত্ত। যদিও এই নামে ওঁকে খুব কম মানুষই চিনতেন। পিবি দত্ত নামেই ক্রিকেটমহলে পরিচিত। ডাক নাম বাদল। আমার চেয়ে বারো-চোদ্দো বছরের বড়। আমি ওঁকে বাদলদা নামেই ডেকে এসেছি সারাজীবন। মোহনবাগানের হয়ে এক সঙ্গে খেলা শুধু নয়। ক্রিকেটার চুনী গোস্বামীর জীবনে বাদলদা ছিলেন একজন ফ্রেন্ড, ফিলোজফার ও গাইড।

গত বিশ বছরেরও বেশি সময় বাদলদার সঙ্গে রোজ বিকেলে আড্ডা দিয়েছি সাউথ ক্লাবে। কারণ আমার মতো উনিও ছিলেন দক্ষিণ কলকাতার এই অভিজাত ক্লাবের সদস্য। কথাবার্তা, চালচলনে পুরোদস্তুর সাহেব। তবুও বাদলদা মনেপ্রাণে ছিলেন এক জন খাঁটি বাঙালি এবং আদ্যন্ত এক ক্রিকেট ভক্ত।

কেমব্রিজ ব্লুজ। পড়াশোনা এবং ক্রিকেট-পাঠটাই বিলেতে। সেখানে থাকার সময় খেলেছেন অনেক বড় বড় ক্রিকেটারদের সঙ্গে। আমাদের ছোটবেলায় এই শহরে এ রকম মানুষদের উপর শ্রদ্ধা এবং কদরটাই ছিল আলাদা। বাদলদা পড়তেন সেই দলে। বাদলদার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ যখন আমি মিলন সমিতিতে ক্রিকেট খেলছি। বাদলদা তখন কালীঘাটে। তার পর দু’জনেই এক সঙ্গে খেলেছি মোহনবাগানে।

পুণ্যব্রত দত্ত (১৯২৪-২০১৬)

শুধু একজন ওপেনিং ব্যাটসম্যান নন। বাঁ হাতে স্পিনটাও দুর্দান্ত করতেন বাদলদা। মোহনবাগানে যখন খেলতাম তখন বাদলদা ছিলেন আমাদের গ্রুপের মধ্যমণি। যে দলে বাদলদা আর আমি ছাড়াও ছিল শ্যামসুন্দর মিত্র, জ্যোতিষ মিত্র, নিমাই ঘোষ এবং আমার দাদা মাণিক গোস্বামী। প্রায়ই ম্যাচের পর আমাদের এই পুরো গ্রুপটাকে নিয়ে বাদলদা গঙ্গার ধারে বা ভিক্টোরিয়ায় চলে যেতেন। কখনও কখনও সেই দলে এসে যোগ দিতেন বিবি নিম্বালকর, সুভাষ গুপ্তেরাও। সেখানেই আমাদের খেলা নিয়ে খুঁটিনাটি আলোচনা করতেন বাদলদা। বয়সে বড় হলেও কোনও দূরত্ব না রেখে মিশতেন একদম বন্ধুর মতো।

একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। সে বার মোহনবাগান-স্পোর্টিং ইউনিয়ন ম্যাচ। আমাদের বিরুদ্ধে পঙ্কজদা (রায়) ও অম্বর (রায়)। ক্রিজে আমি আর বাদলদা। নন স্ট্রাইক এন্ড থেকে হঠাৎ এসে বললেন, ‘‘চুনী, উল্টোদিকে পঙ্কজ আর অম্বর। মাথা ঠাণ্ডা রেখে তিনশো আমাদের করতেই হবে। না হলে ওরা রান তুলে দেবে।’’ এ কথা বলার কিছুক্ষণ পরেই বাদলদা মিড উইকেটে ক্যাচ তুলে দিয়ে ফিরে গেলেন প্যাভিলিয়নে। ফেরার সময় ছোট্ট একটা কথা বলে আত্মবিশ্বাসটা বাড়িয়ে দিয়ে গেলেন ‘‘সরি চুনী, আমিই ভুলটা করলাম, প্লিজ, কিছু মনে কোরো না। তুমি একাই পারবে বড় ইনিংস খেলে ওদের হারিয়ে দিতে।’’ ম্যাচটায় আমি বড় রান করে জিতিয়েছিলাম।

ক্রিকেট জীবনে নিজের সেরা সময়ে স্পিনের বিরুদ্ধে ছিলেন দেশের অন্যতম সেরা ব্যাট। বলতে দ্বিধা নেই বাংলার হয়ে ওঁর মতো অত ভাল স্পিন খেলতে আমি কাউকে দেখিনি। পঙ্কজ রায়কে মাথায় রেখেও এ কথা বলছি। ওঁর প্রতিভার ঠিক মতো বিচার হয়নি। হলে ভারতের হয়ে খেলা উচিৎ ছিল বাদলদার। স্পিনের বিরুদ্ধে ওঁর ফুটওয়ার্কটাই ছিল দেখার মতো। ক্রিকেটার জীবনে আমিও অনেক সময় স্পিন খেলতে গিয়ে ওঁর মূল্যবান পরামর্শ পেয়েছি।

রঞ্জিতে চারটে সেঞুরি করেছেন। কিন্তু আমার দেখা বাদলদার জীবনের সেরা ইনিংস ১৯৫২-৫৩ মরসুমে র়ঞ্জি ট্রফির ফাইনাল ম্যাচটা। হোলকারের বিরুদ্ধে ইডেনে সেই ম্যাচে বাংলার হয়ে ওপেন করতে নেমে ১৪১ রান করেছিলেন নিম্বালকর, মুস্তাক আলিদের পিটিয়ে। কিন্তু দূর্ভাগ্য, প্রথম ইনিংসে বাংলা পিছিয়ে থাকায় সে বছর রঞ্জি চ্যাম্পিয়ন হয়ে যায় হোলকার। না হলে ১৯৩৮ সালে টম লংফিল্ডের নেতৃত্বে বাংলার রঞ্জি ট্রফি জয়ের পর বাদলদার দাপটে সে বছরই দ্বিতীয় বার র়ঞ্জি চ্যাম্পিয়ন হয়ে যেত বাংলা।

ক্যাপ্টেন হিসেবেও বাদলদা ছিলেন তুখোড়। কিন্তু একটু ডিফেন্সিভ। তিনটে স্লিপ, দুটো গালি রেখে আগ্রাসী অধিনায়কত্ব করতে না দেখলেও ক্রিকেট সেন্স কাজে লাগিয়েই বিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের ঠিক বাগে নিয়ে আসতেন।

হাসি-ঠাট্টা-আড্ডা-পরামর্শের মুঠোমুঠো স্মৃতি রয়েছে বাদলদার সঙ্গে। কিন্তু মৃত্যু অমোঘ সত্য। তাকে তো এড়ানো যায় না। শনিবার থেকে বাদলদা বাংলা ক্রিকেটের ইতিহাস বইয়ের পাতায় ঢুকে গেলেন। তবুও আমার কাছে তিনি চিরঅমর হয়ে থাকবেন তাঁর সৌজন্যবোধ, মার্জিত ব্যবহার এবং তুখোড় ক্রিকেট মগজের জন্য।

পি বি দত্ত

ব্যাট হাতে

প্রথম শ্রেণিতে ম্যাচ ৩৪,

ইনিংস ৫২, রান ১৪৫৯,

সেরা ১৪৩

বল হাতে

ম্যাচ ৩৪, উইকেট ৪১, সেরা ৫-৫২

P.B. Dutta Passed Away Biswarup Dey Chuni Goswami
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy