Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

ক্লাব ফুটবলের ক্লান্তিতেই এই হাল বিশ্বসেরাদের

বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন জার্মানি মানে আমার কাছে শুধু একটা লড়াকু দল নয়। ভরপুর ফুটবল-মনোরঞ্জনও। যারা গোল করবে। আবার এমন সমস্ত মুভও তৈরি করবে যা সবাইকে আনন্দ দেবে। কিন্তু শনিবার রাতের জার্মানিকে আমি কী বলব? এমন একটা দল যারা নিজেদের সেরাটা দু’বছর আগে ব্রাজিলেই ফেলে এসেছে!

সুব্রত ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০৪ জুলাই ২০১৬ ০৩:৪০
Share: Save:

বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন জার্মানি মানে আমার কাছে শুধু একটা লড়াকু দল নয়। ভরপুর ফুটবল-মনোরঞ্জনও। যারা গোল করবে। আবার এমন সমস্ত মুভও তৈরি করবে যা সবাইকে আনন্দ দেবে। কিন্তু শনিবার রাতের জার্মানিকে আমি কী বলব? এমন একটা দল যারা নিজেদের সেরাটা দু’বছর আগে ব্রাজিলেই ফেলে এসেছে! নাকি যাদের ক্লান্ত ফুটবলাররা ক্লাব ফুটবলেই সব কিছু উজাড় করে ইউরো কাপ কোয়ার্টার ফাইনালে নেমেছে!

১২০ মিনিট অবধি ১-১ থাকায় টাইব্রেকারের সাডেনডেথে জিতে জার্মানি সেমিফাইনাল গেল ঠিকই। তা সত্ত্বেও বলব, ইতালির বিরুদ্ধে বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের ছায়া পর্যন্ত দেখতে পেলাম না। বরং এমন একটা জার্মানি দল চোখে পড়ল যারা আক্রমণ করতেই ভয় পাচ্ছিল। যে ব্যাপারটা খুব তাড়াতাড়ি শুধরোতে না পারলে ওদের কিন্তু আরও চার বছর অপেক্ষা করতে হবে ইউরোপ সেরা হতে।

ইতালি বরাবর রক্ষণাত্মক ঘরানা। সব সময় চায় ব্যাকলাইন টাইট রাখতে। বল কম ধরে খেলতে। কিন্তু জার্মান ফুটবল তো যুগে যুগে পাল্টেছে। একটা সময় শারীরিক ফুটবল খেলতে ভালবাসা দল এখন সম্পূর্ণ সুইচ করেছে ফ্লুইড ফুটবলে। অর্থাৎ ছোট ছোট পাসে হাই টেম্পোয় আক্রমণ। কিন্তু ইতালির বিরুদ্ধে না ছিল সেই ফ্লুইড ফুটবল, না ছিল হাই টেম্পো। বরং এক ধরনের ঘুমপাড়ানি ফুটবলে পরিণত হয়েছিল। একটা মুভও যেখানে তৈরি হচ্ছে না। শুধু মিস পাস আর মিস পাস।

জার্মানির মতো দলে প্রতিভার অভাব নেই। যে পজিশনের দিকে তাকাবেন দুর্দান্ত সব ফুটবলার। তার পরেও কেন ইতালির মতো তারাও ৩-৫-২ ফর্মেশনে শুরু করবে? সবার নিজস্ব একটা ধরন আছে খেলার। জার্মানিও তিন-চারটে পাসে একটা মুভ শেষ করে থাকে। সেই জার্মানি এত গুটিয়ে থাকল কেন? তা হলে আর মুলার, ক্রুজের মতো বলপ্লেয়ারদের কী কাজ জোয়াকিম লো-র দলে?

ব্রাজিল বিশ্বকাপের জার্মানি ছিল অনেক বেশি ডিরেক্ট। প্রতিটা ম্যাচে ডিরেক্ট পাসে বিপক্ষকে নাজেহাল করেছিল। স্পেন যেখানে খুব স্লো বিল্ড-আপ করে, জার্মানি সেখানে পাসিং সিস্টেমের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিল দ্রুত গতিতে আক্রমণ। না হলে ব্রাজিলের মতো দলকে কেউ সাত গোল দিতে পারে না কি?

কিন্তু ইউরোর জার্মানি পাসিং মুভ প্রায় তৈরি করতেই পারছে না। প্লেয়াররা সাপোর্টে আসছে না। আর তাই যার পায়ে বল তার কাছে কোনও আউটলেট থাকছে না। কিমিচ-ওজিলরা বল নিয়ে উঠে সতীর্থদের কাউকে দেখতেই পাচ্ছে না। পরের পাসটা দেবে কাকে? আর যদি বা দু’-এক বার কেউ সাপোর্টে থাকে তা হলেও মিস পাস হয়ে যাচ্ছে। শনিবার দ্বিতীয়ার্ধের মাঝামাঝি ওজিলের ১-০ করাটা তো কতকটা ভাগ্যের জোরে ডিফ্লেকটেড পাস থেকে হওয়া গোলে!

জার্মান ফরোয়ার্ড লাইন তো ডাহা ফ্লপ। মারিও গোমেজ এ পর্যন্ত টুর্নামেন্টে দুটো গোল করে থাকতে পারে কিন্তু ওকে দিয়ে কেউ ইউরোর মতো বড় টুর্নামেন্ট জেতার কথা ভাবতে পারে কি? ওজিলের গোলের সময় গোমেজের হোল্ড আপ প্লে দারুণ ছিল ঠিকই। কিন্তু অর্ধেক সময় যখন উইং থেকে ক্রস আসছিল গোমেজ নেই! উইঙ্গাররা সব সময় টার্গেট ম্যান খোঁজে। সেন্টার ফরোয়ার্ডদের দায়িত্বই হচ্ছে সঠিক সময় তোমাকে বক্সের মধ্যে থাকতে হবে। ক্রস থেকে গোল না করো অন্তত কর্নার আদায়ের চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু কোথায় কী?

বিশ্বকাপে জার্মানির গোলের আউটলেট ছিল টমাস মুলার। ছেলেটা পুরোপুরি পোচার। পুরো ম্যাচে বেশি কিছু করবে না। কিন্তু ঠিক গোলটা করে চলে যাবে। সেই মুলারকেই তো দেখে মনে হল ক্লান্ত। দৌড়তে চাইছে না। বলের থেকে যেন পালাচ্ছে! সুযোগ পেলেও অতিরিক্ত বেশি চিন্তা করছে। গোমেজ বসে যাওয়ার পরে তো পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে গেল মুলার। জার্মানিকে ফরোয়ার্ডে বিধ্বংসী হতে গেলে মুলারকে পুরনো ফর্মে ফিরতেই হবে।

ফরোয়ার্ড লাইনের মতো জার্মান মাঝমাঠও এই ম্যাচে আমায় হতাশ করল। টনি ক্রুজের মতো পাস মাস্টার আছে লো-র দলে। যে ফুটবলার কিনা দশটা পাস বাড়ালে ন’টা একদম কারেক্ট হবে। জার্মানির সেট পিস ডেলিভারিও জঘন্য ছিল। কর্নার বা ইনডায়েরেক্ট ফ্রি-কিকের সময় অর্ধেক বলের ডেলিভারি ঠিকঠাক হল না। আসলে মুলারের মতো ক্রুজও তো ক্লান্তির শিকার। দোষ দিয়েও তাই লাভ নেই। কারণ ইউরো শুরুর কিছু সপ্তাহ আগে পর্যন্ত রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে ৭০ মিনিট খেলেছিল ক্রুজ। ফুটবলাররা তো মেশিন নয়। যারা ক্লাবের হয়ে পঞ্চাশের কাছাকাছি ম্যাচ খেলার দিনকয়েকের মধ্যে ইউরোর মতো টুর্নামেন্টে এসে ক্লান্ত হবে না।

আমার যেন খুব মনে হচ্ছে, ফিলিপ লামের অভাব টের পাচ্ছে এই জার্মানি দল। ওর মতো ফুটবলার ভাগ্য করে কোনও টিম পায়। যে দলের স্বার্থে বিভিন্ন পজিশনে খেলতে পারবে। মাঠে নেতৃত্ব দেবে দলকে। মিরোস্লাভ ক্লোজের মতো স্ট্রাইকারই বা কোথায় এখন ওদের? যে গোমেজের জায়গায় থাকলে অত সামনে থেকে সুযোগ নষ্ট করতো না গ্যারান্টি।

সেমিফাইনালে ফ্রান্সের মতো দলের বিরুদ্ধে জার্মানিকে সেই হাই টেম্পো আর দ্রুত মুভমেন্ট ফিরিয়ে আনতে হবে। সাপোর্টিং পাস খেলতে হবে। সঙ্গে লাগবে সেই গোলক্ষুধার্ত মুলারকেও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE