Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

ছাতু খেয়েও সোনার মেয়ে

হাতে সময় নেই। জ্যাভলিন থ্রো-তে ইভেন্টে নামতে হবে। পেটে খিদে। এই অবস্থায় স্নান করে কোনওক্রমে তৈরি হয়ে নেওয়া এবং বাড়ি থেকে সঙ্গে আনা ছাতু খেয়েই দৌড়ে মাঠে।

প্রতিভা: জ্যাভলিন থ্রো-তে সোনা মামনি ঘোষের। নিজস্ব চিত্র

প্রতিভা: জ্যাভলিন থ্রো-তে সোনা মামনি ঘোষের। নিজস্ব চিত্র

রতন চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০১৭ ০৪:১১
Share: Save:

মালদহের ফুলবারিয়া গ্রামের বাড়ি থেকে মেয়েটি বেরিয়েছিল আগের দিন সন্ধ্যা সাতটায়। সারা রাত ট্রেনে ঘুমোতে পারেনি। বৃহস্পতিবার ভোরে শিয়ালদহে পৌঁছেও সল্টলেক সাইতে পৌঁছতে বেজে গিয়েছিল দশটা। ততক্ষণে শুরু হয়ে গিয়েছে রাজ্য অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতা।

হাতে সময় নেই। জ্যাভলিন থ্রো-তে ইভেন্টে নামতে হবে। পেটে খিদে। এই অবস্থায় স্নান করে কোনওক্রমে তৈরি হয়ে নেওয়া এবং বাড়ি থেকে সঙ্গে আনা ছাতু খেয়েই দৌড়ে মাঠে। তারপর মামনি ঘোষ যেটা করল সেটা আরও চমকপ্রদ। বছর সতেরোর মেয়েটি সোনা তো পেলই, সঙ্গে তৈরি করল প্রতিযোগিতার রেকর্ড।

অনূর্ধ্ব ১৮ বিভাগে নাঘোরিয়া হাইস্কুলের মেয়েটির কাণ্ড দেখে অবাক অ্যাথলেটিক্স সংস্থার কর্তারাও। এক পশলা বৃষ্টির পর মামনি যখন এ দিন বিকেলে সাইতে দাঁড়িয়ে নিজের জীবনের কথা বলছিল তখনও তার উচ্ছাস কমেনি। ‘‘মাঠে ঢুকে দেখি জ্যাভলিন থ্রো শুরু হয়ে যাচ্ছে। চোটের জন্য অনেক দিন প্রস্তুতি নিতে পারিনি। একটা ভয় ছিল। পারব তো? ভাবতেই পারছি না রেকর্ড করেছি,’’ বলার সময় হাঁফাচ্ছিল সোনার মেয়ে। গতবারও এই ইভেন্টে সোনা জিতেছিল মামনি।

তবে ছোঁড়াটা এ বারের মতো হয়নি। এ বার রাজমিস্ত্রীর মেয়ে ছুঁড়েছে ৩৪.৮৩ মিটার। ‘‘আমার লক্ষ্য বাংলার হয়ে জাতীয় মিটে রেকর্ড গড়া। যাতে একটা চাকরি পাই। বাড়িতে তো ঠিক মতো খাবার জোটে না।’’ বলতে বলতে দশম শ্রেণীর ছাত্রীর গলা ধরে আসে। বারবার বলছিল, ‘‘বাবা কিছু করে না। স্কুলের স্যার এবং কোচ পুলক ঝা আমাকে মেয়ের মতোই দেখেন। উনিই অনুশীলনের পর আমার হাতে খাবার তুলে দেন।’’

আরও পড়ুন: ‘টপ অফ দ্য রক’এ বান্ধবীকে প্রোপজ করলেন স্টিভ স্মিথ

কন্যাশ্রী প্রকল্প থেকে অন্য গ্রামের মেয়েদের মতোই সাইকেল পেয়েছে মামনি। সেটা চড়েই পাঁচ কিলোমিটার দূরে ভোর ছ’টার মধ্যে চলে আসে নাখোরিয়া স্কুলের মাঠে। ন’টা পর্যন্ত অনুশীলন করে আবার গ্রামের বাড়িতে ফেরা। ফের পোশাক বদলে স্কুলে আসা। বিকেলে অনুশীলন করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরা। প্রত্যেক দিন পনেরো-কুড়ি কিলোমিটার সাইকেল চালানো, সঙ্গে হাড়ভাঙা অনুশীলন এবং স্কুল। মামনি একা নয়, এ রকম রোজনামচা শোনা যেতে পারে মিটে আসা ১২০০ অ্যাথলিটের অনেকের মুখ থেকেই। উদ্বোধনী মার্চপাস্টে দেখা গেল অনেক মুখই যে মামনির মতো। রুক্ষ এবং জেদী।

যেমন এ দিনের পড়ন্ত বিকেলে অনূর্ধ্ব ১৬ বিভাগে ছেলেদের ২০০০ মিটারে নতুন রেকর্ড গড়া (৫ মিনিট ৫৩.৪ সেকেন্ড) পীযূষ গোলদারের কথাই ধরা যাক। বাবা মারা গিয়েছেন ছোটবেলায়। মা ভোরে লোকাল ট্রেনে কলকাতায় এসে লোকের বাড়ি রান্না করেন। বনগাঁর প্রত্যন্ত গ্রামের সেই পীযূষ-ই ইস্টবেঙ্গল জার্সি গায়ে এ দিন উজ্জ্বল। সোনার সঙ্গে রেকর্ড। সেখানেও সেই একই গল্প। দারিদ্র। এ রাজ্যর অ্যাথলিটদের যা নিত্যসঙ্গী।

ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। পিঙ্কি প্রামানিক রেলের চাকরি থেকে দেড় বছরের ছুটি নিয়ে আধুনিক অনুশীলন করেও ছিটকে গিয়েছেন হিটেই। আর এ রাজ্যের শুধু নয়, ভারতের অন্যতম প্রতিশ্রুতিমান অ্যাথলিট চন্দন বাউরি অনূর্ধ্ব ২০ বিভাগে ২০০ মিটারে নতুন রেকর্ড (২১.৭) গড়লেও পিছিয়ে পড়ছেন নিজের দোষেই। চোট লুকিয়ে এশীয় এবং আন্তর্জাতিক তিনটে টুনার্মেন্টে নেমেছিলেন তারকেশ্বরের তরুণ। তাতেই চোট বেড়ে গিয়েছে। জাতীয় শিবির থেকে ছিটকে গিয়েছেন আগেই। ‘‘চোট নিয়ে নামাটাই ভুল হয়েছিল। উল্টে দেড় বছর মাঠের বাইরে চলে গেলাম,’’ বলছিলেন চন্দন। রাজ্য সংস্থার সচিব কমল মৈত্র অবশ্য বলছেন, ‘‘ওর কোচ-ই চন্দনকে ডোবাচ্ছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE