স্মৃতি: দিল্লিতে প্রবাসী বাঙালিদের কাছে ডুরান্ড কাপের ডার্বি ছিল একটা উৎসব। ফাইল চিত্র
আমার মোহনবাগান সমর্থক হয়ে ওঠার কাহিনিটা খুব চমকপ্রদ। আমাদের পরিবারের অধিকাংশ সদস্যই ছিলেন ইস্টবেঙ্গল সমর্থক। ব্যতিক্রম আমার সেজ জেঠু ডক্টর দীপ্তীশ চক্রবর্তী। তিনি ছিলেন মোহনবাগানের আজীবন সদস্য। ওঁর ছেলে অর্থাৎ, আমার দাদাও মাঠে যেতেন। শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালের কাছে আলেকজান্ডার কোর্টে জেঠুরা থাকতেন। আমাদের বাড়ি ছিল পণ্ডিতিয়া রোডে। সেটা পুরোপুরি ইস্টবেঙ্গলের পাড়া ছিল। তখন আমার বয়স ছিল আট অথবা নয়। তাই দুই প্রধানের রেষারেষির ব্যাপারটা বুঝতাম না। মাঝেমধ্যেই জেঠুর বাড়িতে থাকতে যেতাম। সেখান থেকেই খেলা দেখতে যেতে যেতে কবে যেন নিজের অজান্তেই মোহনবাগানের সমর্থক হয়ে গিয়েছিলাম। সেই অর্থে আমার মোহনবাগানের সমর্থক হয়ে ওঠার নেপথ্যে কোনও কারণ ছিল না।
প্রথম ডার্বি দেখাও জেঠু ও দাদার সঙ্গে। মনে আছে, মা আমাকে জেঠুর বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এসেছিলেন। তবে অভিষেকের ডার্বিতে মোহনবাগান জিতেছিল কি না এখন আর মনে করতে পারছি না। সেই সময় শুধু জানতাম, মোহনবাগান সবুজ-মেরুন জার্সি পরে খেলে। গোল হলে জেঠু ও দাদা আনন্দে চিৎকার করতেন, আমিও গলা মেলাতাম ওঁদের সঙ্গে।
এই সময় হঠাৎই কলকাতার পাঠ চুকিয়ে আমাদের দিল্লি চলে যেতে হয়েছিল। কিন্তু মোহনবাগানের প্রতি ভালবাসা ও আবেগ একটুও কমেনি। দিল্লির হাইস্কুলে যাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়, তারাও সবাই ছিল মোহনবাগানের সমর্থক। আমরা একসঙ্গে ডুরান্ড কাপ দেখতে যেতাম। আমার বাবা অবশ্য ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান কোনও দলেরই সমর্থক ছিলেন না। যে দল ভাল খেলত, তাদের সমর্থন করতেন।
আমাকে খেপানোর জন্য প্রায়ই বলতেন, ‘‘ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান করেই মরলে তোমরা! এ বার জর্জ টেলিগ্রাফ বা এরিয়ানের মতো অন্য কোনও দলকে সমর্থন করো।’’
শুধু নিয়মিত খেলা দেখাই নয়, সাংঘাতিক ভাবে মোহনবাগানের হয়ে গলা ফাটাতাম। উন্মাদনা এতটাই ছিল যে, মায়ের শাড়ি দিয়েই পতাকা বানিয়েছিলাম। তবে এর জন্যে মায়ের কাছে বকুনি খেতে হয়নি। কারণ, মা-ই তাঁর প্রায় বাতিল হয়ে যাওয়া শাড়ি দিয়েছিলেন মোহনবাগানের পতাকা বানানোর জন্য। সবুজ ও মেরুন রঙের শাড়ি সেলাই করে মোহনবাগানের পতাকা বানিয়েছিলাম।
শুধু পতাকা বানিয়ে, স্টেডিয়ামে গিয়ে প্রিয় দলের জন্য চিৎকার করেই আমাদের কাজ শেষ হত না। ডুরান্ড ও ডিসিএমের খেলাগুলো হত দিল্লির অম্বেডকর স্টেডিয়ামে। আর মোহনবাগান অনুশীলন করত ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে। মোহনবাগান টিম সেখান থেকেই সরাসরি অম্বেডকর স্টেডিয়ামে যেত। গাড়ি নিয়ে আমরা থাকতাম ঠিক টিমবাসের ঠিক সামনে। আমাদের গাড়ির পিছনে ক্যারিয়ারে বাঁধা বাঁশের ডান্ডায় লাগানো থাকত শাড়ি দিয়ে তৈরি সেই পতাকা। যেন প্রিয় দলকে ‘এসকর্ট’ করে নিয়ে যাচ্ছি। শুধু তাই নয়। পুরো রাস্তায় উৎসাহ দিতাম ফুটবলারদের। এক্কেবারে কট্টর মোহনবাগান সমর্থক। অসাধারণ উন্মাদনা ছিল।
মোহনবাগানের সমর্থক হওয়ার জন্য বিদ্রুপ কম সহ্য করতে হয়নি। ১৯৭৫ সালের আইএফএ শিল্ড ফাইনালে ইস্টবেঙ্গল আমাদের পাঁচ গোলে চূর্ণ করেছিল। দিল্লিতে থাকলেও পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যে, লাল-হলুদ সমর্থক দেখলেই মুখ লুকিয়ে পালাতাম। আমাদের ইস্টবেঙ্গল সমর্থক বন্ধুরা পাঁচটা আঙুল দেখাত। চায়ের দোকানে গেলে বলত, ‘‘এই তো এসে গিয়েছে, ওদের পাঁচটা চা দাও!’’ বেশ কয়েক দিন ধরে এই ধরনের বিদ্রুপ চলেছে। রীতিমতো অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল জীবন। ভাগ্যিস সেই সময় দিল্লিতে ছিলাম। কলকাতায় থাকলে কী হত কে জানে!
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফুটবল নিয়ে উন্মাদনাও কমতে শুরু করে। কাজের চাপে মাঠে যাওয়াও প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কলকাতায় ফিরে আসি। বাবা মারা যান। তার পরে এমন একটা পেশায় (অভিনয়) জড়িয়ে পড়লাম, যেখানে খেলা দেখার সময়ই থাকত না। এই পেশায় কখন কাজ শেষ হবে, কেউ জানে না। তা ছাড়া মাঠে গিয়ে খেলা দেখার আরও একটা সমস্যা ছিল। গ্যালারির দর্শকেরা কেউ ছবি তোলার অনুরোধ করতেন। কেউ অটোগ্রাফ চাইতেন। খেলার চেয়েও আমি বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতাম।
রবিবার আমাদের নাটকের একটা শো রয়েছে, ফলে ডার্বি দেখার সম্ভাবনা কম। আমি চাই মোহনবাগান জিতুক। তবে ফুটবল তো, ফেলুদার পক্ষেও ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব নয়।
অনুলিখন: শুভজিৎ মজুমদার
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy