Advertisement
E-Paper

বাবার ভ্যান ব্রেক কষেছে, জীবনের ট্র্যাকে স্বপ্নের সোনাজয়ী লাফ ‘পুচু’র

ছোট মেয়ে স্বপ্নার স্বপ্ন পূরণের দায়িত্ব সেই সময় এসে বর্তায় ‘ছোড়দা’ অমিতের উপর। এর মধ্যেই ‘সাই’তে সুযোগ পায় পঞ্চাননবাবুর আদরের মেয়ে পুচু। কলকাতায় চলে আসে সে।

পার্থ চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০১৭ ১৯:০৩
এই টিনের ঘরেই দ্যূতি ছড়াচ্ছে সোনার মেয়ের সব পদক। সে গুলিই দেখাচ্ছেন স্বপ্নার মা বাসন্তীদেবী ও বাবা পঞ্চানন বর্মন। নিজস্ব চিত্র।

এই টিনের ঘরেই দ্যূতি ছড়াচ্ছে সোনার মেয়ের সব পদক। সে গুলিই দেখাচ্ছেন স্বপ্নার মা বাসন্তীদেবী ও বাবা পঞ্চানন বর্মন। নিজস্ব চিত্র।

ভ্যান চালানো কবেই থেমেছে বাবার। সেই ব্রেন স্ট্রোকের পর থেকে। দিন আনা দিন খাওয়ার সংসারে সচল ছিল শুধু এক চিলতে স্বপ্ন। ছোট্ট ‘পুচু’ বিশ্বজয়ের স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে আরও এক ধাপ এগোনোয় সেই বাবার বুকের ছাতি যেন এক দিনে কয়েক ইঞ্চি চওড়া হয়ে গিয়েছে। মেয়ে এ বার বিশ্ব মঞ্চে লাফাবে!

বাবা পঞ্চানন বর্মন ভ্যান চালাতেন। দাদা অমিত রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে। এমন পরিবার থেকে উঠে আসা স্বপ্না বর্মনকে ঘিরেই এখন জলপাইগুড়ির স্বপ্নেরা দৌড়চ্ছে বিশ্বজয়ের পথে। ভুবনেশ্বরের কলিঙ্গ স্টেডিয়াম রবিবার দেখেছে এশিয়ান অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপে হেপ্টাথলিট স্বপ্না বর্মনের সোনাজয়ী সেই সমস্ত লাফ। সেখান থেকে প্রায় হাজার কিলোমিটার দূরে জলপাইগুড়ির বাড়ির উঠোনে বসে স্বপ্নার বাবা পঞ্চাননবাবু সোমবার তাঁর ‘পুচু’র সেই সব লাফ যেন দেখতে পাচ্ছিলেন। আর ঘুরে ফিরেই বলছিলেন, ‘‘মেয়েটাকে কত্ত দিন দেখিনি!’’

বছর চারেক আগে ব্রেন স্ট্রোক হয় পঞ্চাননবাবুর। একমাত্র রোজগেরে মানুষ একেবারে বসে যাওয়ায় সংসারের হাল ধরেন তাঁর ছোট ছেলে। রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করেন তিনি। চার ছেলেমেয়ের মধ্যে বড় ছেলে আগে থেকেই অন্যত্র থাকেন। তাঁর আলাদা সংসার। আর বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। কাজেই ছোট মেয়ে স্বপ্নার স্বপ্ন পূরণের দায়িত্ব সেই সময় এসে বর্তায় ‘ছোড়দা’ অমিতের উপর। এর মধ্যেই ‘সাই’তে সুযোগ পায় পঞ্চাননবাবুর আদরের মেয়ে পুচু। কলকাতায় চলে আসে সে। অ্যাম্বিশনের সরু সুতোয় পরিশ্রমের মুক্তগুলো এক এক করে গাঁথছিল ছোট্ট মেয়েটি। আজ সেই ছোট্ট মেয়ে ‘পুচু’র মুখটা ভীষণ মনে পড়ছে বাবার।

সোনার মেয়ের স্বপ্ন পূরণে পরিবারের অদম্য লড়াইয়ের কাহিনি জানতে দেখুন ভিডিও...

জলপাইগুড়ি শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে পাতকাঁটা গ্রাম পঞ্চায়েত। সেখানকার ঘোষপাড়ায় পঞ্চাননবাবুর বাড়ি। বাড়ি বলতে, টিনের দুটো ছোট্ট ঘর। দেওয়াল টিনের। মাথাতেও টিনের চালা। তারই একটা ঘরের শো-কেসে স্বপ্নার এত দিনকার সাফল্যের সব পদক রাখা। পাড়া-প্রতিবেশীরা ভিড় করেছেন। এ সব তাঁরা বহু দিন ধরেই দেখছেন। কিন্তু, আজ তো তাঁদের পুচু ‘সোনার মেয়ে’। তাই আগ্রহটাই অন্য মাত্রা পেয়েছে। স্বপ্নার মা বাসন্তীদেবী সে সবই ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছিলেন। আর বলছিলেন, ‘‘জানেন তো, কত্ত কষ্ট করেছে মেয়েটা!’’

আরও পড়ুন: ‘স্যার না থাকলে কবেই অভাবের গ্রামে কাদা মাখা গলিতে হারিয়ে যেতাম!’

সেই খেই ধরে নিলেন পঞ্চাননবাবু, ‘‘জানেন, মেয়েটা তখন থ্রি বা ফোরে পড়ে। প্রাইমারি স্কুলে এখনকার মতো তখনও বছরে এক বার স্পোর্টস হত। মেয়ে ওই প্রাইজের লোভে হাইজাম্প, লং জাম্পে নাম দিত। ও প্রাকটিস করবে বলে বাড়ির পিছনের মাঠে কোদাল দিয়ে মাটি কুপিয়ে দিয়েছিলাম মনে আছে।’’ বলতে বলতে চোখ ধরে আসে বাবার।​


স্বপ্না বর্মনের হাই জাম্প।

তার পর স্কুল থেকে জেলাস্তর পেরিয়ে কত দূর এগিয়েছে তাঁর পুচু। তিনি সব সময় খেয়ালও রাখতে পারেননি। সেই সময় কতই বা রোজগার তাঁর! মেরেকেটে পঞ্চাশ। তাতে কি আর এতগুলো পেট চলে! তাঁর কথায়, ‘‘দিনের পর দিন শুধু জল খেয়েই ও প্রাকটিসে যেত, জানেন!’’


জ্যাভলিন থ্রোয়ে স্বপ্না।

এত কিছুর পরেও স্বপ্নার সফর যে খুব মসৃণ ছিল, এমনটা নয়। ট্র্যাকে স্বপ্নাকে দেখা যাবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন ছিল! ২০১৫-তে জাতীয় প্রতিযোগিতায় শেষ বার নেমে সাফল্য পেয়েছিলেন স্বপ্না। কিন্তু, তার পরেই পিঠের ব্যথায় কাবু হয়ে পড়েন। মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে নিজের গ্রামে ফিরে গিয়েছিলেন। তার পর সুদিনের সন্ধানে ফের লড়াই শুরু। ঘরের মেয়ের সাফল্যে খুশি গ্রামের মানুষও। এখন তাঁরা স্বপ্নার ঘরে ফেরার অপেক্ষায়। কিন্তু, কবে যে ফিরবে বাবার আদরের পুচু!

যেন ভুবনায়ন ঘটেছে জলপাইগুড়ির!

ছবি: নিজস্ব চিত্র।

Asian Athletics Championships Jalpaiguri স্বপ্না বর্মন Swapna Barman Women's Heptathlon
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy