Advertisement
E-Paper

অমল-হিরে মেলাল বিপরীত দুই স্রোত, থেকে গেল অন্ধকারও

বিপরীত রাজনীতির লোক হওয়া সত্ত্বেও প্রয়াত কোচ অমল দত্তের শেষযাত্রায় তাঁকে রাষ্ট্রীয় সম্মান দেওয়া হল রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে। গান স্যালুট থেকে পুরো রাস্তায় পুলিশি কনভয়, রবীন্দ্র সদনের যেখানে প্রয়াণের পর রাখা হয় রাজ্যের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মরদেহ, সেখানেই সোমবার শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য শায়িত ছিলেন চিরবিতর্কিত ‘ডায়মন্ড কোচ’।

রতন চক্রবর্তী ও দেবাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৬ ০৩:৩৮
শেষ-শ্রদ্ধা। উপরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

শেষ-শ্রদ্ধা। উপরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

বিপরীত রাজনীতির লোক হওয়া সত্ত্বেও প্রয়াত কোচ অমল দত্তের শেষযাত্রায় তাঁকে রাষ্ট্রীয় সম্মান দেওয়া হল রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে।

গান স্যালুট থেকে পুরো রাস্তায় পুলিশি কনভয়, রবীন্দ্র সদনের যেখানে প্রয়াণের পর রাখা হয় রাজ্যের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মরদেহ, সেখানেই সোমবার শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য শায়িত ছিলেন চিরবিতর্কিত ‘ডায়মন্ড কোচ’। সেখানেই রাজনৈতিক বিভেদ দূরে সরিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে আসা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করে দিলেন, ‘‘আমি কলকাতার মেয়র-ক্রীড়ামন্ত্রীকে বলে দিচ্ছি অমল দত্তের নামে কোনও একটি স্টেডিয়াম এবং রাস্তার নামকরণ করতে। ভারতীয় ফুটবলে এ রকম শৃঙ্খলাপরায়ণ মানুষ বিরল। অমলদা ছিলেন একজন বিদগ্ধ এবং ব্যতিক্রমী মানুষ।’’

মুখ্যমন্ত্রীর এই উদারতা যখন এ দেশের প্রথম পেশাদার কোচের মৃত্যু-পরবর্তী দিনের আবহকে নতুন মাত্রা দিয়েছে, ঠিক সেই সময়ই সেখানে কালো দাগ ফেলে দিয়েছে অমলবাবুর হাতে গড়া কিছু ছাত্রের কার্যকলাপ। মা যেমন তাঁর শিশুকে হাতে করে তৈরি করেন, মৃৎশিল্পী একতাল মাটি দিয়ে গড়েন প্রতিমা, তেমনই পাঁচ দশক ধরে ডায়মন্ড কোচও তো অনেককে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি তারকা বানিয়েছিলেন এক ঝাঁক ফুটবলারকে। সুব্রত ভট্টাচার্য থেকে শিশির ঘোষ, তনুময় বসু থেকে তরুণ দে, দীপেন্দু বিশ্বাস থেকে মেহতাব হোসেন— সবাই তো অমল দত্তের ফুটবল-পাঠশালার কৃতী ছাত্র। এঁদের কাউকেই সোমবার সারা দিন দেখা যায়নি দীক্ষাগুরুর মরদেহের সামনে দাঁড়াতে। শ্রদ্ধা জানাতে। মালা দিতে। এঁদের মধ্যে অনেকে অমলবাবুর মৃত্যুর পর টিভিতে ‘প্রিয় কোচ’ সম্পর্কে বাইট দিতে ছাড়েননি। খবরের কাগজে ‘কোট’-ও দিয়েছেন দেদার। কেন আসেননি? সুব্রত বললেন, ‘‘কল্যাণীতে কোচিং করতে এসে আটকে গিয়েছি। গাড়ি ছিল না। ওঁর বাড়ি গিয়েছিলাম। শেষ দিন যেতে পারলে ভাল লাগত। উনি তো আমার হৃদয়ে আছেন।’’ আর এক অনুপস্থিত ছাত্র শিশির ঘোষের অজুহাত, ‘‘আমি শহরের বাইরে, তাই যেতে পারিনি।’’

তবে এসেছিলেন অনেকেই। অমলবাবুর চিরকালীন প্রতিদ্বন্দ্বী কোচ পিকে বন্দ্যোপাধ্যায় অসুস্থতার সময় তাঁর বাড়িতে গেলেও শেষ দিন আসেননি। তবে রবীন্দ্র সদন ও মোহনবাগান— দু’জায়গাতেই শ্রদ্ধা জানাতে হাজির ছিলেন চুনী গোস্বামী। বাগানের ডায়মন্ড বছরের বর্ষসেরা ফুটবলার সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায় বাগুইহাটির বাড়ি থেকে নিমতলা শ্মশান পর্যন্ত ছিলেন দীক্ষাগুরুর শেষ যাত্রার সঙ্গী। অমলবাবুর হাতে গড়া ছাত্রদের মধ্যে শ্যাম থাপা, সমরেশ চৌধুরী, প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, বাবু মানি, সুরজিৎ সেনগুপ্ত, ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, মানস ভট্টাচার্য, শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়, মিহির বসু, অলোক মুখোপাধ্যায়, অতনু ভট্টাচার্য, সন্দীপ নন্দীরা এসেছিলেন গুরুর অন্তিমযাত্রার সঙ্গী হতে। তাঁদের কারও চোখে তখন জল, কেউ স্মৃতিমেদুরতায় আচ্ছন্ন। ভাস্কর স্মৃতি উসকে দিয়ে বলছিলেন, ‘‘অমলদা না থাকলে তো আমি পাঁচ গোলের ধাক্কা সামলে ভাস্কর গাঙ্গুলিই হতে পারতাম না।’’ ছলছল চোখে রবীন্দ্র সদনের করিডরে দাঁড়িয়ে থাকা প্রশান্তর মন্তব্য, ‘‘জুনিয়রদের কী ভাবে অমলদা তারকা বানাতেন, তার উদাহরণ তো আমিই।’’ আর যাঁকে অমল দত্ত একদা ‘কাঁচকলা কোচ’ বলে তাচ্ছিল্য করেছিলেন, সেই অলোকও বলে গেলেন, ‘‘অমলদার মতো মানুষ আমি দেখিনি।’’

সকালে ভারতীয় ফুটবলের পরিব্রাজক কোচের অন্তিম যাত্রা শুরু হয়েছিল জ্যাংড়ার বাড়ি থেকে। তার পর শিকদার পাড়া লেনের পুরনো বাড়ি ছুঁয়ে রবীন্দ্র সদন চত্ত্বর। এর পর দুই প্রধানের ময়দানের তাঁবু হয়ে নিমতলা। আকাশ ভাঙা বৃষ্টিতে তখন শহর থমকে গিয়েছে।


ডান দিক থেকে সমরেশ চৌধুরী, চুনী গোস্বামী, সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায়, প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়রা। সোমবার রবীন্দ্র সদনে।

বোহেমিয়ান কোচ অমলবাবু আজীবন বিতর্কের স্রোতে সাঁতার কাটলেও তাঁর শেষ দিনটি কেটেছে নির্মল ভালবাসায়। শ্রদ্ধায় অবনত হয়েছিল ময়দান। মহমেডানে অনেক দিন কোচিং‌ করালেও তাদের কোনও কর্তাকে দেখা যায়নি কোথাও। কোচ থাকার সময় ইস্টবেঙ্গল এবং মোহনবাগান কর্তাদের বিরুদ্ধে অমলবাবুর মুখ থেকে বারবার বেরিয়েছে তীব্র শ্লেষাত্মক কটাক্ষ। তা সত্ত্বেও ফুটবল জ্ঞান-তপস্বী কোচকে দুই প্রধানের পক্ষ থেকে এ দিন যে সম্মান জানানো হল, তা মনে রাখার মতো। ক্লাব পতাকায় মুড়ে দেওয়ার পাশাপাশি জুনিয়র ফুটবলারদের অর্ধনমিত পতাকা হাতে দাঁড় করিয়ে বা অবনত ভঙ্গিতে শ্রদ্ধা জানানোর ব্যবস্থা করেছিল লাল-হলুদ ও সবুজ-মেরুন শিবির। ইস্টবেঙ্গলে ক্লাব প্রেসিডেন্ট প্রণব দাশগুপ্ত এবং শীর্ষ কর্তা দেবব্রত সরকার ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন অমলবাবুর ক্লাব তাঁবু পরিক্রমার সময়। আর মোহনবাগান? গড়াপেটার অভিযোগে এক সময় যে ক্লাব থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন অমল, সেই ক্লাবেরই দুই প্রধান কর্তা— সহ সচিব সৃঞ্জয় বসু এবং অর্থসচিব দেবাশিস দত্ত এ দিন ক্লাব থেকে তাঁর মরদেহ কাঁধে করে পৌঁছে দিলেন শকটে।

ইস্ট-মোহন যেমন অমল-যাত্রায় ছড়িয়ে দিয়েছিল শ্রদ্ধা, তেমনই দেশের প্রথম পেশাদার কোচকে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন রাজনীতির ডান-বাম সকলেই। সব বিভেদ ভুলে ববি হাকিম-শোভন চট্টোপাধ্যায়-লক্ষ্মীরতন শুক্লর সঙ্গে মালা দিতে দেখা গেল সুজন চক্রবর্তী-আব্দুল মান্নানদেরও। সেখানেও আবহে কালি লেগে গেল অমলবাবুর এক সময়ের দল বিজেপির কেউ না আসায়। সাঁইত্রিশটা ট্রফি জয়ী কোচ তো এক সময় বিজেপির হয়ে লোকসভার ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। একদম অন্তিম মুহূর্তে নিমতলায় যখন চুল্লিতে চিরতরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে বিদ্রোহী কোচের দেহ, তখন হঠাৎই দেখা গেল হন্তদন্ত হয়ে হাজির রাজ্য বিজেপির এক বড় নেতা। টিভি ক্যামেরা দেখে সামনে রাজনৈতিক কাজিয়া বাধিয়ে কিছুক্ষণ পর মিলিয়েও গেলেন তিনি।

বিতর্কিত কোচের শেষ দিনে যা অবশ্য কোনও প্রভাব ফেলল না। বরং হাসির খোরাকই জোগাল।

ছবি: উৎপল সরকার

Amal Dutta Diamond Coach
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy