Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

নরম মাটিতে চলছে প্রহরী-পরম্পরা

দশকের পর দশক বাংলার মাটি থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গোলকিপার উঠে আসার পিছনের রসায়নটা কী? সাতশট্টি বছর ধরে এ দেশের ফুটবলকে আতশ কাঁচের নিচে ফেলে দেখা চুনী গোস্বামী এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বেশ চিন্তিত।

তরুণ বসু, প্রদ্যোত বর্মন এবং ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়।

তরুণ বসু, প্রদ্যোত বর্মন এবং ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়।

রতন চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৫:২১
Share: Save:

ফুটবলে যতই নেমে যাক বাংলার মান, যতই অভাব দেখা দিক ভাল বাঙালি ফুটবলারের, ব্যতিক্রমী এক ছবিও রয়েছে। বরাবরের মতো এখনও ভারতীয় ফুটবলে বাঙালি গোলরক্ষকের রমরমা চলছে।

বাংলায় দশকের পর দশক ধরে সেরা গোলকিপার তৈরি হওয়ার কারণ কী? ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায় থেকে অতনু ভট্টাচার্য। অথবা এই প্রজন্মের সেরা প্রহরী সুব্রত পাল—গত পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় তিন কাঠির নিচে বঙ্গসন্তানদেরই দাপট।

জাতীয় বা ক্লাব দলে যখন সব জায়গাতেই ভিন রাজ্যের ফুটবলারদের থাবা, তখন শেষ রক্ষণে সবার পছন্দই বঙ্গসন্তান। গত বছরও বিভিন্ন ক্লাব দলের গোলের নিচে খেলছেন সুব্রত পাল, সন্দীপ নন্দী, শিল্টন পাল, অরিন্দম ভট্টাচার্য, দেবজিৎ মজুমদার, শুভাশিস রায়চৌধুরী, সন্দীপন ঘোষ-রা। আর এ বছর? আই লিগ বা আই এস এলে তো বটেই, মরসুমের প্রথম টুনার্মেন্ট কলকাতা লিগে নজর কেড়ে নিয়েছেন মহমেডানের শঙ্কর রায়, রেনবোর অঙ্কুর দাশ এবং পাঠচক্রের শুভম রায়। ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায় বলে দিলেন, ‘‘লিগের যা ম্যাচ দেখেছি, এই তিনটে ছেলেকে ভাল লাগছে। ঠিক মতো ঘষামাজা করলে দেখবেন তারকা হয়ে যাবে।’’

দশকের পর দশক বাংলার মাটি থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গোলকিপার উঠে আসার পিছনের রসায়নটা কী? সাতশট্টি বছর ধরে এ দেশের ফুটবলকে আতশ কাঁচের নিচে ফেলে দেখা চুনী গোস্বামী এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বেশ চিন্তিত। বললেন, ‘‘এটা নিয়ে তো সত্যিই ভাবিনি কখনও। পিটার থঙ্গরাজ, ইলিয়াসের মতো দু’একজন বাদ দিলে তো সারা জীবন দেখলাম ওই একটা জায়গায় বাঙালিরাই চিরাচরিত ভাবে শাসন করে গিয়েছে। হয়তো স্বাধীনতা আন্দোলনের সেই জেদ এবং সহিষ্ণুতাটা রক্তে প্রবাহিত সে জন্যই। কিপারের তো দুটোই লাগে।’’

আরও পড়ুন:শূন্যে ভাসার মন্ত্র শঙ্করকে শেখালেন তরুণ ‘স্যার’

চুনীর সমসাময়িক আর এক কিংবদন্তী এবং ভারতীয় ক্লাব ফুটবলের অন্যতম সফল কোচ প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘‘আমি মনে করি একটা ফুটবল টিমের মধ্যে সবথেকে ধৈর্যশীল হতে হয় গোলকিপারকে। তাৎক্ষণিক বুদ্ধির প্রয়োগ, চাপের মুখেও রুখে দাঁড়ানোর মানসিকতা না থাকলে সফল কিপার হওয়া যায় না। এ দেশে বাঙালির চেয়ে বেশি বুদ্বিমান এবং সহনশীল কে আছে?’’

চুনী বা পি কে কখনও গোলের নিচে দাঁড়াননি। নিজেরা গোল করেছেন আর গোল আটকানো দেখেছেন। শেষ রক্ষণ হিসেবে নিজেদের সময়ের নাম বলতে বসলে গড়গড় করে তিনটে নাম তুলে আনছেন ওঁরা। সনৎ শেঠ, প্রদ্যোৎ বর্মন এবং চিত্তরঞ্জন দাশ। সেখান থেকে শুরু করলে দেখা যাচ্ছে তারকা গোলকিপারের ছড়াছড়ি। এবং ভারতীয় দলে গোলকিপারদের স্বর্ণযুগেরও শুরু। তরুণ বসু, প্রশান্ত মিত্রের পরের প্রজন্ম হাজির ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়, প্রতাপ ঘোষ, বিশ্বজিৎ দাশ-দের হাত ধরে। এর পর ব্যাটনটা ওঁরা তুলে দিয়ে গেলেন শিবাজি বন্দ্যোপাধ্যায়, তনুময় বসু, অতনু ভট্টাচার্য, হেমন্ত ডোরা-র হাতে।

বাংলার সেরা ছয়, চুনী গোস্বামীর রেটিং

শিবাজি বন্দ্যোপাধ্যায়

পেনাল্টি বাঁচানোয় সেরা ছিল। দেখে মনেই হতো না কোনও টেনশন আছে।
রেটিং: ৬ /১০

অতনু ভট্টাচার্য

এশিয়ান অল স্টারে খেলেছে। লম্বা ছিল বলে শূন্যের বল দখলে দুর্দান্ত।
রেটিং: ৬ /১০

পরম্পরা চলতেই থাকল। সন্দীপ নন্দী, সুব্রত পাল থেকে শিল্টন পাল এবং এখনকার ফেডারেশনের বিচারে বর্ষসেরা গোলকিপার দেবজিৎ মজুমদারের গ্লাভস কত যে গোল বাঁচিয়েছে ক্লাবের বা দেশের হয়ে! দেশের সবথেকে বয়স্ক গোলকিপার সন্দীপ এ বারও খেলছেন আইএসএলে। সুব্রত পাল টানা এগারো বছর খেলছেন দেশের জার্সিতে। তাঁর মতো ৭৬ ম্যাচ খেলার রেকর্ড এ দেশে কারও নেই। শিল্টন টানা দশ বছর সবুজ-মেরুনে। দেশের সব ট্রফি জিতেছেন। আর দেবজিৎ তো এ বার দেশের সব চেয়ে দামি গোলকিপার। প্রায় কোটি টাকায় তাঁকে নিয়েছে এটিকে।

‘‘বাংলার নরম মাটি কিপার উঠে আসার অন্যতম কারণ। দেশের কোথাও এ রকম মাটি নেই। এই মাটিতে অনুশীলন করলে কাঁটাছেড়া কম হয়। গোলকিপার হচ্ছে একমাত্র জায়গা যেখানে শরীর শূন্যে ছুঁড়ে বল আটকাতে হয়,’’ বলছিলেন অতনু ভট্টাচার্য। একমাত্র বঙ্গসন্তান কিপার যিনি এশিয়ান অল স্টার দলে খেলেছেন। প্রাক্তনের সঙ্গে একমত বর্তমানে জাতীয় দলের সিনিয়র কিপার সুব্রত পাল। ‘‘বাংলার নরম মাটি একটা ফ্যাক্টর অবশ্যই। তার উপর ভাল ভাল প্রাক্তন কিপার আছেন এখানে। যাঁদের সঙ্গে অনুশীলন করা যায়। দেখে শেখা যায়। পাড়ায়-পাড়ায় বহু ভাল গোলকিপার-কোচ আছেন।’’

একটু অন্যরকম কথা বললেন নেহরু কাপ-সহ বহু টুনার্মেন্টে অধিনায়কত্ব করা ভাস্কর। বললেন, ‘‘আইডল দেখে তাঁকে নকল করে বড় হয়ে ওঠার ইচ্ছেও একটা ফ্যাক্টর এ ব্যাপারে। আমি যেমন তরুন দা (বসু)-র মতো হতে চেয়েছি। অতনু আবার আমাকে সামনে রেখে এগিয়েছে বলে। সুব্রত পালদের সামনে ছিল সন্দীপ নন্দী।’’

বাংলায় গোলকিপারদের অ্যাকাডেমি নেই। পাড়ার কোচিং থেকেই বড় হয়ে উঠেছেন ভাস্কর থেকে দেবজিৎ থেকে আজকের শঙ্কর-রা। তবু বাঙালি প্রহরীর পরম্পরা চালু রেখেছেন তাঁরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE